ঢাকা ০৪:৩৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

জুলাই-আগস্টের আন্দোলন দমনে ব্যবহার হয়েছিল যুদ্ধাস্ত্র

অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট সময় : ০৩:০৫:৫৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪
  • / ৩৭৩ বার পড়া হয়েছে
৭১ নিউজ বিডির সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র জনতার আন্দোলন দমনে আইন অমান্য করে ব্যবহার করা হয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্রের অস্ত্র। এর মধ্যে আছে এসএমজি–এলএমজি থেকে শুরু করে বিডি-এইট অ্যাসল্ট রাইফেল। অভিযোগ রয়েছে স্নাইপার ব্যবহারেরও। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে রাবার বুলেট ছাড়াও শুধু ৪ দিনেই ছোড়া হয় ১৭ হাজারের বেশি গুলি, এর প্রায় সাড়ে ৪ হাজারই প্রাণঘাতী। পুলিশের করা মামলার নথি পর্যালোচনায় মিলেছে এসব তথ্য।

গণ আন্দোলনের সময় ভয়াবহ সংঘর্ষ হয় রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায়। সেখানে বিক্ষোভ দমনে প্রাণঘাতী অস্ত্র প্রয়োগ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

মামলার নথি বলছে, ১৮ থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত ৪ দিনে এসএমজি থেকে ১৭ রাউন্ড, চাইনিজ রাইফেল থেকে ছোড়া হয় ১ হাজার ৪৯৫ রাউন্ড গুলি। এছাড়া টরাস পিস্তল থেকে ৬৩, নাইন পয়েন্ট ওয়ান নাইন এমএম সিজে রাইফেল থেকেও ৭ রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়। আর এসব প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেন যাত্রাবাড়ী থানার শতাধিক পুলিশ সদস্য।

একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘ওই সময়ের মামলাগুলোতে পুলিশ বাদি সম্ভবত। পুলিশ যেহেতু বাদী হয়ে মামলা করেছে সুতরাং অসত্য তথ্য দেয়নি।’

থানাটির পুলিশ সদস্যের বেশির ভাগই ৫ আগস্টের পর বদলি হয়েছেন। তবে এখনও রয়ে গেছেন অনেকে। তাদেরই একজন এসআই বজলুর রশিদ।

রাবার বুলেট না মেরে এই ধরনের অস্ত্র ব্যবহারের কারণ জানতে চাওয়া হয়েছিল তার কাছে। তিনি বলেন, ‘এটা স্যারদের (ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ) সাথে কথা বলেন।’

২০ জুলাই, মোহাম্মদপুর। এখানেও ব্যবহার করা হয়েছে এসএমজি ও এলএমজি রাইফেল। এছাড়াও ছোড়া হয় এমএম ৭ দশমিক ৬২ ক্যালিবারের চায়না রাইফেলসহ নানা অস্ত্রের গুলি।

মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আলী ইফতেখার হাসান বলেন, ‘প্রত্যেককে ইনডিভিজ্যুয়ালি জবাবদিহি করতে হবে যে সে কেন আদেশটা পালন করেছে। এখানে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশেই মানুষ হত্যা করা হয়েছে যদি বলা হয়, তাহলে পার পাওয়ার আসলে কোনো সুযোগ নেই।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গত ১৮ জুলাই থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত এ চারদিনে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষ হয়েছে। এতে মারা যান অনেকে। তখন পুলিশ বাদী হয়ে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় মামলা করে, এ ধরনের শ’খানেক মামলা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পুলিশ ছাত্রজনতার উপর কি পরিমাণ প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেছে।

এসব অস্ত্র ছাড়াও ওই ৪ দিনে ছাত্র-জনতাকে ঠেকাতে ব্যবহার হয় স্পেশাল পারপাস অটোমেটিক শটগান, বিডি-এইট অ্যাসল্ট রাইফেল,প্রজেক্টাইল, মাল্টি ইম্প্যাক্ট, ভারী বল কার্তুজ ও হ্যান্ড গ্রেনেড। রাবার বুলেট বাদে ছোড়া হয় ১৭ হাজারের বেশি গুলি। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৪ হাজারই প্রাণঘাতী । এ সময় রাজধানীতে নিহত হন ৩৪১ আন্দোলনকারী।

মামলাগুলো পর্যালোচনা করে এক আইনজীবী বলছেন, লক্ষ্যস্থির করেই এসব গুলি ছুড়েছে পুলিশ।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আল নোমান বলেন, ‘এসএমজি, যেটা দিয়ে শত শত গুলি একসাথে বের হয়, এ ধরনের অস্ত্রের ব্যবহার কি প্রয়োজন ছিল? এ ধরনের আন্দোলন থামানোর জন্য আপনি তো টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করতে পারতেন। আপনি রাবার বুলেট ব্যবহার করতে পারতেন।’

এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একাত্তরের পর সাধারণের ওপর এসব অস্ত্র কখনোই ব্যবহার করেনি পুলিশ। ওগুলো ব্যবহৃত হয় শুধুমাত্র যুদ্ধক্ষেত্রে।

সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘কোনো মিছিল, বিক্ষোভ বা সমাবেশে এগুলোর ব্যবহার আমরা আগে কখনও দেখি নি। এই যে ১৫–১৬ বছরে ওরা (পুলিশ) ট্রিগার হ্যাপি হয়ে গেছে। আগের যে ড্রিল, সেগুলো ভুলে গেছে। যেভাবে অস্ত্র ব্যবহার করা দরকার ছিল, এটা ভুলে গেছে।’

অস্ত্র ও বোমা বিশেষজ্ঞ আব্দুল হক বলেন, ‘এসএমজির ক্ষমতা হলো ৩০ রাউন্ড বুলেট একটা ম্যাগজিনে থাকে। আপনি চাইলে এক ট্রিগারে ৩০টা গুলি বের হবে, যেটাকে বলা হয় ব্রাশ ফায়ার। এসএমজির চেয়েও আরেকটু শক্তিশালী অস্ত্র হলো লাইট মেশিনগান।’

আর পুলিশ বলছে, এসব অস্ত্র কোন প্রেক্ষিতে ও কেন ব্যবহার করা হয়েছে তা নিয়ে চলছে তদন্ত। যার অপরাধী তারা কেউ ছাড় পাবেন না।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম শাখার উপ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ‘অস্ত্র ব্যবহারের পরে একটি ইনক্যুয়ারি হয়। যৌক্তিকতা প্রমাণ করা না গেলে অবশ্যই দোষীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

এদিকে ছাত্র-জনতার সেই আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যেসব সদস্য নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে দ্রুত বিচারের দাবি জানিয়েছেন নিহতের স্বজনেরা।

নিউজটি শেয়ার করুন

জুলাই-আগস্টের আন্দোলন দমনে ব্যবহার হয়েছিল যুদ্ধাস্ত্র

আপডেট সময় : ০৩:০৫:৫৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪

গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র জনতার আন্দোলন দমনে আইন অমান্য করে ব্যবহার করা হয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্রের অস্ত্র। এর মধ্যে আছে এসএমজি–এলএমজি থেকে শুরু করে বিডি-এইট অ্যাসল্ট রাইফেল। অভিযোগ রয়েছে স্নাইপার ব্যবহারেরও। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে রাবার বুলেট ছাড়াও শুধু ৪ দিনেই ছোড়া হয় ১৭ হাজারের বেশি গুলি, এর প্রায় সাড়ে ৪ হাজারই প্রাণঘাতী। পুলিশের করা মামলার নথি পর্যালোচনায় মিলেছে এসব তথ্য।

গণ আন্দোলনের সময় ভয়াবহ সংঘর্ষ হয় রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায়। সেখানে বিক্ষোভ দমনে প্রাণঘাতী অস্ত্র প্রয়োগ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

মামলার নথি বলছে, ১৮ থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত ৪ দিনে এসএমজি থেকে ১৭ রাউন্ড, চাইনিজ রাইফেল থেকে ছোড়া হয় ১ হাজার ৪৯৫ রাউন্ড গুলি। এছাড়া টরাস পিস্তল থেকে ৬৩, নাইন পয়েন্ট ওয়ান নাইন এমএম সিজে রাইফেল থেকেও ৭ রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়। আর এসব প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেন যাত্রাবাড়ী থানার শতাধিক পুলিশ সদস্য।

একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘ওই সময়ের মামলাগুলোতে পুলিশ বাদি সম্ভবত। পুলিশ যেহেতু বাদী হয়ে মামলা করেছে সুতরাং অসত্য তথ্য দেয়নি।’

থানাটির পুলিশ সদস্যের বেশির ভাগই ৫ আগস্টের পর বদলি হয়েছেন। তবে এখনও রয়ে গেছেন অনেকে। তাদেরই একজন এসআই বজলুর রশিদ।

রাবার বুলেট না মেরে এই ধরনের অস্ত্র ব্যবহারের কারণ জানতে চাওয়া হয়েছিল তার কাছে। তিনি বলেন, ‘এটা স্যারদের (ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ) সাথে কথা বলেন।’

২০ জুলাই, মোহাম্মদপুর। এখানেও ব্যবহার করা হয়েছে এসএমজি ও এলএমজি রাইফেল। এছাড়াও ছোড়া হয় এমএম ৭ দশমিক ৬২ ক্যালিবারের চায়না রাইফেলসহ নানা অস্ত্রের গুলি।

মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আলী ইফতেখার হাসান বলেন, ‘প্রত্যেককে ইনডিভিজ্যুয়ালি জবাবদিহি করতে হবে যে সে কেন আদেশটা পালন করেছে। এখানে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশেই মানুষ হত্যা করা হয়েছে যদি বলা হয়, তাহলে পার পাওয়ার আসলে কোনো সুযোগ নেই।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গত ১৮ জুলাই থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত এ চারদিনে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষ হয়েছে। এতে মারা যান অনেকে। তখন পুলিশ বাদী হয়ে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় মামলা করে, এ ধরনের শ’খানেক মামলা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পুলিশ ছাত্রজনতার উপর কি পরিমাণ প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেছে।

এসব অস্ত্র ছাড়াও ওই ৪ দিনে ছাত্র-জনতাকে ঠেকাতে ব্যবহার হয় স্পেশাল পারপাস অটোমেটিক শটগান, বিডি-এইট অ্যাসল্ট রাইফেল,প্রজেক্টাইল, মাল্টি ইম্প্যাক্ট, ভারী বল কার্তুজ ও হ্যান্ড গ্রেনেড। রাবার বুলেট বাদে ছোড়া হয় ১৭ হাজারের বেশি গুলি। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৪ হাজারই প্রাণঘাতী । এ সময় রাজধানীতে নিহত হন ৩৪১ আন্দোলনকারী।

মামলাগুলো পর্যালোচনা করে এক আইনজীবী বলছেন, লক্ষ্যস্থির করেই এসব গুলি ছুড়েছে পুলিশ।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আল নোমান বলেন, ‘এসএমজি, যেটা দিয়ে শত শত গুলি একসাথে বের হয়, এ ধরনের অস্ত্রের ব্যবহার কি প্রয়োজন ছিল? এ ধরনের আন্দোলন থামানোর জন্য আপনি তো টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করতে পারতেন। আপনি রাবার বুলেট ব্যবহার করতে পারতেন।’

এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একাত্তরের পর সাধারণের ওপর এসব অস্ত্র কখনোই ব্যবহার করেনি পুলিশ। ওগুলো ব্যবহৃত হয় শুধুমাত্র যুদ্ধক্ষেত্রে।

সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘কোনো মিছিল, বিক্ষোভ বা সমাবেশে এগুলোর ব্যবহার আমরা আগে কখনও দেখি নি। এই যে ১৫–১৬ বছরে ওরা (পুলিশ) ট্রিগার হ্যাপি হয়ে গেছে। আগের যে ড্রিল, সেগুলো ভুলে গেছে। যেভাবে অস্ত্র ব্যবহার করা দরকার ছিল, এটা ভুলে গেছে।’

অস্ত্র ও বোমা বিশেষজ্ঞ আব্দুল হক বলেন, ‘এসএমজির ক্ষমতা হলো ৩০ রাউন্ড বুলেট একটা ম্যাগজিনে থাকে। আপনি চাইলে এক ট্রিগারে ৩০টা গুলি বের হবে, যেটাকে বলা হয় ব্রাশ ফায়ার। এসএমজির চেয়েও আরেকটু শক্তিশালী অস্ত্র হলো লাইট মেশিনগান।’

আর পুলিশ বলছে, এসব অস্ত্র কোন প্রেক্ষিতে ও কেন ব্যবহার করা হয়েছে তা নিয়ে চলছে তদন্ত। যার অপরাধী তারা কেউ ছাড় পাবেন না।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম শাখার উপ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ‘অস্ত্র ব্যবহারের পরে একটি ইনক্যুয়ারি হয়। যৌক্তিকতা প্রমাণ করা না গেলে অবশ্যই দোষীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

এদিকে ছাত্র-জনতার সেই আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যেসব সদস্য নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে দ্রুত বিচারের দাবি জানিয়েছেন নিহতের স্বজনেরা।