ঢাকা ০৭:০৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी
ব্রেকিং নিউজ ::
প্রায় ১০ ঘণ্টা পর সচিবালয়ের আগুন পুরোপুরি নির্বাপণ হয়েছে: ফায়ার সার্ভিস; আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে কাজ করে ফায়ার সার্ভিসের ১৯ ইউনিট, উদ্ধারকাজে সহায়তা করেছে সেনাবাহিনী, বিজিবি, এপিবিএন, র‌্যাব :::: সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনের ৬ষ্ঠ তলা থেকে আগুনের সূত্রপাত, তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, নাশকতা কি-না তা জানা যাবে তদন্তের পর: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা :::: আগুনের ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ খালেদ রহীমকে আহ্বায়ক করে ৭ সদস্যের কমিটি গঠন :::: ২০০৪ সালে হওয়া সুনামির ২০ বছর পূর্তি আজ, ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী এই দুর্যোগে মৃত্যু হয়েছিল ২ লাখ ২৭ হাজার মানুষের

‘সংখ্যালঘুরা আগের তুলনায় বেশি নিরাপত্তা পাচ্ছে’

অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট সময় : ১২:০৩:৪৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪
  • / ৩৭৮ বার পড়া হয়েছে
৭১ নিউজ বিডির সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিয়ে নানা আলোচনায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে।

এই কঠিন পরীক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আপাতত সন্তোষের জায়গায় আছে বলে ভয়েস অব আমেরিকার একটি জরিপে উঠে এসেছে।

ওই জরিপ বলছে, দেশের অধিকাংশ মানুষ মনে করছে, অন্তর্বর্তী সরকার ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে বেশি নিরাপত্তা দিতে পারছে। যদিও জরিপে নিরাপত্তা নিয়ে ধারণায় মুসলিম এবং অমুসলিমদের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য লক্ষ্য করা গেছে।

গত অক্টোবর মাসের শেষের দিকে পরিচালিত এই জরিপে দেখা গেছে, ৬৪ দশমিক ১ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের তুলনায় অন্তর্বর্তী সরকার ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে বেশি নিরাপত্তা দিচ্ছে।

মাত্র ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, বর্তমান সরকার সংখ্যালঘুদের জন্য আগের চেয়ে খারাপ নিরাপত্তা দিচ্ছে। ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, পরিস্থিতি আগের মতোই আছে।

জরিপে এক হাজার উত্তরদাতাকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলের সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনের তুলনা করতে বলা হয়।

বাংলাদেশের জনতত্ত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জরিপের জন্য এক হাজার উত্তরদাতা বাছাই করা হয়। উত্তরদাতাদের মধ্যে সমানসংখ্যার নারী-পুরুষ ছিলেন, যাদের মধ্যে ৯২ দশমিক ৭ শতাংশ মুসলিম।

উত্তরদাতাদের মধ্যে অর্ধেকের একটু বেশির বয়স ৩৪ বছর বয়সের নিচে। উত্তরদাতাদের প্রায় এক-চতুর্থাংশ শহুরে মানুষ।

বাংলাদেশ ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে যে প্রতিশোধ প্রবণতা দেখা যায়, তার বড় এক ধাক্কা গিয়ে পড়ে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে সনাতনী ধর্মাবলম্বী বা হিন্দুদের ওপর। দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর, ব্যবসা এবং ধর্মীয় স্থাপনাগুলোতে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

মানবাধিকার কর্মী নুর খান লিটন বলেন, ‘আমরা দেখেছি, সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক সম্পৃক্তরা কারণে তাদের ওপর আক্রমণ হয়েছে, আবার শুধুমাত্র সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে তাদের ওপর আক্রমণ হয়েছে। পঞ্চগড়ে আহমদিয়াদের আবাসস্থলে আক্রমণ হয়েছে, অগ্নিসংযোগ হয়েছে।’

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা যে বরাবরই ঝুঁকির মধ্যে থাকেন, সেদিকে ইঙ্গিত করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর দক্ষিণ এশিয়া পরিচাল মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, ‘কোনো সরকার তাদের অধিকার রক্ষার জন্য খুব একটা কিছু করে না।’

ভয়েস আমেরিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী গোষ্ঠীকে ইচ্ছাকৃতভাবে আলাদা করে রাখা হয়েছে এবং সামরিক বাহিনী আর কর্তৃপক্ষ তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। হিন্দু এবং আহমদিয়া সম্প্রদায় উগ্রবাদী সংগঠনের আক্রমণের মুখে পড়ে।’

তবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর প্রশাসন, বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসে সংখ্যালঘুদের উপাসনাস্থল পাহারা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য।

সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত গুম কমিশনের একজন সদস্য নূর খান। ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘বেশকিছু দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ আমরা লক্ষ্য করেছি, সাধারণ মানুষের তরফ থেকে, রাজনৈতিক দলের তরফ থেকে এবং ধর্মীয় গোষ্ঠীর তরফ থেকে। এর ফলে দেখা গেছে, পরবর্তী এক মাসের মধ্যেই অবস্থার উন্নতি হয়েছে।’ তবে নিরাপত্তা নিয়ে ধারণায় মুসলিম এবং অমুসলিমদের কিছুটা তফাৎ জরিপে লক্ষ্য করা গেছে।

মুসলিম উত্তরদাতাদের মধ্যে মাত্র ১৩.৯ শতাংশ মনে করেন বর্তমান পরিস্থিতি আগের থেকে খারাপ। কিন্তু ধর্মীয় সংখ্যালঘু উত্তরদাতাদের ৩৩.৯ শতাংশ মনে করেন তাদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে খারাপ করছে।

ঢাকার বাসিন্দা জয়তী সরকার আগে কখনো তার বা পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না। কিন্তু এখন তিনি নিশ্চিত নন। তিনি বলেন, ‘আগের সরকারের সময় আমি আমার মেয়েকে নিয়ে রাত ১১টায় ধানমন্ডিতে আমাদের বাড়িতে ফিরেছি, কিছু মনে হতো না। কিন্তু এখন রাত ৮টার দিকে মেয়েকে নিয়ে ফিরি, তখন আমার ভয় করে। আমি ২০ বছর ধরে ঢাকা শহরে আছি কিন্তু আগে এরকম ভয়ের মধ্যে থাকিনি কখনো।’

ভয়েস অব আমেরিকার জরিপে দেখা গেছে, মুসলিম উত্তরদাতাদের মধ্যে ৬৬.১ শতাংশ মনে করছেন আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংখ্যালঘুদের বেশি নিরাপত্তা দিচ্ছে। অন্যদিকে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু উত্তরদাতাদের মধ্যে ৩৯.৫ শতাংশ এই ধারণার সাথে একমত।

অর্থাৎ, সংখ্যালঘুদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মনে করে আগের তুলনায় তারা বেশি নিরাপত্তা পাচ্ছে। জয়তী সরকার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় থাকলেও, তিনিও একটি স্বস্তির জায়গা দেখতে পাচ্ছেন।

তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় ছিল, তাদের নেতাকর্মীদের ছত্রছায়ায় লোকজন হিন্দুদের জমি অল্প দামে কিনেছে বা তাদের বিক্রি করতে বাধ্য করেছে। এরা এখন আর নাই। তাই একটা স্বস্তি বিরাজ করছে।’

ঢাকার বাসিন্দা এবং বেসরকারি সংস্থায় প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর হিসেবে কর্মরত হীরেন পণ্ডিত মনে করেন, সম্প্রতি গ্রামে-গঞ্জে সেনাবাহিনী মোতায়েনের ফলে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা পরিস্থিতি আগস্ট-সেপ্টেম্বরের চেয়ে ভাল হয়েছে। তবে তিনিও শঙ্কার মধ্যেই আছেন।

হীরেন পণ্ডিত বলেন, ‘আমাদের গ্রামের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং এখনো আমরা নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কার মধ্যে থাকি। একটা নিরাপত্তাহীনতা তো আছেই।’

বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক পর্যায়েও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নিয়মিত তার সরকারের উদ্বেগের কথা সংবাদমাধ্যমকে জানান।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন গত ২৬ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার জানান, দুই নেতা অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যসহ বাংলাদেশের সবার জন্য মানবাধিকার সুরক্ষার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনের আগে গত ৩১ অক্টোবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে লেখেন, ‘আমি হিন্দু, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বর্বর সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানাই, যারা বাংলাদেশে মব দ্বারা আক্রমণ ও লুটপাটের শিকার হচ্ছে, দেশটি সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলার মধ্যে রয়েছে।’

তবে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে অভিহিত করেছে। তারা বলেছে, হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের খবর ‘অতিরঞ্জিত’ করে প্রচার করা হচ্ছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে গত ১৭ অক্টোবর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন ড. ইউনূস। ভাষণে তিনি বলেন, কয়েকটি ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুরা সহিংসতার শিকার হয়, কিন্তু সেগুলো ছিল রাজনৈতিক। অল্প যেসব সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, তার মূল কারণ ছিল রাজনৈতিক। কিন্তু এসব ঘটনাকে ধর্মীয় আবরণ দিয়ে বাংলাদেশকে নতুন করে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা হয়েছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলছেন, শেখ হাসিনার ‘নিপীড়নমূলক’ শাসনের প্রতি ভারতের সমর্থনও হিন্দুদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে এবং ভবিষ্যতে নয়াদিল্লির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত, সব জায়গাতেই সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে চিন্তিত হওয়া। কিন্তু যেসব গোষ্ঠী ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে ঘৃণা ও সহিংসতা ছড়াতে চায়, তাদের ব্যাপারে বিশেষ করে ভারতের আরও সাবধান হওয়া উচিত।

বাংলাদেশে যে কোনো অজুহাতে হিন্দুদের নিশানা করার ঘটনা নতুন নয়। মানবাধিকারকর্মী নূর খান যেমন বলছেন, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় দুর্বলের প্রতি সবলের আঘাত তারা বিগত দিনে দেখেছেন এবং এর প্রধান শিকার হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে ইতিবাচক ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছেন নূর খান। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যে শঙ্কা ছিল, সে শঙ্কা ক্রমান্বয়ে কেটে উঠছে। একধরনের স্বস্তি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে আসতে শুরু হয়েছে। কিন্তু এখনই বলা যাবে না, তারা সম্পূর্ণ আস্থাশীল হতে পেরেছে কি না।’

নিরাপত্তা নিয়ে কতটুকু আস্থাশীল হতে পারবেন, তা নিয়ে এখনো উদ্বিগ্ন জয়তী সরকার। অন্য অনেক বাংলাদেশি মধ্যবিত্ত পরিবারের মত হিন্দুরাও তাদের ছেলে-মেয়েদের বিদেশ পাঠিয়ে দিতে পছন্দ করেন, কিন্তু তারা এখন এক বাড়তি চাপ অনুভব করছেন।

তিনি বলেন, ‘আমি যখন অফিসে যাই, তখন আমাকে আমার মুসলমান কলিগরাই বলেন, দিদি আপনি চলে গেলেন না কেন, এখানে থাকবেন কেন? আগে যেই জোর দিয়ে আমি প্রতিবাদ করতাম, যে এটা আমার দেশ, আমি দেশকে ভালবাসি, দুই-তিন’শ বছর ধরে আমরা এখানে আছি, আমরা কেন যাব? কিন্তু এখন আর জোর দিয়ে প্রতিবাদটা আর করি না। কারণ আমি নিজে নিরাপদ ফিল করিনা।

নূর খানের মতে, একটা আশঙ্কা অনেক মানুষের মধ্যেই আছে যে আগামী তিন মাস পর চিত্র কী হবে। অর্থাৎ, আস্থার সংকট রয়েছে।

নূর খান বলেন, ‘সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আস্থার জায়গাটা আরও মজবুত হবে কি না, তা নির্ভর করবে আগামী ৬ থেকে ৯ মাসের কার্যক্রমের ওপর, সরকারের পদক্ষেপের ওপর।’

মানবাধিকারকর্মীরা মনে করছেন, সংখ্যালঘুদের তাদের অধিকার ও নিরাপত্তা সম্পর্কে জনসমক্ষে আশ্বস্ত করতে সরকার ও ছাত্রনেতাদের আরও পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

নিউজটি শেয়ার করুন

‘সংখ্যালঘুরা আগের তুলনায় বেশি নিরাপত্তা পাচ্ছে’

আপডেট সময় : ১২:০৩:৪৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিয়ে নানা আলোচনায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে।

এই কঠিন পরীক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আপাতত সন্তোষের জায়গায় আছে বলে ভয়েস অব আমেরিকার একটি জরিপে উঠে এসেছে।

ওই জরিপ বলছে, দেশের অধিকাংশ মানুষ মনে করছে, অন্তর্বর্তী সরকার ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে বেশি নিরাপত্তা দিতে পারছে। যদিও জরিপে নিরাপত্তা নিয়ে ধারণায় মুসলিম এবং অমুসলিমদের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য লক্ষ্য করা গেছে।

গত অক্টোবর মাসের শেষের দিকে পরিচালিত এই জরিপে দেখা গেছে, ৬৪ দশমিক ১ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের তুলনায় অন্তর্বর্তী সরকার ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে বেশি নিরাপত্তা দিচ্ছে।

মাত্র ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, বর্তমান সরকার সংখ্যালঘুদের জন্য আগের চেয়ে খারাপ নিরাপত্তা দিচ্ছে। ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, পরিস্থিতি আগের মতোই আছে।

জরিপে এক হাজার উত্তরদাতাকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলের সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনের তুলনা করতে বলা হয়।

বাংলাদেশের জনতত্ত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জরিপের জন্য এক হাজার উত্তরদাতা বাছাই করা হয়। উত্তরদাতাদের মধ্যে সমানসংখ্যার নারী-পুরুষ ছিলেন, যাদের মধ্যে ৯২ দশমিক ৭ শতাংশ মুসলিম।

উত্তরদাতাদের মধ্যে অর্ধেকের একটু বেশির বয়স ৩৪ বছর বয়সের নিচে। উত্তরদাতাদের প্রায় এক-চতুর্থাংশ শহুরে মানুষ।

বাংলাদেশ ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে যে প্রতিশোধ প্রবণতা দেখা যায়, তার বড় এক ধাক্কা গিয়ে পড়ে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে সনাতনী ধর্মাবলম্বী বা হিন্দুদের ওপর। দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর, ব্যবসা এবং ধর্মীয় স্থাপনাগুলোতে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

মানবাধিকার কর্মী নুর খান লিটন বলেন, ‘আমরা দেখেছি, সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক সম্পৃক্তরা কারণে তাদের ওপর আক্রমণ হয়েছে, আবার শুধুমাত্র সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে তাদের ওপর আক্রমণ হয়েছে। পঞ্চগড়ে আহমদিয়াদের আবাসস্থলে আক্রমণ হয়েছে, অগ্নিসংযোগ হয়েছে।’

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা যে বরাবরই ঝুঁকির মধ্যে থাকেন, সেদিকে ইঙ্গিত করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর দক্ষিণ এশিয়া পরিচাল মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, ‘কোনো সরকার তাদের অধিকার রক্ষার জন্য খুব একটা কিছু করে না।’

ভয়েস আমেরিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী গোষ্ঠীকে ইচ্ছাকৃতভাবে আলাদা করে রাখা হয়েছে এবং সামরিক বাহিনী আর কর্তৃপক্ষ তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। হিন্দু এবং আহমদিয়া সম্প্রদায় উগ্রবাদী সংগঠনের আক্রমণের মুখে পড়ে।’

তবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর প্রশাসন, বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসে সংখ্যালঘুদের উপাসনাস্থল পাহারা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য।

সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত গুম কমিশনের একজন সদস্য নূর খান। ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘বেশকিছু দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ আমরা লক্ষ্য করেছি, সাধারণ মানুষের তরফ থেকে, রাজনৈতিক দলের তরফ থেকে এবং ধর্মীয় গোষ্ঠীর তরফ থেকে। এর ফলে দেখা গেছে, পরবর্তী এক মাসের মধ্যেই অবস্থার উন্নতি হয়েছে।’ তবে নিরাপত্তা নিয়ে ধারণায় মুসলিম এবং অমুসলিমদের কিছুটা তফাৎ জরিপে লক্ষ্য করা গেছে।

মুসলিম উত্তরদাতাদের মধ্যে মাত্র ১৩.৯ শতাংশ মনে করেন বর্তমান পরিস্থিতি আগের থেকে খারাপ। কিন্তু ধর্মীয় সংখ্যালঘু উত্তরদাতাদের ৩৩.৯ শতাংশ মনে করেন তাদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে খারাপ করছে।

ঢাকার বাসিন্দা জয়তী সরকার আগে কখনো তার বা পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না। কিন্তু এখন তিনি নিশ্চিত নন। তিনি বলেন, ‘আগের সরকারের সময় আমি আমার মেয়েকে নিয়ে রাত ১১টায় ধানমন্ডিতে আমাদের বাড়িতে ফিরেছি, কিছু মনে হতো না। কিন্তু এখন রাত ৮টার দিকে মেয়েকে নিয়ে ফিরি, তখন আমার ভয় করে। আমি ২০ বছর ধরে ঢাকা শহরে আছি কিন্তু আগে এরকম ভয়ের মধ্যে থাকিনি কখনো।’

ভয়েস অব আমেরিকার জরিপে দেখা গেছে, মুসলিম উত্তরদাতাদের মধ্যে ৬৬.১ শতাংশ মনে করছেন আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংখ্যালঘুদের বেশি নিরাপত্তা দিচ্ছে। অন্যদিকে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু উত্তরদাতাদের মধ্যে ৩৯.৫ শতাংশ এই ধারণার সাথে একমত।

অর্থাৎ, সংখ্যালঘুদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মনে করে আগের তুলনায় তারা বেশি নিরাপত্তা পাচ্ছে। জয়তী সরকার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় থাকলেও, তিনিও একটি স্বস্তির জায়গা দেখতে পাচ্ছেন।

তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় ছিল, তাদের নেতাকর্মীদের ছত্রছায়ায় লোকজন হিন্দুদের জমি অল্প দামে কিনেছে বা তাদের বিক্রি করতে বাধ্য করেছে। এরা এখন আর নাই। তাই একটা স্বস্তি বিরাজ করছে।’

ঢাকার বাসিন্দা এবং বেসরকারি সংস্থায় প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর হিসেবে কর্মরত হীরেন পণ্ডিত মনে করেন, সম্প্রতি গ্রামে-গঞ্জে সেনাবাহিনী মোতায়েনের ফলে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা পরিস্থিতি আগস্ট-সেপ্টেম্বরের চেয়ে ভাল হয়েছে। তবে তিনিও শঙ্কার মধ্যেই আছেন।

হীরেন পণ্ডিত বলেন, ‘আমাদের গ্রামের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং এখনো আমরা নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কার মধ্যে থাকি। একটা নিরাপত্তাহীনতা তো আছেই।’

বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক পর্যায়েও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নিয়মিত তার সরকারের উদ্বেগের কথা সংবাদমাধ্যমকে জানান।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন গত ২৬ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার জানান, দুই নেতা অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যসহ বাংলাদেশের সবার জন্য মানবাধিকার সুরক্ষার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনের আগে গত ৩১ অক্টোবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে লেখেন, ‘আমি হিন্দু, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বর্বর সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানাই, যারা বাংলাদেশে মব দ্বারা আক্রমণ ও লুটপাটের শিকার হচ্ছে, দেশটি সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলার মধ্যে রয়েছে।’

তবে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে অভিহিত করেছে। তারা বলেছে, হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের খবর ‘অতিরঞ্জিত’ করে প্রচার করা হচ্ছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে গত ১৭ অক্টোবর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন ড. ইউনূস। ভাষণে তিনি বলেন, কয়েকটি ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুরা সহিংসতার শিকার হয়, কিন্তু সেগুলো ছিল রাজনৈতিক। অল্প যেসব সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, তার মূল কারণ ছিল রাজনৈতিক। কিন্তু এসব ঘটনাকে ধর্মীয় আবরণ দিয়ে বাংলাদেশকে নতুন করে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা হয়েছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলছেন, শেখ হাসিনার ‘নিপীড়নমূলক’ শাসনের প্রতি ভারতের সমর্থনও হিন্দুদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে এবং ভবিষ্যতে নয়াদিল্লির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত, সব জায়গাতেই সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে চিন্তিত হওয়া। কিন্তু যেসব গোষ্ঠী ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে ঘৃণা ও সহিংসতা ছড়াতে চায়, তাদের ব্যাপারে বিশেষ করে ভারতের আরও সাবধান হওয়া উচিত।

বাংলাদেশে যে কোনো অজুহাতে হিন্দুদের নিশানা করার ঘটনা নতুন নয়। মানবাধিকারকর্মী নূর খান যেমন বলছেন, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় দুর্বলের প্রতি সবলের আঘাত তারা বিগত দিনে দেখেছেন এবং এর প্রধান শিকার হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে ইতিবাচক ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছেন নূর খান। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যে শঙ্কা ছিল, সে শঙ্কা ক্রমান্বয়ে কেটে উঠছে। একধরনের স্বস্তি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে আসতে শুরু হয়েছে। কিন্তু এখনই বলা যাবে না, তারা সম্পূর্ণ আস্থাশীল হতে পেরেছে কি না।’

নিরাপত্তা নিয়ে কতটুকু আস্থাশীল হতে পারবেন, তা নিয়ে এখনো উদ্বিগ্ন জয়তী সরকার। অন্য অনেক বাংলাদেশি মধ্যবিত্ত পরিবারের মত হিন্দুরাও তাদের ছেলে-মেয়েদের বিদেশ পাঠিয়ে দিতে পছন্দ করেন, কিন্তু তারা এখন এক বাড়তি চাপ অনুভব করছেন।

তিনি বলেন, ‘আমি যখন অফিসে যাই, তখন আমাকে আমার মুসলমান কলিগরাই বলেন, দিদি আপনি চলে গেলেন না কেন, এখানে থাকবেন কেন? আগে যেই জোর দিয়ে আমি প্রতিবাদ করতাম, যে এটা আমার দেশ, আমি দেশকে ভালবাসি, দুই-তিন’শ বছর ধরে আমরা এখানে আছি, আমরা কেন যাব? কিন্তু এখন আর জোর দিয়ে প্রতিবাদটা আর করি না। কারণ আমি নিজে নিরাপদ ফিল করিনা।

নূর খানের মতে, একটা আশঙ্কা অনেক মানুষের মধ্যেই আছে যে আগামী তিন মাস পর চিত্র কী হবে। অর্থাৎ, আস্থার সংকট রয়েছে।

নূর খান বলেন, ‘সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আস্থার জায়গাটা আরও মজবুত হবে কি না, তা নির্ভর করবে আগামী ৬ থেকে ৯ মাসের কার্যক্রমের ওপর, সরকারের পদক্ষেপের ওপর।’

মানবাধিকারকর্মীরা মনে করছেন, সংখ্যালঘুদের তাদের অধিকার ও নিরাপত্তা সম্পর্কে জনসমক্ষে আশ্বস্ত করতে সরকার ও ছাত্রনেতাদের আরও পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।