ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার গত ৮ আগস্ট শপথ নেয়। তিন মাস পেরোলেও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো প্রত্যাহার বা নিষ্পত্তির কার্যক্রম অত্যন্ত ধীরগতিতে চলছে। এতে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা দেখা দিয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দায়ের করা প্রায় দেড় লাখ মামলা নিয়ে বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে, এসব মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা। কিছু মামলার নিষ্পত্তি হলেও অধিকাংশ মামলার কারণে নেতাকর্মীরা এখনও আদালতের দোরগোড়ায় ঘুরছেন। আগের মতো গ্রেপ্তার আতঙ্ক না থাকলেও মামলার ভাগ্য নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তারা। বিশেষ করে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের মামলা দ্রুত প্রত্যাহার বা নিষ্পত্তির দাবিতে বিএনপি তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত এক ধরনের চাপ অনুভব করছে। বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
গত ২২ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারে জেলা ও মন্ত্রণালয় পর্যায়ে দুই স্তরের কমিটি গঠন করে। তবে বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, এসব কমিটি বাস্তবায়নে কার্যকর কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। রাজনৈতিক হয়রানি মামলা প্রত্যাহারের জন্য আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদন করতে হবে। তবে বিএনপিপন্থি আইনজীবী ও নেতারা বলছে, মামলা প্রত্যাহারের কার্যকরী তেমন কোনো উদ্যোগ দেখছেন না তারা।
এর মধ্যে খালেদা জিয়ার ৩৭টি মামলার মধ্যে কিছু নিষ্পত্তি হলেও গুরুত্বপূর্ণ মামলা এখনও ঝুলে আছে। একইভাবে, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ৮২টির বেশি মামলা রয়েছে, যার অধিকাংশ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দায়ের করা বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি নেতারা।
এসব বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা দেখছি কী হয়। তারপর আমরা আমাদের ব্যবস্থা নেব। বাংলাদেশের মানুষ এত নির্যাতনের পরেও যাদের (বিএনপি নেতাকর্মী) সবচেয়ে বেশি অবদান তাদের বিরুদ্ধে মামলার বিষয় নিয়ে আলোচনার বিষয় হতে পারে, এটা তো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। যারা শেখ হাসিনার পতনের জন্য ১৫ বছর লড়ে সবকিছু ত্যাগ করে আজকের এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, তাদের মামলা এখনো যায়নি (নিষ্পতি) কেন? এটা স্বাভাবিকভাবে সবারই প্রশ্ন। সুতরাং এ বিষয়ে ব্যবস্থা যদি শিগগিরই করা না হয়, তাহলে যারা শেখ হাসিনার পতন ঘটিয়েছে তারা তো আর বসে থাকবে না।’
বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ফ্যাসিস্ট সরকার তার রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে অসংখ্য মামলা দায়ের করেছিল। প্রত্যেকটা মামলাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। আমরা পত্রিকায় দেখেছি সরকার বিভিন্ন রাজনৈতিক মামলাগুলো প্রত্যাহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো উদ্যোগ আমরা দেখছি না। আমরা আইনগতভাবে প্রত্যেকটা পদক্ষেপই নিচ্ছি। তারেক রহমানের নির্দেশনা হচ্ছে তিনি দেশের প্রচলিত আইন, সংবিধান, সিআরপিসির প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আইনিভাবেই তিনি তার মামলাগুলো মোকাবিলা করবেন এবং আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তিনি তার মামলার ফয়সালা চান। তবে যদি রাষ্ট্র কখনো মনে করেন যে, তারেক রহমানের মামলাগুলো উঠানো উচিত, সে ক্ষেত্রে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান চান তার রাজনৈতিক কর্মীদের সর্বশেষ মামলাটাও যেন তার আগে প্রত্যাহার হয়। একজন রাজনীতিবিদ হিসাবে ওনার বক্তব্য-কোনোক্রমেই ওনার মামলা নিয়ে এই অবস্থায় কোনো ধরনের প্রত্যাহারের আলোচনা হোক-সেটি তিনি চান না।
তারেক রহমান কবে নাগাদ দেশে আসতে পারেন- এমন প্রশ্নের জবাবে কায়সার কামাল বলেন, ‘উনি (তারেক রহমান) বাংলাদেশের নাগরিক। এক-এগারোর সময় তৎকালীন সরকার, আর্মি কেয়ারটেকার সরকার ওনাকে কাস্টোডিয়াল টর্চার করেন। যে টর্চারের কারণে তিনি বিদেশে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ওনার দেশে আসাটা একান্তই ওনার পারিপার্শ্বিক সবকিছু বিবেচনা করে, চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেবেন। আমি মনে করি মামলার বিষয়গুলো ওনার আসা না আসার সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ত নেই। তবে যেহেতু উনি আসবেন, দেশের মানুষ প্রত্যাশা করছে যে, উনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশে আসুক। কারণ বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট যদি চিন্তা করেন তাহলে তারেক রহমানের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের মাঠে দরকার। দেশে আসার ব্যাপারে তিনি যথাসময়ে চিন্তাভাবনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন।
নেতারা আরও জানান, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম অনেকটা ধীরগতির। এতে নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তাদের। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, বিগত ১৭ বছরে বিএনপিসহ বিভিন্ন বিরোধী দল ও মতের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও হয়রানিমূলক মামলার বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত নিতেই অনেক সময়ক্ষেপণ হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানের দেড় মাস পর বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারে জেলা ও মন্ত্রণালয় পর্যায়ে দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এসব কমিটি জেলা ও মহানগর পর্যায়ে মামলার তথ্য সংগ্রহ করবে। এর পর আইন মন্ত্রণালয় সেসব মামলা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। আন্দোলনের ফসল হিসাবে সবাই স্বাধীনতা পেলেও বিএনপি নেতাকর্মীরা এর ব্যতিক্রম। মামলার ফাঁদে আটকে পড়ে আছেন তারা। বিএনপির কেন্দ্রীয় সহস্বেচ্ছাসেবকবিষয়ক সম্পাদক আব্দুল কাদির ভুঁইয়া জুয়েল বলেন, তার বিরুদ্ধে এখনো ১৬০টি মামলা রয়েছে, এর মধ্যে ৫টি মামলায় সাজা দেওয়া হয়েছে। সবগুলো মিথ্যা ও গায়েবি মামলা, যার কোনো ভিত্তি নেই। এখনো আদালতের বারান্দায় প্রায় প্রতিদিনই ঘুরতে হচ্ছে, যা দুঃখজনক। আইনজীবী ও বিএনপির দপ্তর সূত্র জানায়, ২০০৯ সালের পর গত ৫ জুলাই পর্যন্ত সারা দেশে নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ১ লাখ ৪২ হাজার ৯৮৩ মামলায় ৫৯ লাখ ২৯ হাজার ৪৯২ জনকে আসামি করা হয়েছে। শুধু গত বছরের ২৮ অক্টোবর থেকে তিন মাসের মধ্যে সারা দেশে ১ হাজার ৬৪৫ মামলায় প্রায় ৭০ হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছিল। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীকে পাইকারি গ্রেফতারের পাশাপাশি গণহারে মামলার সাজা দেওয়া শুরু হয়। ওই সময় প্রায় দুই হাজার নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন ঢাকার বিভিন্ন আদালত। বিএনপি ও আইনজীবীদের দেওয়া তথ্যমতে, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে এখনো অন্তত ৯০টি মামলা চলমান রয়েছে। স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের নামে প্রায় ৫০টি, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে প্রায় ৪০টি, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ৫০টি মামলা রয়েছে। চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের বিরুদ্ধে ৩৫৭টি, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভীর বিরুদ্ধে ১৮০টির বেশি, যুগ্ম মহাসচিব হাবিবুন নবী খান সোহেলের বিরুদ্ধে ৪ শতাধিক, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানির ৬০টি মামলা রয়েছে। প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাহউদ্দিন টুকুর ৩১৫টি, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক রফিকুল আলম মজনুর ২২৬টি, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহসানের বিরুদ্ধে রয়েছে ২১২টি মামলা। একইচিত্র বিএনপির কেন্দ্রীয় ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন ও জেলাসহ তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদেরও।
খালেদা জিয়ার মামলা : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৭টি মামলা হয়েছে। এসব মামলা তৎকালীন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক ও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। ২০০৭-২০০৮ সালের জরুরি অবস্থায় ৪টি মামলা হলেও বাকিগুলো পরবর্তী সরকারের আমলে। সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ২০১৫ সালে। এর মধ্যে জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলার রায়ে সাজা হয়েছিল খালেদা জিয়ার, যা ৬ আগস্ট দণ্ড মওকুফ করা হয়েছে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর এখন পর্যন্ত ২১টি মামলা আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খালাস পান। এখনো ১৬ মামলা রয়েছে। এর মধ্যে নাইকো দুর্নীতি মামলা চলমান, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি মামলার আদেশের জন্য দিন ধার্য রয়েছে। আরও রয়েছে-ঋণখেলাপির একটি মামলা, গুলশানে বোমা হামলার অভিযোগে মামলা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও জাতিগত বিভেদ সৃষ্টির অভিযোগে ২ মামলা, ‘মিথ্যা’ জন্মদিন পালনের মামলা বর্তমানে পেন্ডিং রয়েছে। এছাড়া ঢাকাসহ খুলনা, পঞ্চগড় ও কুমিল্লায় এখনো ৭টি মামলা।
তারেক রহমানের মামলা : বিএনপি ও আইনজীবীদের দেওয়া তথ্যমতে, দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে গত ১৭ বছরে ঢাকাসহ সারা দেশে ৮২টির বেশি মামলা হয়েছে। তবে মামলার পরিসংখ্যান যাচাই করা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে এক-এগারো সরকারের সময়ে ১৭টি। যার অধিকাংশ মামলা উচ্চ আদালত কর্তৃক স্থগিত আছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার পর তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং, রাষ্ট্রদ্রোহ ও মানহানির অভিযোগে ৬৫টির বেশি মামলা হয়। ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর এ পর্যন্ত আইনি প্রক্রিয়ায় ১২টি মামলা খালাস ও প্রত্যাহারের তথ্য পেয়েছে যুগান্তর। এছাড়া একটি মামলা বাদী তুলে নিয়েছেন। এর মধ্যে চারটি মামলায় সাজা দেওয়া হয়। যার মধ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অভিযোগে মামলাটি আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা পেন্ডিং অবস্থায় রয়েছে। বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের অভিযোগ, এসব মামলা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তারেক রহমানের নাম ছিল না, আওয়ামী লীগ সরকার ষড়যন্ত্র করে তার নাম দিয়েছে।
বিএনপি নেতারা জানান, বিএনপিসহ ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলসহ অন্যান্য অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের সবার বিরুদ্ধে সব মামলা প্রত্যাহার না হলে কখনোই একটা নিরপেক্ষ অবস্থা তৈরি হবে না। অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে এসব রাজনৈতিক মামলা। স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে যারা নিহত ও আহত হয়েছেন, তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা এবং মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।