শুধু কর্মক্ষেত্রেই বিভিন্ন দুর্ঘটনায় এক দশকে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার শ্রমিকের প্রাণহানি হয়েছে। আহত কয়েক হাজার। এদের বেশিরভাগই মালিক পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা বা ক্ষতিপূরণ পাননি। আর শ্রম আদালতে ঝুলে আছে প্রায় ২০ হাজার মামলা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রয়োজনীয় সংখ্যক আদালত, বিচারক নিয়োগ এবং সহায়ক জনবল সংকট দূর করা গেলে শ্রমিকরা তাদের অধিকার ফিরে পাবে। আর শ্রম উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলছেন, শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছে অন্তর্বর্তী সরকার।
মো. এমদাদুল হক, পেশায় ছিলেন রাজমিস্ত্রী। ২০১৯ সালে নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে গিয়ে পঙ্গু হয়ে যান। পাঁচবছর হয়ে গেলেও ভবন মালিক অথবা কন্সট্রাকশন কোম্পানি থেকে পায়নি কোন ক্ষতিপূরণ। আর শারীরিকভাবে অক্ষম এমদাদুলের পরিবারের নিয়তি শুধুই অনিশ্চয়তা।
মো. এমদাদুল বলেন, ‘হক জরিমানা বলতে আমি যে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছি সেটাও দিতে পারে নাই। আমার স্ত্রী বাড়ি থেকে ২০ হাজার টাকা ধার করে এনে ভর্তি করেছে।’
এদিকে, স্ত্রী নাজমা বেগম পুরো পরিবারের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। পঙ্গু স্বামীকে দেখাশোনা করা এবং একই সাথে নিজেই চাকরি করে সংসার চালাচ্ছেন। পাশাপাশি শ্রমিক দুর্ঘটনা মামলা নিয়ে আদলতের দৌঁড়-ঝাপ। হাঁপিয়ে উঠলেও সন্তান-স্বামীর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সব করে যাচ্ছেন দশভুজা নাজমা বেগম।
নাজমা বেগম বলেন, ‘এখন রোজকার করতে পারলে খাওয়া দাওয়া করতে পারবো নাহলে পারবো না। আমি যদি এখন বিছানায় পড়ে যায় তাহলে দেখার মতো কেউ নাই, সাহায্য করার মতো কেউ নাই।’
একই ঘটনা বাবুল বাবুরও। ছয় বছর আগে ইন্টারনেটের সংযোগ দিতে কোন ধরনের নিরাপত্তা ছাড়াই মালিক তাকে উঠিয়ে দেয় বহুতল ভবনে। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বর্তমানে পঙ্গু তিনি। আর এ ঘটনার পর পঙ্গু স্বামীকে ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে যান স্ত্রী। শ্রম আদালতে মামলা করলেও মালিকের পক্ষ থেকে পায়নি কোনো জরিমানা। মা, বড় ভাই আর তাদের সংসারে নিজেকেই বোঝা ভাবেন বাবুল।
বাবুল বাবু বলেন, ‘আমার মালিক মার হাতে ধরে বলতেছে আমি খুবই অসুবিধায় আছি এখন দিতে পারছি না টাকা। আমি এখন আসলে কোনো কিছু করতে পারতেছি না।’
এমদাদুল, বাবুলের মত এমন ঘটনা নিত্যদিনের। গবেষণা তথ্য বলছে, এবছর প্রথম ৬ মাসেই ৪২০টি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৪৭৫ শ্রমিক। আর আহত হাজার দুয়েকের বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারা গেছে কনস্ট্রাকশন, পরিবহন আর সেবা খাতে । ২০২৩ সালে একই সময়ে সারাদেশে ২৮৭ টি দুর্ঘটনায় ৩৮৯ জন শ্রমিক নিহত হয়েছিলেন।
আর বিগত বছর দেশে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৮৭৫ জন শ্রমিক নিহত হয়। হিসাব বলছে, গত ১০ বছরে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার শ্রমিক নিহত হয়েছেন। আর এই সময়ে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪ হাজার ৭১টি।
সেইফটি এন্ড রাইটসের নির্বাহী পরিচালক সেকান্দার আলি মিনা বলেন, ‘একজন শ্রমিক নিহত হলে মালিককে যে যে শাস্তি দেয়া হতো তা যদি সবগুলো সঠিকভাবে দেয়া যেত তাহলে মালিক ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকতো।’
শ্রম মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশের ১৩টি শ্রম আদালতে ২০ হাজারের বেশি মামলা বিচারাধীন। শ্রমিকদের অধিকার ও আইন নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট। সংস্থাটির মতে, প্রয়োজনীয় সংখ্যক আদালত, বিচারক ও সহায়ক জনবল সংকটের অভাবে বছরের পর বছর ধরে এসব মামলা ঝুলে রয়েছে। এছাড়াও প্রাথমিক মামলা করার ক্ষেত্রে নিকটস্থ আদালতে মামলা করারও পরামর্শ দেন সংস্থাটি।
ব্লাস্টের পরিচালক বরকত আলী বলেন, ‘মালিকপক্ষ যদি দুর্ঘটনা বিষয়ে শ্রম আদালতকে জানায় ক্ষতিপূরণ দেবার বিষয়ে ও ক্ষতিপূরণ যদি ডিপোজিট করে তাহলে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হতে পারে।’
এদিকে অভিযোগ আছে, কর্মক্ষেত্রের দুর্ঘটনায় যেসকল মামলা হয়ে থাকে সেগুলোতে সরকার মালিকপক্ষের স্বার্থই বেশি দেখে থাকে। এমন অভিযোগ অস্বীকার করেনি শ্রম উপদেষ্টাও। শ্রম আদালতসহ অন্যান্য সংস্থাগুলোকে জবাবদিহিতায় আনা হবে বলেও আশ্বাস দেন তিনি।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া বলেন, ‘শ্রম আদালতসহ আরো যে দপ্তর রয়েছে সেগুলো কীভাবে সক্রিয় করা যায় তা নিয়ে আমরা কাজ করছি।’
এছাড়াও মালিককে কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাকে দায় নয় বিনিয়োগ মনে করতে হবে বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।