ঢাকা ০৩:২১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট, নাকি আরেকটি ট্রাম্প জমানা?

আর্ন্তজাতিক ডেস্ক
  • আপডেট সময় : ০১:৩৪:৩৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর ২০২৪
  • / ৩৪০ বার পড়া হয়েছে
৭১ নিউজ বিডির সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোটগ্রহণ আজ ৫ নভেম্বর। এরই মধ্যে অবশ্য প্রায় ৭ কোটি আগাম ভোট পড়েছে। মোট ১৮ কোটি ৬৫ লাখ নিবন্ধিত ভোটারের মধ্যে এরই মধ্যে প্রায় ৮ কোটি আগাম ভোট পড়েছে। এর মধ্যে কোন ভোট কার দিকে গেছে এখনো কেউ জানে না। সেটা জানতে ৫ নভেম্বরের পর আরও অন্তত একদিন পেরিয়ে যাবে। তবে ২৫ নভেম্বরের আগে কিছু অঙ্গরাজ্যের ডাকযোগে ভোটের ফল আসবে না। তারপরও ভোটের দিন ও আগাম পড়া ভোটের হিসাবেই মোটামুটি জানা হয়ে যাবে যে, কে বসতে যাচ্ছে মার্কিন মসনদে। প্রথমবারের মতো কোনো নারী প্রেসিডেন্ট কি পাবে দেশটি, নাকি আবারও একটি ট্রাম্প জমানা দেখতে হবে গোটা বিশ্বকে–তার নিষ্পত্তি অনেকখানিই নির্ভর করছে ৭টি সুইং স্টেটের ওপর।

এ লেখা যখন লেখা হচ্ছে, তখন অন্যতম সুইং স্টেট নর্থ ক্যারোলাইনায় শেষ নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেখানে তিনি বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলছেন, এবারের দৌড়ে এটিই শেষ বক্তব্য। তবে এই শেষ হচ্ছে নতুন শুরুর আগের। অর্থাৎ, ওভাল অফেস যাওয়ার ব্যাপারে তাঁর আত্মবিশ্বাস বেশ টগবগেই বলতে হবে।

এমন আত্মবিশ্বাসী না হওয়ার কোনো কারণ নেই অবশ্য। এবারের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান বলে খ্যাত অঙ্গরাজ্যগুলোর বাইরে সাতটি অঙ্গরাজ্যকে ব্যাটলগ্রাউন্ড হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এই সাত অঙ্গরাজ্য হলো–অ্যারিজোনা, জর্জিয়া, পেনসিলভানিয়া, মিশিগান, উইসকনসিন, নেভাদা ও নর্থ ক্যারোলাইনা। পরিসংখ্যানভিত্তিক ওয়েবসাইট স্ট্যাটিস্টা জানাচ্ছে, এর মধ্যে মিশিগান ও উইসকনসিন ছাড়া বাকি সবগুলোতেই কমলা হ্যারিসের চেয়ে দেড় শতাংশ পয়েন্টের বেশি ব্যবধানে এগিয়ে আছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর এই দুই অঙ্গরাজ্যেও তিনি এগিয়ে, তবে তা মাত্র শূন্য দশমিক ২ শতাংশ পয়েন্ট ব্যবধানে।

মনে রাখা জরুরি যে, ডেমোক্র্যাটরা জয় পাচ্ছে বলে ধরে নেওয়া অঙ্গরাজ্যগুলোতে মোট ইলেকটোরাল ভোট আছে ২২৬টি। বিপরীতে রিপাবলিকান প্রাধান্যের অঙ্গরাজ্যগুলোতে মোট ইলেকটোরাল ভোটের সংখ্যা ২১৯। ফলে এই সুইং স্টেট খ্যাত সাত অঙ্গরাজ্যের জয়‑পরাজয়ই আসলে নির্বাচনের ফল গড়ে দেবে, যেখানে মোট ভোটের সংখ্যা ৯৩টি।

এখন পর্যন্ত কমলা‑ট্রাম্প দ্বৈরথে শেষ পর্যন্ত কে জয়ী হবে বলা মুশকিল হয়ে গেছে মূলত এই সুইং স্টেটগুলোতে দুজনেরই পরস্পরের ঘাড়ে শ্বাস ফেলার দরুন। কারণ, নির্বাচনের দৌড়ে যেকোনো জরিপকারী সংস্থার চালানো জরিপে এমনকি ৩ শতাংশ পয়েন্টের ব্যবধানও তেমন সুনির্দিষ্ট ইঙ্গিত দিতে পারে না। সাধারণত ধরা হয়, জরিপে ব্যবধান যদি ৫ থেকে ৭ শতাংশ পয়েন্টের হয়, তবেই কিছুটা নিশ্চিন্ত বোধ করার সুযোগ থাকে। ফলে স্ট্যাটিস্টার জরিপ বা রয়টার্স‑ইপসস বা নিউইয়র্ক টাইমস বা আর কারও করা জরিপই আসলে সেভাবে দুই প্রার্থীকে স্বস্তি দিতে পারছে না।

কারণ, এবার সুইং স্টেটগুলোতে প্রধান দুই প্রার্থীর অবস্থানই বলতে গেলে সমান‑সমান। কোনো ক্ষেত্রেই ঠিক বড় ব্যবধানে এগিয়ে থাকার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। উপরন্তু মার্কিন নির্বাচনে ২০১৬ সালের সময় থেকেই জরিপ এক হাস্যকর উপাদানে পরিণত হয়েছে। কারণ, ২০১৬ সালে প্রধান সব জরিপ বলছিল–হিলারি আসছেন। কিন্তু এলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০২০ সালে অবশ্য ডেমোক্র্যাট ধারার সংবাদমাধ্যমগুলো কিছুটা রক্ষণশীল অবস্থান নেয়। কিন্তু সে সময়ের ফক্স নিউজের জরিপ উল্টেই তো ক্ষমতায় এলেন জো বাইডেন। এবার আবার ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান ঘরানার সংবাদমাধ্যম ও প্ল্যাটফর্মগুলো নিজেদের জরিপ যখন প্রকাশ করছে, তখন দেখা যাচ্ছে একই দশা। এ বলছে ট্রাম্প তো ও বলছে কমলা।

কেন এমন হয়? কারণ, সাধারণত দলীয় রাজনীতির সাথে যুক্ত বা ঘোরতর সমর্থকদের মধ্যেই এ ধরনের জরিপে অংশ নেওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। আর যে যে দলের সমর্থক, সে সেই পন্থী সংস্থার জরিপে অংশ নিতে স্বচ্ছন্দ্য থাকে বেশি। ফলে একনাগাড়ে জরিপের ফলের দিকে তাকালে দেখা যাবে–আসলে আসন্ন নির্বাচনে উভয়ই জয় পাচ্ছেন।

বরং অন্যদিকে তাকানো যাক। এবারের নির্বাচনে আলোচনায় আছেন আরও কয়েকজন প্রার্থী। তাঁরা হলেন–কর্নেল ওয়েস্ট, জিল স্টেইন, চেজ অলিভার, ক্লদিয়া ক্রুজ ও রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়র। এদের মধ্যে ক্লদিয়া, কেনেডি জুনিয়র ও চেজ অলিভার সরাসরি ভাগ বসাবেন কমলা হ্যারিসের ভোট বাক্সে। আর কর্নেল ওয়েস্ট ও জিল স্টেইনের স্বাভাবিক দশায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাক্সে ভাগ বসানোর কথা থাকলেও মধ্যপ্রাচ্য সংকট ও যুদ্ধবিরোধী অবস্থানের কারণে সেই ধাক্কাও গিয়ে লাগবে আদতে কমলার গায়েই।

এবারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অশ্বেতাঙ্গ ভোট বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মার্কিন মসনদে কে বসবেন, তা নিয়ে চীন ও রাশিয়ার তো একটা মাথাব্যথা থাকেই। এবার রাশিয়ার মাথাব্যথা একটু বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ–ইউক্রেন যুদ্ধ এবং সেখানে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের সরাসরি সহায়তা। ফলে ২০১৬ সালের চেয়েও যে বেশি মাত্রায় হস্তক্ষেপের চেষ্টা দেশটির পক্ষ থেকে থাকবে–তাতে আর সন্দেহ কী?

থাকছে আরব ভোটারদের প্রসঙ্গ। আরব আমেরিকানদের একটি বড় অংশই এবার ট্রাম্পের দিকে হেলতে পারেন। এ ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে বড়সড় দ্বিধাও কাজ করবে সন্দেহ নেই। কারণ, এই ট্রাম্পই তাঁর প্রথম মেয়াদে কঠোর অভিবাসন নীতির নামে ছয় মুসলিম দেশের নাগরিকদের ওপর আমেরিকায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন। পাশাপাশি জেরুসালেম প্রশ্নে ইসরায়েলের পক্ষ গ্রহণ করেছিলেন। ফলে ট্রাম্পের পক্ষে জোরদার অবস্থান নেওয়াটা তাদের পক্ষে সহজ নয়। তারপরও প্রশ্নটি আসছে গাজা যুদ্ধের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে। অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকলে গাজা যুদ্ধ হয়তো এতটা গড়াত না। যেহেতু ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধকে আমেরিকার দিক থেকে অহেতুক ব্যয় হিসেবে বিবেচনা করেন। কিন্তু মার্কিন রাজনীতিতে ইসরায়েল প্রভাব বা ইসরায়েল প্রশ্নটি এতটা সরল নয়। এর সাথে যদি গাজা প্রশ্নে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তরুণদের আন্দোলন ও বাইডেন প্রশাসনের তা মোকাবিলার নীতিটি জড়িয়ে নেওয়া হয়, তাহলে ডেমোক্র্যাটরা কিছুটা হলেও এই অংশে ব্যাকফুটে থাকবে।

সামনে আছে ভারত প্রশ্নও। বিশেষত শিখ নেতা হত্যাচেষ্টা মামলা নিউইয়র্কের আদালতে ওঠার পর প্রশ্নটি জোরেশোরে উঠছে। এ ক্ষেত্রে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের বন্ধুত্বের প্রসঙ্গটি ঘুরেফিরে আসছে। অনেকে এ কারণে বলছেন, কমলা হ্যারিসের পারিবারিক শিকড়ের একাংশ ভারতে হলেও অনেক ভারতীয় আমেরিকানই এবার তাঁকে হয়তো বেছে নেবেন না। মার্কিন রাজনীতিতে ভারতীয় আমেরিকান ভোটাররা গুরুত্বপূর্ণ। সংখ্যা তো বটেই ভোট দেওয়ার হারও এদের মধ্যে বেশি। গেলবার ভারতীয় আমেরিকানদের ৭১ শতাংশই ভোট দিয়েছিলেন। এবার ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত এ হার হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

রয়েছে কৃষ্ণাঙ্গ ও লাতিন ভোটের প্রসঙ্গ। ঐতিহাসিকভাবে এ দুই ঘরানার ভোটাররা ডমোক্রেটিক শিবিরের বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু এবার বিশেষত কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের সাথে মুসলিম প্রশ্নটি অনেকটাই মিলেমিশে গেছে। ফলে আরব ভোটারদের মতোই একটা দ্বিধা রয়েছে তাদের মধ্যে। তবে শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটের একটি বড় অংশই ডেমোক্র্যাট বাক্সেই যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি কাজ করছে তা হলো–বেকারত্ব ও অর্থনীতি। মার্কিন মুলুকে বেকারত্ব বাড়ছে। আর এর পেছেনে বিদ্যমান বাইডেন প্রশাসনের যুদ্ধ‑ব্যয়কে মুখ্য কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে। বিশেষত তরুণ ভোটারদের মধ্যে এ ভাবনা প্রবল। ফলে এ ক্ষেত্রে বাইডেনকে প্রত্যাখ্যানের বিষয়টি কমলা পর্যন্ত গড়াতে পারে, যেহেতু তিনি বাইডেন প্রশাসনেরই ভাইস প্রেসিডেন্ট।

সব মিলিয়ে দুটি গুলি, দুটি যুদ্ধ দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রত্যাশার চেয়েও বেশি সাড়া ফেলতে পেরেছেন। এই সাড়া এতটাই যে, নারী প্রশ্ন, গর্ভপাত প্রশ্ন, মুসলিম বিদ্বেষ, অভিবাসননীতি, স্বাস্থ্য খাত ইত্যাদি প্রশ্নকে অনেকটা আড়াল করে ফেলছে। বিপরীতে বাইডেন সরে যাওয়ার পর কমলা বেশ এগিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু মুসলিম ও চলমান দুটি যুদ্ধের দায় তাঁর কাঁধে চড়ে বসে আছে। পাশাপাশি নারী হওয়ার কারণেই কিছুটা সংকটে পড়ছেন তিনি। কারণ–এত বছরের গণতন্ত্রের লীলাভূমি আমেরিকা তো কোনো নারী প্রেসিডেন্টকে নির্বাচিত করেনি। কমলার সামনে তাই বড় সমুদ্দুরই বলতে হবে। দৃঢ়তার সাথে তা পার হতে পারলেই কেবল তিনি ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারবেন। দেখাই যাক, কী হয়।

নিউজটি শেয়ার করুন

প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট, নাকি আরেকটি ট্রাম্প জমানা?

আপডেট সময় : ০১:৩৪:৩৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর ২০২৪

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোটগ্রহণ আজ ৫ নভেম্বর। এরই মধ্যে অবশ্য প্রায় ৭ কোটি আগাম ভোট পড়েছে। মোট ১৮ কোটি ৬৫ লাখ নিবন্ধিত ভোটারের মধ্যে এরই মধ্যে প্রায় ৮ কোটি আগাম ভোট পড়েছে। এর মধ্যে কোন ভোট কার দিকে গেছে এখনো কেউ জানে না। সেটা জানতে ৫ নভেম্বরের পর আরও অন্তত একদিন পেরিয়ে যাবে। তবে ২৫ নভেম্বরের আগে কিছু অঙ্গরাজ্যের ডাকযোগে ভোটের ফল আসবে না। তারপরও ভোটের দিন ও আগাম পড়া ভোটের হিসাবেই মোটামুটি জানা হয়ে যাবে যে, কে বসতে যাচ্ছে মার্কিন মসনদে। প্রথমবারের মতো কোনো নারী প্রেসিডেন্ট কি পাবে দেশটি, নাকি আবারও একটি ট্রাম্প জমানা দেখতে হবে গোটা বিশ্বকে–তার নিষ্পত্তি অনেকখানিই নির্ভর করছে ৭টি সুইং স্টেটের ওপর।

এ লেখা যখন লেখা হচ্ছে, তখন অন্যতম সুইং স্টেট নর্থ ক্যারোলাইনায় শেষ নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেখানে তিনি বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলছেন, এবারের দৌড়ে এটিই শেষ বক্তব্য। তবে এই শেষ হচ্ছে নতুন শুরুর আগের। অর্থাৎ, ওভাল অফেস যাওয়ার ব্যাপারে তাঁর আত্মবিশ্বাস বেশ টগবগেই বলতে হবে।

এমন আত্মবিশ্বাসী না হওয়ার কোনো কারণ নেই অবশ্য। এবারের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান বলে খ্যাত অঙ্গরাজ্যগুলোর বাইরে সাতটি অঙ্গরাজ্যকে ব্যাটলগ্রাউন্ড হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এই সাত অঙ্গরাজ্য হলো–অ্যারিজোনা, জর্জিয়া, পেনসিলভানিয়া, মিশিগান, উইসকনসিন, নেভাদা ও নর্থ ক্যারোলাইনা। পরিসংখ্যানভিত্তিক ওয়েবসাইট স্ট্যাটিস্টা জানাচ্ছে, এর মধ্যে মিশিগান ও উইসকনসিন ছাড়া বাকি সবগুলোতেই কমলা হ্যারিসের চেয়ে দেড় শতাংশ পয়েন্টের বেশি ব্যবধানে এগিয়ে আছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর এই দুই অঙ্গরাজ্যেও তিনি এগিয়ে, তবে তা মাত্র শূন্য দশমিক ২ শতাংশ পয়েন্ট ব্যবধানে।

মনে রাখা জরুরি যে, ডেমোক্র্যাটরা জয় পাচ্ছে বলে ধরে নেওয়া অঙ্গরাজ্যগুলোতে মোট ইলেকটোরাল ভোট আছে ২২৬টি। বিপরীতে রিপাবলিকান প্রাধান্যের অঙ্গরাজ্যগুলোতে মোট ইলেকটোরাল ভোটের সংখ্যা ২১৯। ফলে এই সুইং স্টেট খ্যাত সাত অঙ্গরাজ্যের জয়‑পরাজয়ই আসলে নির্বাচনের ফল গড়ে দেবে, যেখানে মোট ভোটের সংখ্যা ৯৩টি।

এখন পর্যন্ত কমলা‑ট্রাম্প দ্বৈরথে শেষ পর্যন্ত কে জয়ী হবে বলা মুশকিল হয়ে গেছে মূলত এই সুইং স্টেটগুলোতে দুজনেরই পরস্পরের ঘাড়ে শ্বাস ফেলার দরুন। কারণ, নির্বাচনের দৌড়ে যেকোনো জরিপকারী সংস্থার চালানো জরিপে এমনকি ৩ শতাংশ পয়েন্টের ব্যবধানও তেমন সুনির্দিষ্ট ইঙ্গিত দিতে পারে না। সাধারণত ধরা হয়, জরিপে ব্যবধান যদি ৫ থেকে ৭ শতাংশ পয়েন্টের হয়, তবেই কিছুটা নিশ্চিন্ত বোধ করার সুযোগ থাকে। ফলে স্ট্যাটিস্টার জরিপ বা রয়টার্স‑ইপসস বা নিউইয়র্ক টাইমস বা আর কারও করা জরিপই আসলে সেভাবে দুই প্রার্থীকে স্বস্তি দিতে পারছে না।

কারণ, এবার সুইং স্টেটগুলোতে প্রধান দুই প্রার্থীর অবস্থানই বলতে গেলে সমান‑সমান। কোনো ক্ষেত্রেই ঠিক বড় ব্যবধানে এগিয়ে থাকার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। উপরন্তু মার্কিন নির্বাচনে ২০১৬ সালের সময় থেকেই জরিপ এক হাস্যকর উপাদানে পরিণত হয়েছে। কারণ, ২০১৬ সালে প্রধান সব জরিপ বলছিল–হিলারি আসছেন। কিন্তু এলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০২০ সালে অবশ্য ডেমোক্র্যাট ধারার সংবাদমাধ্যমগুলো কিছুটা রক্ষণশীল অবস্থান নেয়। কিন্তু সে সময়ের ফক্স নিউজের জরিপ উল্টেই তো ক্ষমতায় এলেন জো বাইডেন। এবার আবার ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান ঘরানার সংবাদমাধ্যম ও প্ল্যাটফর্মগুলো নিজেদের জরিপ যখন প্রকাশ করছে, তখন দেখা যাচ্ছে একই দশা। এ বলছে ট্রাম্প তো ও বলছে কমলা।

কেন এমন হয়? কারণ, সাধারণত দলীয় রাজনীতির সাথে যুক্ত বা ঘোরতর সমর্থকদের মধ্যেই এ ধরনের জরিপে অংশ নেওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। আর যে যে দলের সমর্থক, সে সেই পন্থী সংস্থার জরিপে অংশ নিতে স্বচ্ছন্দ্য থাকে বেশি। ফলে একনাগাড়ে জরিপের ফলের দিকে তাকালে দেখা যাবে–আসলে আসন্ন নির্বাচনে উভয়ই জয় পাচ্ছেন।

বরং অন্যদিকে তাকানো যাক। এবারের নির্বাচনে আলোচনায় আছেন আরও কয়েকজন প্রার্থী। তাঁরা হলেন–কর্নেল ওয়েস্ট, জিল স্টেইন, চেজ অলিভার, ক্লদিয়া ক্রুজ ও রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়র। এদের মধ্যে ক্লদিয়া, কেনেডি জুনিয়র ও চেজ অলিভার সরাসরি ভাগ বসাবেন কমলা হ্যারিসের ভোট বাক্সে। আর কর্নেল ওয়েস্ট ও জিল স্টেইনের স্বাভাবিক দশায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাক্সে ভাগ বসানোর কথা থাকলেও মধ্যপ্রাচ্য সংকট ও যুদ্ধবিরোধী অবস্থানের কারণে সেই ধাক্কাও গিয়ে লাগবে আদতে কমলার গায়েই।

এবারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অশ্বেতাঙ্গ ভোট বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মার্কিন মসনদে কে বসবেন, তা নিয়ে চীন ও রাশিয়ার তো একটা মাথাব্যথা থাকেই। এবার রাশিয়ার মাথাব্যথা একটু বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ–ইউক্রেন যুদ্ধ এবং সেখানে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের সরাসরি সহায়তা। ফলে ২০১৬ সালের চেয়েও যে বেশি মাত্রায় হস্তক্ষেপের চেষ্টা দেশটির পক্ষ থেকে থাকবে–তাতে আর সন্দেহ কী?

থাকছে আরব ভোটারদের প্রসঙ্গ। আরব আমেরিকানদের একটি বড় অংশই এবার ট্রাম্পের দিকে হেলতে পারেন। এ ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে বড়সড় দ্বিধাও কাজ করবে সন্দেহ নেই। কারণ, এই ট্রাম্পই তাঁর প্রথম মেয়াদে কঠোর অভিবাসন নীতির নামে ছয় মুসলিম দেশের নাগরিকদের ওপর আমেরিকায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন। পাশাপাশি জেরুসালেম প্রশ্নে ইসরায়েলের পক্ষ গ্রহণ করেছিলেন। ফলে ট্রাম্পের পক্ষে জোরদার অবস্থান নেওয়াটা তাদের পক্ষে সহজ নয়। তারপরও প্রশ্নটি আসছে গাজা যুদ্ধের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে। অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকলে গাজা যুদ্ধ হয়তো এতটা গড়াত না। যেহেতু ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধকে আমেরিকার দিক থেকে অহেতুক ব্যয় হিসেবে বিবেচনা করেন। কিন্তু মার্কিন রাজনীতিতে ইসরায়েল প্রভাব বা ইসরায়েল প্রশ্নটি এতটা সরল নয়। এর সাথে যদি গাজা প্রশ্নে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তরুণদের আন্দোলন ও বাইডেন প্রশাসনের তা মোকাবিলার নীতিটি জড়িয়ে নেওয়া হয়, তাহলে ডেমোক্র্যাটরা কিছুটা হলেও এই অংশে ব্যাকফুটে থাকবে।

সামনে আছে ভারত প্রশ্নও। বিশেষত শিখ নেতা হত্যাচেষ্টা মামলা নিউইয়র্কের আদালতে ওঠার পর প্রশ্নটি জোরেশোরে উঠছে। এ ক্ষেত্রে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের বন্ধুত্বের প্রসঙ্গটি ঘুরেফিরে আসছে। অনেকে এ কারণে বলছেন, কমলা হ্যারিসের পারিবারিক শিকড়ের একাংশ ভারতে হলেও অনেক ভারতীয় আমেরিকানই এবার তাঁকে হয়তো বেছে নেবেন না। মার্কিন রাজনীতিতে ভারতীয় আমেরিকান ভোটাররা গুরুত্বপূর্ণ। সংখ্যা তো বটেই ভোট দেওয়ার হারও এদের মধ্যে বেশি। গেলবার ভারতীয় আমেরিকানদের ৭১ শতাংশই ভোট দিয়েছিলেন। এবার ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত এ হার হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

রয়েছে কৃষ্ণাঙ্গ ও লাতিন ভোটের প্রসঙ্গ। ঐতিহাসিকভাবে এ দুই ঘরানার ভোটাররা ডমোক্রেটিক শিবিরের বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু এবার বিশেষত কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের সাথে মুসলিম প্রশ্নটি অনেকটাই মিলেমিশে গেছে। ফলে আরব ভোটারদের মতোই একটা দ্বিধা রয়েছে তাদের মধ্যে। তবে শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটের একটি বড় অংশই ডেমোক্র্যাট বাক্সেই যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি কাজ করছে তা হলো–বেকারত্ব ও অর্থনীতি। মার্কিন মুলুকে বেকারত্ব বাড়ছে। আর এর পেছেনে বিদ্যমান বাইডেন প্রশাসনের যুদ্ধ‑ব্যয়কে মুখ্য কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে। বিশেষত তরুণ ভোটারদের মধ্যে এ ভাবনা প্রবল। ফলে এ ক্ষেত্রে বাইডেনকে প্রত্যাখ্যানের বিষয়টি কমলা পর্যন্ত গড়াতে পারে, যেহেতু তিনি বাইডেন প্রশাসনেরই ভাইস প্রেসিডেন্ট।

সব মিলিয়ে দুটি গুলি, দুটি যুদ্ধ দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রত্যাশার চেয়েও বেশি সাড়া ফেলতে পেরেছেন। এই সাড়া এতটাই যে, নারী প্রশ্ন, গর্ভপাত প্রশ্ন, মুসলিম বিদ্বেষ, অভিবাসননীতি, স্বাস্থ্য খাত ইত্যাদি প্রশ্নকে অনেকটা আড়াল করে ফেলছে। বিপরীতে বাইডেন সরে যাওয়ার পর কমলা বেশ এগিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু মুসলিম ও চলমান দুটি যুদ্ধের দায় তাঁর কাঁধে চড়ে বসে আছে। পাশাপাশি নারী হওয়ার কারণেই কিছুটা সংকটে পড়ছেন তিনি। কারণ–এত বছরের গণতন্ত্রের লীলাভূমি আমেরিকা তো কোনো নারী প্রেসিডেন্টকে নির্বাচিত করেনি। কমলার সামনে তাই বড় সমুদ্দুরই বলতে হবে। দৃঢ়তার সাথে তা পার হতে পারলেই কেবল তিনি ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারবেন। দেখাই যাক, কী হয়।