সরকারি হিসেবে গণঅভ্যুত্থানে নিহত শিশুর সংখ্যা শতাধিক। চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে অনেকেই। গণঅভ্যুত্থানে আহত অনেক শিশুর জীবন হয়ে পড়েছে অনিশ্চিত। বেঁচেও যেন নির্জীব হয়ে আছেন তারা। প্রতিনিয়ত জীবনের সাথে লড়াই করছেন সেসব শিশু কিশোর।
বুক কেঁপে আসা চিৎকার যখন গিলে ফেলতে হয়। যখন অনাকাঙ্খিত বলে চেপে যেতে হয়। বোবা কান্না আর দাঁত চেপে কাতরানো ছাড়া উপায় কি? কতইবা বা আর বয়স। মাধ্যমিকের গন্ডি টপকানো হয়নি এখনও। এর মধ্যে কেউ চিরতরে হারিয়েছে পা, কেউ চোখ। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর বয়সে ভরসা হয়েছে ওয়াকিং স্টিক।
আশুলিয়ায় ঘাতকের গুলিতে মেরুদন্ড ভেঙেছে নবম শ্রেনীর হাবিবুরের। চিরতরে হারিয়েছে বাম পা। কবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে জানে না এ কিশোর।
হাবিবুর বলেন, 'আমার রাত করে বেশি ব্যাথা হয়। সবসময়ই ব্যাথা করে, তবে রাতে বেশি। ওইদিন কাউরে দেখাদেখি নেই, সমানে গুলি করছিল। মেরুদন্ডের অপারেশন করছে, গুলি লেগে গুড়া গুড়া হয়ে গেছিলো। এখন ওখানে পাইপ লাগিয়ে দিয়েছে।' এইসএসসি পরীক্ষা চলাকালে আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয় ১৭ বছরের বাদশা। জুলাই অভ্যুত্থানে হারিয়েছে সহপাঠীদের।
বাদশা বলেন, 'আমার সাথে আমার বন্ধু ছিল। ওরা মারা গেছে, ওদের বাঁচাতে গিয়ে আমার পায়ে গুলি লেগেছে। আমাদের দেশ আরও সুন্দর হোক এটাই আমরা চাই। আমরা চাই না আগের স্বৈরাচারের মতো আবার দেশ গঠিত হোক, আবার সবাই আতঙ্কের মধ্যে পড়ুক। চাই সবাই সুস্ধ-সবল থাকুক। সবাই একসাথে চলাচল করুক।'
নরসিংদীর শিশু সালমান তো এখনও শরীরে ছররা গুলি বয়ে বেড়াচ্ছে। অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে শিক্ষাজীবন।
সালমান বলেন, 'মাথায় পাঁচটা গুলি লাগছে মোট। এর মধ্যে দুইটা বের করছে, এখনও তিনটা আছে। অনেক ব্যাথা করে।'
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, জুলাই ও আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শিশু মারা গেছে ১০৫ জন।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেন, '১০৫ জন শিশু শহীদ হয়েছে। তাদের পরিবারকে আমরা ৫০ হাজার করে টাকা দেবো।'
আর স্বাস্থ্য বিষয়ক কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির তথ্য বলছে, চিরতরে পঙ্গু হয়েছেন শতকের কাছাকাছি।
স্বাস্থ্য বিষয়ক কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সদস্য ড. আতাউর রহমান রাজিব বলেন, 'আমাদের কাছে আসা তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত ৭৮ থেকে ১০০ জনের হাত, পা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকের চোখের ক্ষতি হয়েছে।'
বিশ্লেষকদের মতে, নিজের দেশের শিশু কিশোরদের নির্বিচারে এমন হত্যার ইতিহাস পৃথিবীতে বিরল। যার বিচার হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, 'আভ্যন্তরীণ যে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ১ হাজার ৭০০ বা ১ হাজার ৮০০ মানুষকে মেরে ফেলা, এটা কিন্তু বিশ্বের ইতিহাসে হয়নি। অতএব আমাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এটা অ্যাড্রেস করবেন। এবং আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যথাযথভাবে আইনগত পদক্ষেপ নিবেন এবং বিচার সাধন করবেন।
মধ্যবয়সীদের থেকে শুরু করে জুলাই অভ্যুত্থানে জীবন দেয়া হাজারো ছাত্র-জনতা কিংবা শিশু হাবিবুর, সালমানতের মধ্যে বয়সের পার্থক্য থাকলেও গণঅভ্যুত্থানে তাদের লক্ষ্য ছিল অভিন্ন। তাদের আত্মত্যাগ এবং অভিন্ন লক্ষ্যকে সামনে রেখেই বিনির্মাণ হোক নতুন বাংলাদেশ।