আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জুলাই ও আগস্টে সংঘটিত গণহত্যার বিচারকাজ শুরু হয়েছে। আজ (বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর) ট্রাইব্যুনালে এ বিচারকার্য শুরু হয়েছে।
বৃহস্পতিবার ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন বিচারপতির বেঞ্চ এজলাসে বসছেন। অন্য দুই বিচারপতি হলেন, বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মো. মেহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
এদিনের কার্যতালিকায় আছে তিনটি মামলা। জানা গেছে, ট্রাইব্যুনালে করা হয়েছে মোট ৬০টি অভিযোগ। এর মধ্যে ৫৪টি মামলারই প্রধান আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
যে ট্রাইব্যুনালে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হয়েছে, সেখানেই ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থান দমনে চালানো নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞের বিচার শুরু হলো। যেখানে মূল অভিযুক্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। মূল ভবনের সংস্কার কাজ প্রায় শেষের দিকে। পহেলা নভেম্বরের মধ্যে সেখানে বিচার কাজ হবে। আপাতত টিনশেডের এজলাসেই বসেছে ট্রাইব্যুনাল। এখন পর্যন্ত তদন্ত সংস্থা এবং প্রসিকিউশনে ৫৮টি অভিযোগ জমা পড়েছে। যেগুলোর তদন্ত কাজ চলছে।
এদিকে, জুলাই গণহত্যার বিচার নিয়ে যেন কোনো বিতর্ক তৈরি না হয় সেজন্য আইন সংশোধনের সুপারিশ আন্তর্জাতিক আইনজ্ঞদের। তারা বলছেন, বিচারের প্রতিটি প্রক্রিয়ায় যাতে অপরাধীর আত্মপক্ষ সমর্থনের অবারিত সুযোগের সঙ্গে ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ ও সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখা হবে জানিয়ে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর জানান, ভিডিও ফুটেজের মতো ডিজিটাল আলামত গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য হিসেবে গুরুত্ব পাবে। ১৯৭৩ সালের আইন দিয়ে ২০২৪ সালের বিচার বিতর্কে তিনি আরও জানান, বিদ্যমান আইনে এ বিচার করতে বাঁধা নেই।
প্রসিকিউশন টিমের নিয়োগ আগেই হয়েছিল, অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তিন বিচারক নিয়োগের পর ৫ আগস্টের পর আজ (বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর) আবার নতুনভাবে শুরু হচ্ছে এই ট্রাইব্যুনালের কাজ। ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলিরা বলছেন, এখন পর্যন্ত তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন অফিসে অভিযোগ জমা পড়েছে ৬০টির মত। বিচার কাজ শুরু করতে যেগুলো থেকে চার্জ ফ্রেমিংয়ের কাজ করছে রাষ্ট্রের আইনজীবীরা।
১৯৭১ এ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্তদের বিচার এই ট্রাইব্যুনালে হয়েছে। যেই বিচারের নানা বিষয় নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন তুলেছে জাতিসংঘসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা। এখন যখন জুলাই গণহত্যার বিচারের জন্য সেই একই ট্রাইব্যুনালের ওপর আস্থা রাখতে চায় সরকার, তখন আবারও প্রশ্ন উঠেছে, পুরোনো এই আইন দিয়ে বিতর্কমুক্ত বিচার কতটা সম্ভব? বিশেষকরে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার জন্য যে আইন, সেটা দিয়ে ২৪ সালের।
সেই ট্রাইবুনালের আইনজীবী এখন ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মো. তাজুল ইসলাম। তার কাছে এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'অতীতে যেটা হয়েছে যে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার ক্ষমতা আপনার ছিল, সেটা ব্যবহার করেননি, অপব্যবহার করেছেন। ট্রাইব্যুনালেই শুধু অবিচার হয়েছে তা তো নয়। অতীতে সুপ্রিম কোর্ট ছিল, আমাদের এই ট্রাইব্যুনালের উপরে আপিলেট আদালত হচ্ছে সুপ্রিম কোর্ট। এখানে যে সমস্ত জাজমেন্ট হয়েছে সেগুলো কনফার্ম হয়েছে সুপ্রিম কোর্ট থেকে। ১৯৭৪ সালের আইন দিয়ে অবশ্যই ২০২৪ এর বিচার করা যাবে। ফৌজদারি কার্যবিধির যে আইন আছে সিআরপিসি, এটা ১৯০৮ সারের আইন। সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ সালের। আইন পুরাতন হলে তো কোনো সমস্যা নেই। আমাদের ১৯৭৪ সালের ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্টে বলাই আছে ৭৪ সালের আইন প্রণয়ের আগে বা পরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যেকোনো জায়গায় যদি এই আইনের অপরাধ সংগঠিত হয় তাহলে সেই বিচার করার ক্ষমতা ট্রাইব্যুনালের থাকবে।'
১৯৭৩ সালের দ্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট ১৯৭৩ এর ২৬টি ধারার ৩ নম্বর জুরিসডিকশন অব ট্রাইব্যুনাল এন্ড ক্রাইমস ধারায় আন্তর্জাতিক অপরাধের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। যেমন ৩ এর ২ এর ক-তে বলা হয়েছে: 'হত্যা, নিশ্চিহ্ন করণ, দাসকরণ, নির্বাসিত করণ, কারারুদ্ধ করণ, অপহরণ, অবরোধ করণ, নির্যাতন, ধর্ষণ অথবা বেসামরিক নাগরিকদের উপর অন্যান্য অমানবিক কাজ পরিচালনা করা অথবা সংগঠিত হওয়ার স্থানে অভ্যন্তরীণ আইন ভঙ্গ করে বা না করে রাজনৈতিক, গোত্রগত, জাতিগত অথবা ধর্মীয় কারণে নিপীড়ন করা, মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।'
যেগুলোর সঙ্গে ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের নির্যাতনের মিল রয়েছে বলে মনে করেন আইনজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব দিক বিবেচনা করলে আইনটি বিচারকাজ সম্পন্ন করতে যথেষ্ট শক্তিশালী, কিন্তু আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিশ্চিতে আরও কিছু বিষয়ের ঘাটতি আছে।
দুই এক বছরের মতো একটা দ্রুততম সময় নিয়ে বিতর্কমুক্ত একটা বিচারকাজ সম্পন্ন করতে বেশ আশাবাদী আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের নতুন নিয়োগ পাওয়া প্রসিকিউশন টিম। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে সাক্ষীদের নিরাপত্তা, ভুক্তভোগী ক্ষতিপূরণ দেবার মত আইনের যেসব সংশোধনীর কথা বলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিতে তার কতটা হয়, সেটি বোঝা যাবে এই আইনটির সংশোধন হয়ে, অধ্যাদেশ জারির পর।
এরআগে গত মঙ্গলবার আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ও ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মো. তাজুল ইসলাম জানিয়েছিলেন বৃহস্পতিবার থেকে বিচারকাজ শুরু হবে।
আইন উপদেষ্টা ওইদিন বলেন, ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিম যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে পদক্ষেপ নেবে। সংস্কারের পর ১ নভেম্বর থেকে মূল ভবনে শুরু হবে বিচারকাজ।
তাজুল ইসলাম জানান, প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার প্রয়োজনীয় কয়েকটি আবেদন করা হবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের নেতা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত গুম, হত্যা, গণহত্যাসহ ৬০টির বেশি অভিযোগ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জমা পড়েছে।