শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে বাংলদেশবিরোধী অপপ্রচার বাড়ছে। এ নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ ও অন্তর্বর্তী সরকার নানা বক্তব্য দিয়েছে। গত বুধবার (৪ ডিসেম্বর) রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পর্যন্ত বলেছেন, আমরা বারেবারে তাদের (ভারত) বলছি যে আপনারা আসেন এখানে, দেখেন, এখানে কোনো বাধা নেই। কিন্তু না, তারা ওখান থেকেই কল্পকাহিনী বানিয়ে যাচ্ছে।
এই কল্পকাহিনির তালিকায় আজ শুক্রবার (৬ ডিসেম্বর) যুক্ত হলো এবিপি আনন্দের আরও একটি খবর। ভারতীয় গণমাধ্যমটি হিন্দুদের ওপর অত্যাচারে এবার সরব বাংলাদেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের একাংশ, ‘প্রচুর মেয়ে নিখোঁজ, বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে..’ ! শিরোনামে তাদের পোর্টালে একটি সংবাদ প্রকাশ করেছে।
সংবাদটি তাদের ফেসবুকে পেজের একটি পোস্টের মন্তব্যের ঘরে শেয়ার করেছে। যেই পোস্টে লেখা হয়েছে— মহিলারা শাখা সিঁদুর পরে বেরোতে পারছে না, হিন্দু বুঝে গেলে সমস্যা বাংলাদেশে ‘ !
এমন গুরুতর অভিযোগ আনা এই পোস্টটির স্ক্রিণশট ছড়িয়ে যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তবে তা শেয়ার করে উল্টো গণমাধ্যমটির সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। তাদের মতে, বাংলাদেশে এমন ঘটনা ঘটেনি।
পোস্টটি শেয়ার করে কিংবা এর মন্তব্যের ঘরে যারা এবিপি আনন্দের সমালোচনা করছেন, তাদের বড় অংশ বাংলাদেশি; রয়েছেন ওপার বাংলার মানুষও। সমালোচনাকারীদের মধ্যে মুসলিমদের পাশাপাশি সনাতন ধর্মাবলম্বীরাও রয়েছেন। যেসব সনাতন ধর্মাবলম্বী সংবাদটির সমালোচনা করেছেন, তাদের বেশকিছু প্রোফাইল যাচাই করে দেখা গেছে যেগুলো আসল আইডি, কোনো বট নয়।
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি মেঘমল্লার বসু এবিপি আনন্দের ফেসবুক পোস্টটির স্ক্রিনশট শেয়ার দিয়ে লিখেছেন— ‘ওগোরে কে বুঝাবে, যে বাংলাদেশে অবিবাহিত মুসলমান মেয়েরাও স্রেফ এস্থেটিক্সের ঠেলায় শাখা-সিঁদূর পরে ঘুরে। ওগোরে কে বুঝাবে, আমি মেঘমল্লার বসু, একটু বাদে জহুরি মহল্লার একটা মাদ্রাসার ভেন্যুতে মোহাম্মদপুর কমিউনিটি এলায়েন্সের সভায় বক্তব্য দিব। ওদের কে বুঝাবে, গতকাল আলিয়াস ফ্রঁসেতে অনিন্দ্য বিশ্বাস, মুইজ মাহফুজ ছাড়াও ভারতীয় ‘হিন্দু’ অর্জুন করের গান শুনে আসলাম।
কলকাতার মিডিয়া একটা হিন্দু গণহত্যা মেনিফেস্ট করতেসে। মানে, যতক্ষণ পর্যন্ত সেটা না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা এই আলাপ চালায়েই যাবে।’
তিনি এবিপি আনন্দের পোস্টের নিচে একটি মন্তব্যও করেন, যেখানে তিনি লিখেন— ছোটবেলায় মা-বাবা মিথ্যা বলতে মানা করেনি?
শুভ্র গোস্বামীর মন্তব্য
শুভ্র গোস্বামী নামের এক উন্নয়নকর্মী পোস্টটির মন্তব্যের ঘরে লিখেন— আমিসহ আমার পরিবারের সবাই রোজ শাখা সিদুর পরে বের হই। কোথাও কোনও কিছুই হচ্ছে না। এইসব আজাইরা গপ্প বানানো বাদ দেন। বিরক্তিকর হয়ে গেছে এখন বিষয়গুলো। আপনারা এইসব ফালতু নিউজ করে বাংলাদেশি হিন্দুদের আরও ছোট করছেন!
পশ্চিমবঙ্গের শান্তনু রয় নামের একজন মন্তব্য করেছেন, ‘প্রথমত এই নিউজ চ্যানেলগুলি আছে যারা নিজেদের টিআরপি বাড়ানোর জন্য দেশে দাঙ্গা লাগায়।’ যদিও তার প্রোফাইলে গিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিদ্বেশমূলক বক্তব্য পাওয়া যায়।
এবিপি আনন্দের খবরে ‘সংখ্যালঘু নির্যাতনের’ যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তার মধ্যে কোনো ঘটনা বা নির্যাতনের স্পষ্ট কোনো বিবরণ নেই।
মহিলারা শাখা সিঁদুর পরে বেরোতে পারছে না। হিন্দু বুঝে গেলে সমস্যা। প্রচুর মেয়ে নিখোঁজ। বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। মৌলবাদীরা বাড়ি বাড়ি হামলা করছে। রাত্রিবেলা অত্যাচার করছে। চাকরি করলে ছাড়তে হবে। না হলে ধর্মান্তরণ করতে হবে। তালিবানি কায়দায় করা হচ্ছে— এমন অভিযোগটি বাংলাদেশি কারও নয়, কলকাতার বাসিন্দা অমরনাথ দত্তের। যিনি তার বাংলাদেশে থাকা আত্মীয়দের কাছে শুনেছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করে এবিপি আনন্দ।
কোনো ভুক্তভোগীর অভিযোগ ছাড়া এবং কোনো ঘটনার অভিযোগ করে থাকলেও তেমন কিছু ঘটেছে কি না, এর সতত্য যাছাই ছাড়া প্রতিবেদন প্রকাশকে বস্তুনিষ্ঠতা ও দায়িত্বশীলতার ঘাটতি বলছেন গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, এমন প্রতিবেদন প্রকাশ সংবাদমাধ্যমকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
এবিপি আনন্দের যাচাইবাছাই ছাড়া প্রকাশিত সংবাদটিতে আনা অভিযোগগুলোর একেকটি তারা তাদের ফেসবুকে পেজে পোস্ট দিচ্ছে কিছুক্ষণ পরপর। আর মন্তব্যের ঘরে শেয়ার দেয়া হচ্ছে ওই খবরটিই। এটিকে এজেন্ডাভিত্তিক সাংবাদিকতা বলছেন বাংলাদেশের অনেক সংবাদকর্মী। যে কারণে এই সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে, একই কারণে দেশটির গণমাধ্যমগুলোতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচারণা দেখা যাচ্ছে, যেসবের ভিত্তি নেই।
এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত এবিপি আনন্দের ফেসবুক পোস্টটিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটি ব্যবহারকারী ৪৫ হাজার জন তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। যার মধ্যে ৪১ হাজার জন হা হা প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। ১ হাজার ৩০০ জন রাগান্বিত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন।