একবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই লাল পোস্টবক্স থেকে কমতে থাকে চিঠি। তারপর ল্যান্ডফোনের হাত ধরে মুঠোফোন, এসএমএস, ই-মেইল কিংবা স্যোশাল মিডিয়ার জয়জয়কারে ডাকঘরের সঙ্গে ক্রমশ বাড়তে থাকে দূরত্ব। বর্তমানে হাত বাড়ালেই যোগাযোগের শত মাধ্যম আর যান্ত্রিক জীবনের ব্যস্ততার আড়ালে ঢাকা পড়ছে সাদা কাগজের উপর বাহারিকালিতে লেখা হৃদয়ের অনুভূতি।
প্রিয়জনের পাঠানো হলুদ খামের অপেক্ষায় থাকেনি এমন মানুষ পাওয়া কঠিন। মুঠোফোন আর ইন্টারনেটের যুগে হলুদ খামে রঙিন চিঠি কমলেও সে স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান অনেকে। আর সেই আবেগকে পুঁজি করে ডাক বিভাগের আধুনিকায়নের নামে করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় সম্পদের হরিলুট। সাড়ে ৫শ’ কোটি টাকায় প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে পোস্ট অফিসগুলোকে ই-পোস্ট সেন্টারে রূপান্তর করার কথা থাকলেও উত্তরাঞ্চলে হয়নি প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন। বরং হরিলুট হয়েছে বিগত সরকারের আমলের বরাদ্দ বেশিরভাগ অর্থ।
পাখির পায়ে চিঠি বেঁধে প্রেম কিংবা প্রণয়ের বার্তা বহনের প্রচলন ছিল। এরপর কালের বদলে সেই আবেগের প্রতিফলন হলুদ খামের প্রতিটি ভাঁজে। এ শতাব্দীর শুরুতেও প্রেরক আর প্রাপকের চিঠি আদান প্রদানের সে জৌলুস কেবল যোগাযোগের মাধ্যমই ছিল না, সেখানে মিশেছিল আনন্দ-বেদনার সহস্র উপাখ্যান।
গ্রামীণ মেঠোপথ ধরে শব্দের ঝড় তুলে ছুটছে রানার- খুঁজতে থাকে প্রাপকের ঠিকানা, ওদিকে চিঠির জন্য আকুলতা নিয়ে অপেক্ষায় প্রাপক। অতীতের এমন স্মৃতি নিয়ে উত্তেজনায় বুধ হয়ে থাকা প্রজন্মের সংখ্যা, এ যুগেও নেহায়েত কম নয়।
তবে ঠিকানা হারানো ডাকঘরকে নিজস্ব স্বকীয়তা ফেরাতে বিগত কর্তৃত্ববাদী সরকার নিয়েছিল বেশ কয়েকটি উদ্যোগ। তার একটি, গ্রাম পর্যায়ে ডিজিটাল সেবা দিতে ডাকবিভাগের পোস্ট ই-সেন্টার ফর রুরাল কমিউনিটি নামে একটি প্রকল্প যা শুরু হয় ২০১২ সালে। প্রকল্পের আওতায় সারাদেশে সাড়ে ৮ হাজার ডাকঘরকে প্রায় ৫৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে আধুনিকায়নের কথা বলা হয়।
রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলা। তথাকথিত আধুনিক ও ডিজিটাল ই পোস্ট সেন্টারের একটি এটি। বাইরে সাইনবোর্ডে লেখা সেবার ফর্দ ধরে ভেতরে পা দিতেই চক্ষু চড়কগাছ। কাগজে কলমে এখানে তিনটি ল্যাপটপ, ওয়েবক্যাম, স্কানার, প্রিন্টারসহ ১১ ধরনের ডিজিটাল ডিভাইস থাকার কথা, কিন্তু সেসবের কিছুই নেই। আছে কেবল একটি চেয়ার ও টেবিল।
স্থানীয়দের মধ্যে আরও একজন জানান, ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছি, টুইটারে আলোচনা করছি কিন্তু ভিতরে যে আবেগ ছিল এটা কোথায় যেন হারায় গেছে।
একটি দু'টি নয়, রংপুর জেলাজুড়ে এমন ই-পোস্ট সেন্টার আছে ৭৫টি। শহরের অদূরে বুড়ির হাটে তালাবদ্ধ এ কক্ষটিই নাকি ডিজিটাল পোস্ট অফিস।
স্থানীয়রা জানালেন, এখানেও নেই কোনো ধরনের ডিজিটাল ডিভাইস। অথচ ডাক বিভাগের তালিকায় এটিও ই পোস্ট সেন্টার। ডাকবিভাগের তালিকায় ধরে পাশেই খোঁজ মিললো আরেক পোস্ট অফিসের। সেখানকার চিত্রও অভিন্ন। স্থানীয়দের ভাষ্য, ভেতরে কেবলই চেয়ার টেবিল ছাড়া অস্তিত্ব নেই কোনো ডিজিটাল ডিভাইসের। জেলার বেশিরভাগ এমন ডিজিটাল সেন্টার সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা মেলেনি সিংহভাগ দায়িত্বরত কর্মকর্তা কিংবা কোনো কর্মচারীর।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে স্বপ্ন পুঁজি করে গ্রামে গ্রামে ইন্টারনেট সেবা সহজের নামে এমন লুটপাটের চিত্র ডাক বিভাগের প্রতিটি ই-সেন্টারে। রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচালন, প্রশিক্ষণের জন্য একজন উদ্যোক্তা নিয়োগ দেয়া হয়- কিন্তু প্রায় সব সেন্টারেই এ পদ বাগিয়েছেন পোস্ট মাস্টারের পরিবারের সদস্য কিংবা নিকটাত্মীয়রা। খোঁজ নিয়ে জানা যায় প্রতিটি ই সেন্টারে প্রকল্পের প্রায় ১০ টাকা সমমূল্যের মালামাল সংশ্লিষ্ট পোস্ট অফিসের কর্তাদের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার হচ্ছে। এমন বাস্তবতায় বিভাগীয় কর্তৃপক্ষ সংকট সমাধানে কতটা আন্তরিক!
রংপুরের ডেপুটি পোস্টমাস্টার জেনারেল ইসরাত জাহান নূর বলেন, 'আগে রংপুর প্রধান ডাহঘরে ছিলাম। সেখানে ১৩ টা ই-সেন্টার ছিল। এবং সবাই যে টপ লেভেলের কাজ করে বিষয়টা এমন না। কিন্তু কিছু কিছু বেশ ভালো কাজ করে।'
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেবার মান বাড়িয়ে ডাকবিভাগকে বানানো যেতো সরকারের আয়ের অন্যতম বড় উৎস। তবে সে চেষ্টার মোড়কে বিগত সরকারের খাত সংশ্লিষ্টদের লুটপাটের সমালোচনাও করেন তারা।
বেরোবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ বিভাগীয় প্রধান তাবিউর রহমান বলেন, 'যে সরকারই ক্ষমতায় থাক না কেন এই প্রতিষ্ঠানকে যদি প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে আরও আধুনিক করে তোলে তাহলে হয়তো অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা বেশি হবে।'
এদিকে গেল সরকারের আমলে দুটি প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৯০০ কোটি টাকা ব্যয়ের এসব প্রকল্পের এমন জীর্ণদশায় হতবাক স্থানীয়রা। তাদের দাবি, জনগণের টাকায় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এমন হরিলুটের বিচার হোক, যেটি দৃষ্টান্ত হবে অনাগত নেতৃত্বের জন্য।