ঢাকা ০৯:৫৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

চিকিৎসাখাতে প্রতিবছর দেশের হাতছাড়া ৪৮ হাজার কোটি টাকা

অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট সময় : ০১:২৪:২৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ৪ নভেম্বর ২০২৪
  • / ৩৪৫ বার পড়া হয়েছে
৭১ নিউজ বিডির সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

প্রতিবছর বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান প্রায় ২৭ লাখ ১০ হাজার বাংলাদেশি। যাদের এ খাতে ব্যয় হয় অন্তত ৪৮ হাজার কোটি টাকা। রোগীদের এমন তীব্র চাপ সামাল দিতে বিদেশি কয়েকটি হাসপাতাল ঢাকায় তাদের দপ্তর খুলেছে। যারা রোগী ভাগিয়ে নিতে এজেন্সি হয়ে কাজ করেন। তাদের সহযোগিতা করছেন দেশে অবস্থান করা অবৈধ একদল চিকিৎসক। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায়।

বাংলাদেশ থেকে বিদেশে চিকিৎসার বেশিরভাগের গন্তব্য ভারতে। দেশটিতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে মেডিকেল ভিসা দেয়া হয়েছিল ৩ লাখ ৪ হাজার ৬৭ বাংলাদেশিকে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভিসা দেয়ার হার বেড়েছে প্রায় ৪৭.৯ শতাংশ। কলকাতার নিউমার্কেট, মুকুন্দপুর অঞ্চলের বেসরকারি হাসপাতালেই বেশি ভিড় করেন বাংলাদেশিরা।

চিকিৎসা নিতে যাওয়া একজন বাংলাদেশি বলেন, ‘আমরা যেন ভালো চিকিৎসা পাই সেজন্য আমরা এখানে এসেছি। আর এখানে খরচও কম পড়ে।’

রোগীদের চাপ বেশি থাকায় ভারত, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের কয়েকটি হাসপাতাল তাদের দপ্তর খুলেছেন ঢাকায়। যারা মূলত কমিশনের বিনিময়ে রোগীদের বিদেশে পাঠাতে এজেন্সির হয়ে কাজ করে। এছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে বিদেশি বহু চিকিৎসকের সেবার মান নিয়ে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের প্রতিবেশি দেশসহ একাধিক দেশের একটি শক্তিশালী মার্কেটিং নেটওয়ার্ক ক্রিয়াশীল রয়েছে। অধিকাংশই যারা ভারতে চিকিৎসক হিসেবে তেমন ভালো করেনি। বিদেশ থেকে আনা হচ্ছে, তাদের পক্ষে প্রচুর প্রচার, প্রপাগান্ডা করে মানুষকে ভুল তথ্য দেয়া হচ্ছে। এবং চিকিৎসা নেয়া হচ্ছে।’

বিদেশি হাসপাতালগুলো অতিরিক্ত মুনাফার আশায় রোগীদের সঙ্গে প্রতারণায় আশ্রয় নিয়ে থাকে বলেও অভিযোগ এ চিকিৎসকের।

ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘ভারতে চিকিৎসা করালে বাংলাদেশের সমস্ত পরীক্ষা যে ভুল বা ভুয়া সেটা প্রথমেই বলে। দ্বিতীয়ত এটা কী চিকিৎসা দিয়েছে এটা তো কোনো চিকিৎসা না। এজাতীয় নেতিবাচক মন্তব্য করে। পরে দেশে আসার পর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মিলিয়ে দেখা যায় যে ওষুধটি বাংলাদেশের ডাক্তার দিয়েছিল, সেই গোত্রের সেই ধরনের ওষুধই কিন্তু অন্য কোনো নামে ভারত থেকে দেয়া হচ্ছে।’

জটিল রোগ নির্ণয়ে দেশে বিশেষায়িত হাসপাতাল থাকলেও সেবার পরিধি অজানা অনেকের। এমন না জেনেই বহু রোগী দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন প্রতিবছর।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘আমাদের দেশে কী ধরনের চিকিৎসা পাওয়া যায় এটা মানুষকে ঠিকমতো জানানোও হয় না। নিটোরে বা এনআইএইচ এ কী কী ধরনের চিকিৎসা করা যায়, কী কী অপারেশন করা হয় এটা মানুষকে জানানোই হয় না। এনআইএইচ এ কী কী চক্ষু চিকিৎসা দেয়া হয় তা না জেনেই চোখের একটা সমস্যা হইলেই ভারতের চেন্নাইয়ে চলে যায়।’

দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে বিপুল ব্যয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ওপর আস্থার সংকট তৈরি করছে। যার পরিবর্তনে স্বাস্থ্যসেবার আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ।

তিনি বলেন, ‘আমাকে একটা হাসপাতালের সাথে রেফারেল গড়ে তুলতে হবে। তখন কী হবে? তখন আসলে যেটা হবে, এই রেফারেল হাসপাতাল চেইন গড়ে উঠবে। ছোট ছোট হাসপাতাল থাকবে না। হেলথ সার্ভিসটাকে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস থেকে বের করে যেরকম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন হয়েছে সেরকম একটা বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস কমিশন করা দরকার।’

দেশে চিকিৎসা প্রাপ্তিতে আস্থার ঘাটতি রয়েছে। হাসপাতালে এলেই যেন পড়তে হয় ভোগান্তিতে। এজন্য রোগীর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নতির প্রয়োজন চিকিৎসকদেরও।

ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ বিভাগের অধ্যাপক ডা. খোরশেদ আলী মিয়া বলেন, ‘সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরও রোগী আমার জন্য বদদোয়া করে যে আমার পকেটটা কেটে একদম শেষ করে দিলো। আমার গরুটা বিক্রি হয়ে গেলো। আমরা যদি এই মিউচুয়াল রেসপেক্টের জায়গাটা ফিরিয়ে আনতে পারি তাহলে রোগীরা কম সুস্থ হয়েও জ্বর নিয়ে বাড়ি ফিরেও দোয়া করবে।’

বেসরকারি হাসপাতালের খরচ বহনে অসমর্থ রোগীদের শেষ ভরসা সরকারি হাসপাতাল। অথচ সেখানেই সেবার মানে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেসরকারি হাসপাতালগুলো খরুচে হলেও সেবার তুলনায় মনোযোগ বেশি বাণিজ্যিকীকরণেই। যে কারণে ব্যক্তিখাতে চিকিৎসার খরচ বেশি থাকা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়।

নিউজটি শেয়ার করুন

চিকিৎসাখাতে প্রতিবছর দেশের হাতছাড়া ৪৮ হাজার কোটি টাকা

আপডেট সময় : ০১:২৪:২৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ৪ নভেম্বর ২০২৪

প্রতিবছর বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান প্রায় ২৭ লাখ ১০ হাজার বাংলাদেশি। যাদের এ খাতে ব্যয় হয় অন্তত ৪৮ হাজার কোটি টাকা। রোগীদের এমন তীব্র চাপ সামাল দিতে বিদেশি কয়েকটি হাসপাতাল ঢাকায় তাদের দপ্তর খুলেছে। যারা রোগী ভাগিয়ে নিতে এজেন্সি হয়ে কাজ করেন। তাদের সহযোগিতা করছেন দেশে অবস্থান করা অবৈধ একদল চিকিৎসক। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায়।

বাংলাদেশ থেকে বিদেশে চিকিৎসার বেশিরভাগের গন্তব্য ভারতে। দেশটিতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে মেডিকেল ভিসা দেয়া হয়েছিল ৩ লাখ ৪ হাজার ৬৭ বাংলাদেশিকে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভিসা দেয়ার হার বেড়েছে প্রায় ৪৭.৯ শতাংশ। কলকাতার নিউমার্কেট, মুকুন্দপুর অঞ্চলের বেসরকারি হাসপাতালেই বেশি ভিড় করেন বাংলাদেশিরা।

চিকিৎসা নিতে যাওয়া একজন বাংলাদেশি বলেন, ‘আমরা যেন ভালো চিকিৎসা পাই সেজন্য আমরা এখানে এসেছি। আর এখানে খরচও কম পড়ে।’

রোগীদের চাপ বেশি থাকায় ভারত, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের কয়েকটি হাসপাতাল তাদের দপ্তর খুলেছেন ঢাকায়। যারা মূলত কমিশনের বিনিময়ে রোগীদের বিদেশে পাঠাতে এজেন্সির হয়ে কাজ করে। এছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে বিদেশি বহু চিকিৎসকের সেবার মান নিয়ে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের প্রতিবেশি দেশসহ একাধিক দেশের একটি শক্তিশালী মার্কেটিং নেটওয়ার্ক ক্রিয়াশীল রয়েছে। অধিকাংশই যারা ভারতে চিকিৎসক হিসেবে তেমন ভালো করেনি। বিদেশ থেকে আনা হচ্ছে, তাদের পক্ষে প্রচুর প্রচার, প্রপাগান্ডা করে মানুষকে ভুল তথ্য দেয়া হচ্ছে। এবং চিকিৎসা নেয়া হচ্ছে।’

বিদেশি হাসপাতালগুলো অতিরিক্ত মুনাফার আশায় রোগীদের সঙ্গে প্রতারণায় আশ্রয় নিয়ে থাকে বলেও অভিযোগ এ চিকিৎসকের।

ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘ভারতে চিকিৎসা করালে বাংলাদেশের সমস্ত পরীক্ষা যে ভুল বা ভুয়া সেটা প্রথমেই বলে। দ্বিতীয়ত এটা কী চিকিৎসা দিয়েছে এটা তো কোনো চিকিৎসা না। এজাতীয় নেতিবাচক মন্তব্য করে। পরে দেশে আসার পর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মিলিয়ে দেখা যায় যে ওষুধটি বাংলাদেশের ডাক্তার দিয়েছিল, সেই গোত্রের সেই ধরনের ওষুধই কিন্তু অন্য কোনো নামে ভারত থেকে দেয়া হচ্ছে।’

জটিল রোগ নির্ণয়ে দেশে বিশেষায়িত হাসপাতাল থাকলেও সেবার পরিধি অজানা অনেকের। এমন না জেনেই বহু রোগী দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন প্রতিবছর।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘আমাদের দেশে কী ধরনের চিকিৎসা পাওয়া যায় এটা মানুষকে ঠিকমতো জানানোও হয় না। নিটোরে বা এনআইএইচ এ কী কী ধরনের চিকিৎসা করা যায়, কী কী অপারেশন করা হয় এটা মানুষকে জানানোই হয় না। এনআইএইচ এ কী কী চক্ষু চিকিৎসা দেয়া হয় তা না জেনেই চোখের একটা সমস্যা হইলেই ভারতের চেন্নাইয়ে চলে যায়।’

দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে বিপুল ব্যয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ওপর আস্থার সংকট তৈরি করছে। যার পরিবর্তনে স্বাস্থ্যসেবার আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ।

তিনি বলেন, ‘আমাকে একটা হাসপাতালের সাথে রেফারেল গড়ে তুলতে হবে। তখন কী হবে? তখন আসলে যেটা হবে, এই রেফারেল হাসপাতাল চেইন গড়ে উঠবে। ছোট ছোট হাসপাতাল থাকবে না। হেলথ সার্ভিসটাকে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস থেকে বের করে যেরকম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন হয়েছে সেরকম একটা বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস কমিশন করা দরকার।’

দেশে চিকিৎসা প্রাপ্তিতে আস্থার ঘাটতি রয়েছে। হাসপাতালে এলেই যেন পড়তে হয় ভোগান্তিতে। এজন্য রোগীর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নতির প্রয়োজন চিকিৎসকদেরও।

ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ বিভাগের অধ্যাপক ডা. খোরশেদ আলী মিয়া বলেন, ‘সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরও রোগী আমার জন্য বদদোয়া করে যে আমার পকেটটা কেটে একদম শেষ করে দিলো। আমার গরুটা বিক্রি হয়ে গেলো। আমরা যদি এই মিউচুয়াল রেসপেক্টের জায়গাটা ফিরিয়ে আনতে পারি তাহলে রোগীরা কম সুস্থ হয়েও জ্বর নিয়ে বাড়ি ফিরেও দোয়া করবে।’

বেসরকারি হাসপাতালের খরচ বহনে অসমর্থ রোগীদের শেষ ভরসা সরকারি হাসপাতাল। অথচ সেখানেই সেবার মানে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেসরকারি হাসপাতালগুলো খরুচে হলেও সেবার তুলনায় মনোযোগ বেশি বাণিজ্যিকীকরণেই। যে কারণে ব্যক্তিখাতে চিকিৎসার খরচ বেশি থাকা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়।