চরম খাদ্য সংকটে মিয়ানমারের দেড় কোটি মানুষ
- আপডেট সময় : ০৪:৫৪:০৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪
- / ৩৬৪ বার পড়া হয়েছে
একসময় চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ মিয়ানমার এখন ভুগছে চরম খাদ্য সংকটে। দেশটিতে খাদ্য অনিশ্চয়তায় ভুগছে এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। জান্তা সরকার বেশ চালাকির সঙ্গে পুরো বিষয়টি গোপন করে যাচ্ছে। স্বেচ্ছাসেবী কোনো সংস্থাকেই মিয়ানমারে প্রকাশ্যে কাজ করতে দিচ্ছে না সেনাশাসিত জান্তা সরকার। দেয়া হচ্ছে প্রাণনাশের হুমকিও। সেনাবাহিনী আর বিদ্রোহীদের সংঘাতপূর্ণ এলাকাগুলোর অবস্থা সবচেয়ে করুণ। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য।
সম্প্রতি, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে কোনোরকমে জীবন নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন ৪৩ বছর বয়সী রোহিঙ্গা মোহাম্মদ মুন্না। জানিয়েছেন তার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা। রাখাইন রাজ্যের পাশাপাশি সেনাবাহিনী আর বিদ্রোহীদের সংঘাতে বিপর্যস্ত সব অঞ্চলেই সাধারণ মানুষের অবস্থা এমনই করুণ।
মুন্না বলেন, ‘ক্ষুধার্ত থাকতে বাধ্য হয়েছিলাম যে দিনগুলোতে, সে সময় কলাগাছের পাতা খেয়ে থেকেছি। ১০-১২ দিন খাওয়ার কিছু পাইনি। বাচ্চারা কাঁদছিল, ওদের কিছুই দিতে পারিনি।’
ইরাবতী নদীর অববাহিকায় থাকায় একসময় বিপুল পরিমাণ চালের উৎপাদন হতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মিয়ানমারে। দেশটিকে বলা হতো অন্নপূর্ণা। চালের এই স্বয়ংসম্পূর্ণতা এখন রূপ নিয়েছে ভয়াবহ খাদ্য সংকটে। পৃথিবীর সবচেয়ে করুণ খাদ্য সংকট এখন মোকাবিলা করছে দেশটি। যদিও পুরো বিষয়টি সুনিপুণ দক্ষতার সঙ্গে গোপন করে রেখেছে জান্তা সরকার।
সাম্প্রতিক সময়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন ভয়াবহ তথ্য। মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন জান্তা সরকার গবেষকদের কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে দিচ্ছে না, মানবিক সহায়তা কর্মীদেরও কোনো তথ্য প্রকাশ করতে দিচ্ছে না।
বিগত দুই বছর ধরে মিয়ানমারের লাখ লাখ সাধারণ মানুষ যে চরম ক্ষুধা সহ্য করে আছে, সেই খবর প্রকাশ না করতেও জান্তা সরকারের পক্ষ থেকে হুমকি দেয়া হচ্ছে।
মিয়ানমার ইস্যুতে স্বেচ্ছাসেবী, গবেষক, কূটনৈতিক আর জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। আইপিসি’র এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশের এক কোটি ৪৪ লাখ বা এক তৃতীয়াংশ মানুষই চরম খাদ্য অনিশ্চয়তায় ভুগছে। অনেকেই পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছেন না। আগামী বছরের মাঝামাঝি নাগাদ এই সংখ্যা দেড় কোটিতে পৌঁছাবে।
নাম পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বেচ্ছাসেবীরা দেশের মানুষের অপুষ্টি আর খাদ্য অনিশ্চয়তা নিয়ে দিয়েছে ভয়াবহ তথ্য। ভয়ে সেই তথ্য তারা তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেনি।
ভয় পাওয়ার কারণ, গেলো বছর খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বেশ কয়েকজন গবেষককে আটক করেছিল মিয়ানমারের জান্তা সরকার। সেই গবেষকদের খবরও আর পাওয়া যায়নি। জাতিসংঘ বলছে, অচিরেই এই অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তে পারে ২০ লাখ মানুষ।
যদিও জান্তা সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘকে বলা হয়েছে, দেশকে ইউক্রেন বা গাজার মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নিতে চায় না তারা। মিয়ানমারে কোনো খাদ্য সংকট নেই। আন্তর্জাতিক সব ত্রাণ সহায়তা দেশে প্রবেশ করছে বলেও দাবি সেনাশাসিত সরকারের।
২০২১ সালে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজেকে দেশের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং। এরপর থেকে জান্তা বাহিনী জনরোষে তো পড়ছেই, সেইসঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হয়েছে সেনাবিরোধী বিদ্রোহীদের উত্থান। জান্তা সরকার ধীরে ধীরে অনেক রাজ্যেই নিজেদের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। এই সংকটে ৩৪ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আরও বেড়েছে ক্ষুধা সংকট।
বেসরকারি সব সংস্থাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সেনাবাহিনীর অনুমতি নিয়ে কাজ না করলে কারাবন্দি করা হবে। কিন্তু বাস্তবে খাদ্য সংকট নিয়ে কোনো স্বেচ্ছাসেবীকে দেশটিতে কাজ করতে দেয়া হয় না। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দেশের সংকট নিয়ে কাজ করলে তাদের গ্রেপ্তার করা হবে, না হয় কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হবে। যে কারণে তথ্য সংগ্রহ করলেও তাদের গোপন রাখতে হয়।
এতো গোপনীয়তার পরও মিয়ানমারের খাদ্য সংকট নিয়ে অনেক তথ্যই প্রকাশ পেয়েছে। বিশ্বব্যাংক আর জাতিসংঘ তৈরি করেছে এসব প্রতিবেদন। যেখানে বলা হয়েছে, ক্ষুধা সংকট লাখ লাখ মানুষের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলছে।
দেশটিতে পুষ্টিজনিত তথ্য সংগ্রহও নিষিদ্ধ থাকায় সেনাবাহিনী আর বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘাত হচ্ছে, রাখাইনসহ এমন স্থানগুলোর সংকট নিয়ে গবেষণা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চল, বিশেষ করে রাখাইনে ত্রাণ সরবরাহও বন্ধ করে রেখেছে জান্তা সরকার।
গেলো এক বছরে জান্তা সরকার আর জান্তাবিরোধী গোষ্ঠীর ভয়াবহ সংঘাতে দেশটিতে খাদ্যপণ্যের দর মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। আমদানিতে বিধিনিষেধ থাকায় যোগ হয়েছে মূল্যস্ফীতি।
রাখাইনে গেলো বছর খাদ্যপণ্যের দাম দেড়শ’ শতাংশ বেড়েছে। ২০২১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত রাখাইন ১০ গুণ বেশি ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন সূত্রমতে, চলতি বছর রাখাইন ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়েছেন ৭০ হাজার রোহিঙ্গা।