সাগরের নিচে সাধারণত কী থাকে? বিভিন্ন প্রজাতির ছোটবড় সামুদ্রিক প্রাণী ও উদ্ভিদ। আরো গভীরে সমুদ্রের তলদেশে গেলে পাওয়া যাবে সামুদ্রিক পলি, লক্ষ বছর ধরে গড়ে উঠা জীবাশ্ম, গভীর-সমুদ্রের পরিখা, সামুদ্রিক পর্বতশ্রেনীসহ বিভিন্ন বস্তু। কিন্তু ইটের তৈরি রাস্তা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে কি?
না, আপনার কল্পনাশক্তিকে খুব বেশি প্রসারিত করতে হবে না, কারণ এমনই একটি রাস্তা দেখা গেছে প্রশান্ত মহাসাগরের তলেদেশে। প্রথম দেখায় রাস্তাটি হলুদ ইটের তৈরি বলে মনে হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মহাসাগরের তলদেশে হলুদ ইট দিয়ে রাস্তা বানিয়ে রেখেছে কে, আর কীই-বা তার কারণ?
ঘটনাটি ২০২২ সালের। হাওয়াইয়ান দ্বীপপুঞ্জের ঠিক উত্তরে গভীর-সমুদ্রের শৈলশিরায় পরিচালিত এক অভিযানে চমকপ্রদ এক আবিষ্কার সামনে আসে। একটি শুকিয়ে যাওয়া প্রাচীন লেকের তলদেশ দেখতে পাওয়া যায় সেখানে। তলদেশটি দেখতে ঠিক হলুদ ইটের রাস্তার মতো।
অনুসন্ধানী জাহাজ নোটিলাস যখন পাপাহানাউমোকুয়াকে মেরিন ন্যাশনাল মনুমেন্টের (পিএমএনএম) অন্তর্গত লিলিউওকালনি শৈলশিরায় (রিজ) অভিযান (সার্ভে) পরিচালনা করছিল তখনই সামনে চলে আসে আশ্চর্যকর ও কিছুটা অতিপ্রাকৃতিক এই দৃশ্যটি।
উল্লেখ্য, পাপাহানাউমোকুয়াকে মেরিন ন্যাশনাল মনুমেন্টে (পিএমএনএম) হলো বিশ্বের বৃহত্তম সামুদ্রিক সংরক্ষিত (মেরিন কনজারভেশন) অঞ্চলগুলোর একটি। এটি আমেরিকার সমস্ত জাতীয় উদ্যানের সম্মিলিত আয়তনের চেয়েও বড়। এখন পর্যন্ত এই সামুদ্রিক সংরক্ষিত অঞ্চলটির মাত্র ৩ শতাংশের তলদেশই অন্বেষণ করা সম্ভব হয়েছে।
ওশান এক্সপ্লোরেশন ট্রাস্টের গবেষকরা প্রতিনিয়ত এই সংরক্ষিত অঞ্চলটির সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচে যে বিস্তীর্ণ প্রান্তর রয়েছে সেখানে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন। এই প্রান্তর সমুদ্রের তরঙ্গের (ওয়েভের) ৩ হাজার মিটারেরও বেশি গভীরে অবস্থিত। সবচেয়ে বড় কথা হলো, যে কেউ চাইলেই গবেষকদের এই অনুসন্ধানী অভিযান দেখার সুযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধানী অভিযানের ধারণকৃত কিছু দৃশ্যের একটি হাইলাইট রিল ইউটিউবে প্রকাশিত হয় ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে। সেখানে দেখা যায়, গভীর সমুদ্রে অভিযান পরিচালনার সময় গবেষকরা আটলান্টিসে যাওয়ার পথে হলুদ ইট বিছানো একটি রাস্তার সন্ধান পেয়েছেন। অন্তত দেখতে তেমনটাই মনে হয়েছে।
একজন গবেষককে তাই বলতে শোনা যায়, ‘এটি আটলান্টিসের রাস্তা’। আরেকজন বলে উঠেন, ‘হলুদ ইটের রাস্তা?’
মজার বিষয় হচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের প্রায় ১ হাজার মিটার নিচে নুটকা পর্বতের চুড়ায় গবেষকদের খুঁজে পাওয়া লেকের তলদেশটি আশ্চর্যজনকভাবে শুকনো দেখায়। রেডিও’তে ‘হলুদ ইটের রাস্তা’-সদৃশ এই তলদেশকে গবেষকরা ‘বেকড ক্রাস্ট’-এর মতো দেখায় বলে অভিহিত করেছেন, অনেকটা যেন খোসা ছাড়ানোর মতো এর স্তরগুলো খুলে খুলে আসবে।
আসলে এটি হলুদ ইটের তৈরি কোনো রাস্তা নয়। সমুদ্রের তলদেশে আগ্নেয়গিরির একটি শিলা এমনভাবে ভেঙেছে যে, এটিকে ইট বিছানো রাস্তার অনুরূপ বলে মনে হচ্ছে। বলা যেতে পারে চোখের এক চমৎকার বিভ্রম তৈরি করেছে দৃশ্যটি। অনন্য এই ৯০-ডিগ্রি ফ্র্যাকচার বা ভাঙনের পেছনে মূল কারণ খুব সম্ভবত একাধিক অগ্ন্যুৎপাতের কারণে সৃষ্ট গরম ও শীতল চাপ। এমনটাই ধারণা করছেন গবেষকরা।
তবে প্রথম দেখায়, সমুদ্রের তলদেশে ইট-নির্মিত এমন একটি অনন্য রাস্তা নতুন এক বিস্ময়কর পৃথিবীর সন্ধান দিবে বলে ভ্রম হতেই পারে। কিন্তু একটু অন্যভাবে চিন্তা করলে, বিষয়টিকে পুরোপুরি মিথ্যা বলেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কেননা ইট-সদৃশ এই রাস্তা অনুসরণ করার অর্থ হচ্ছে গবেষকরা সঠিক পথেই এগুচ্ছেন, হয়তো অচিরেই পৃথিবীর লুকানো ভূতত্ত্ব সম্পর্কে নতুন কিছু জানতে পারবেন তাঁরা। তথ্যসূত্র: সায়েন্স অ্যালার্ট