‘লাঠিয়াল’ বাহিনী থেকে জনগণের বন্ধু হয়ে উঠতে পারবে কি পুলিশ?
- আপডেট সময় : ১২:২৭:২৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪
- / ৩৪৩ বার পড়া হয়েছে
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন সাধারণ মানুষের। নির্বিচারে গুলি করে ছাত্র-জনতা হত্যার অভিযোগে অনেকেই এখন হত্যা মামলার আসামি। অথচ এই পুলিশের তো জনগণের বন্ধু হওয়ার কথা ছিল। কীভাবে ক্ষমতাসীনদের পেটোয়া বাহিনী হলো পুলিশ? তার আদ্যোপান্ত খুঁজেছে এখন টেলিভিশন। রাষ্ট্র পরিচালনায় যেই আসুক না কেন পুলিশ বরাবরই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এ দেশে। পুলিশ সংস্কারের উপায়ই বা কী? কি বলছে বোদ্ধারা?
গণঅভ্যুত্থান। ২০২৪ এর এই অভ্যুত্থানে প্রায় দেড় হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যুর দায় পুলিশের ঘাড়ে। আহতর সংখ্যা ৫০ হাজারেরও বেশি। এই অভ্যুত্থানে কি ছাত্র জনতার উপর গুলি চালানোর কথা ছিল পুলিশের? নিশ্চই না। তবে কেন গুলি করলো পুলিশ?
পুলিশ গঠনের চিন্তার শুরুটা ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লব থেকে শুরু পরে ১৮৬৯ সালে নীল আন্দোলন সেই চিন্তার পূর্ণতা দেয়। ব্রিটিশদের ক্ষমতা ও ব্যবসা পাকাপোক্ত করতে দরকার ছিল পেটোয়া বাহিনীর। দমন করতে হবে আন্দোলন। তাই ১৮৬১ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে গঠন করা হয় পুলিশ। সে সময় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন দমন করতেই তাদের ব্যবহার করা হতো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, ওই সিপাহি বিদ্রোহ দমন করার পর তারা বুঝতে পারলেন যে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসক যে এই উপমহাদেশে টিকে থাকতে হলে আমাদের কিছু লাঠিয়াল বাহিনী লাগবে। আর আমাদের কিছু আইন লাগবে যেগুলোর মধ্য দিয়ে আমরা টিকে থাকতে পারি। অনেক গবেষক বলেছেন এই পেনাল কোড ও পুলিশ অ্যাক্টের মধ্য দিয়ে তারা তাদের কলোনিয়াম রেজিমি বা ঔপনিবেশিক শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য এটা করেছেন।’
বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘তখন পুলিশকে অর্গানাইজ করা হয়েছিল এভাবেই যে ব্রিটিশদের স্বার্থ এই অঞ্চলে রক্ষা করা যায়।’
কীভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য পাকাপোক্ত করতে তাদের ব্যবহার করা হতো? এ বিষয়ে কবি, প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ফরহাদ মজহার বলেন, ‘পুরোনো কলোনিয়াল ব্যবস্থাটা তারা কন্টিনিউ করে। সেই ধারাবাহিকতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হচ্ছে পুলিশি ব্যবস্থা। আপনি বাংলাদেশের যে পুলিশ দেখছেন বা দেখেছেন এটা আসলে কলোনিয়াল পুলিশি ব্যবস্থা।’
১৮৬১ থেকে ২০২৪, এই দীর্ঘ ১৬৩ বছরে যখনি কেউ এই অঞ্চলে ক্ষমতায় এসেছে সবাই নিজেদের পেটোয়া বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করেছে পুলিশ বাহিনীকে। বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীনদের ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার জন্য পুলিশের মধ্যে পরিবর্তনও এসেছে বারবার।
সংস্কারের নামে বদলেছে পোশাক, কখনো পদবি অথবা পরিচয় কিন্তু ব্রিটিশ সেই পেটোয়া বাহিনীর আইন হয়নি কখনো সংস্কার, সেই সময়কার আইন মেনেই চলছে আজকের বাংলাদেশ পুলিশ। বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক প্রধান জানালেন দায়িত্বে থাকা অবস্থায় তার নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথা।
সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘পুলিশে যখন ছেলেটা জয়েন করে দাগটা নিয়েই জয়েন করে। যে আমি একটা খারাপ ডিপার্টমেন্টে আছি। যদি রাজনীতিবিদরা, রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা থাকবেন, দেশ যারা চালাবেন তারা যদি মনে করে পুলিশ জনগণের বন্ধু হবে, জনগণের সাথে সম্পৃক্ততা থাকবে, দুষ্টের দমন শিষ্টের পালনে কাজ করতে পারবে তাহলে সম্ভব।’
আওয়ামী-লীগ, বিএনপি, জাপা কেউ উদ্যোগ নেয়নি পুলিশ আইন সংস্কারে। ২০০৭ এ তত্ত্বাবধায়কের হাত ধরে একবার এই আইন সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও, খসড়া জমা দেওয়ার পরেও বাস্তবায়ন হয়নি তা। কী ছিল সেই খসড়ায়?
অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, ‘খসড়াটা খুবই নিকৃষ্ট মানের আইন। ওইখানে পুলিশকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিতে বলা হয়েছে। ওইখানে পুলিশকে পার্টটাইম কাজ করার কথাও বলা হয়েছে।’
আধুনিক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত দেশগুলো ঢেলে সাজায় তাদের আইন, প্রতিনিয়ত আধুনিক করা হয় আইনের কাঠামো। অথচ বাংলাদেশে পুলিশ এখনও থেকে গেছে সেই ব্রিটিশ ভাবধারায়।
৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর দায়িত্ব নেয় ড ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, এর পর বিভিন্ন দাবির মুখে আবারো পুলিশ আইন সংস্কারের জন্য কমিটিও গঠন করা হয়, কিন্তু প্রশ্ন ছিল আসলেই কি অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার করতে পারবে এই আইন।
ইতিমধ্যেই গণ-হত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ১৭ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তা মামলার আসামী হয়েছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের সময় পুলিশ আইন সংস্কারে উদ্যোগ নেওয়া হলেও পুলিশ আইন ১৮৬১ আদৌ কি সংস্কার করা সম্ভব? মানবাধিকার সমুন্নত রাখার পাশাপাশি লাঠিয়াল বাহিনী থেকে জনমানুষের বন্ধু হয়ে উঠতে আর কত বছর সময় লাগবে পুলিশ বাহিনীর? এখন দেখার বিষয় অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত কতটা আলোর মুখ দেখতে পায়।