ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং প্রয়াত

- আপডেট সময় : ১২:২০:০৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪
- / ৩৮৬ বার পড়া হয়েছে

গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে দিল্লি এইমসে প্রয়াত হয়েছেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। দেশের অর্থনৈতিক সংস্কারের রূপকারের প্রয়াণে শোকস্তব্ধ রাজনীতিকেরা। শাসক, বিরোধী নির্বিশেষে সকলে স্মরণ করছেন দেশ গঠনে তাঁর অবদানের কথা। গান্ধি পরিবার থেকে শুরু করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি-সহ সকল রাজনীতিকেরা তাঁর পাণ্ডিত্য এবং দেশের প্রতি অবদানের কথা তুলে ধরেছেন। মনমোহন সিংয়ের পাণ্ডিত্য এবং প্রশাসনে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা স্মরণ করেছেন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুও।
পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হবে। সূত্রের খবর, শনিবার অর্থাৎ ২৮ ডিসেম্বর মনমোহন সিংয়ের শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিংয়ের মৃত্যুতে কেন্দ্রীয় সরকার সাত দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ ২৬ ডিসেম্বর থেকে ১ জানুয়ারি পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সম্মানে সাত দিনের জন্য সমস্ত আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি বাতিল করেছে কংগ্রেস।
আজ, শুক্রবার বন্ধ থাকতে পারে সমস্ত সরকারি কর্মসূচি। সূত্রের খবর, সাত দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করতে পারে কেন্দ্র। পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হবে। কংগ্রেসের তরফে ইতিমধ্যে সাত দিনের জন্য সমস্ত দলীয় কর্মসূচি বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার বেশি রাতের দিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মরদেহ দিল্লি এইমস-এর থেকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
ড. মনমোহন সিং ১৯৩২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর অবিভক্ত ভারতের পঞ্জাব প্রদেশের গাহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এই অংশটি এখন পাকিস্তানে। দেশ ভাগ হলে মনমোহন সিংয়ের পরিবার অমৃতসরে এসে বসতি স্থাপন করে। পাকিস্তানের যে গ্রামে মনমোহন সিংয়ের জন্ম হয়েছিল সেখানে তাঁর নামে একটি স্কুলও রয়েছে। এটি ‘মনমোহন সিং গভর্নমেন্ট বয়েজ স্কুল’ নামে পরিচিত। এই স্কুলেই ডক্টর মনমোহন সিং তাঁর প্রাথমিক পড়াশোনা করেন। একসময় অন্ধকারে বসবাস করা এই গ্রাম বর্তমানে আলোর মুখ দেখেছে, একটি আদর্শ গ্রামে পরিণত হয়েছে। এখানকার মানুষের স্মৃতিতে ড. মনমোহন সিংয়ের নাম চির উজ্জ্বল থাকবে সন্দেহ নেই।
ড. মনমোহন সিং ১৯৪৮ সালে পঞ্জাবে ম্যাট্রিকুলেশন সম্পন্ন করেন। এর পর তাঁর শিক্ষাজীবন তাঁকে পঞ্জাব থেকে কেমব্রিজ, যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যায়, যেখানে তিনি ১৯৫৭ সালে অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণীতে অনার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। ড. সিং তারপর ১৯৬২ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নেফিল্ড কলেজ থেকে অর্থনীতিতে ‘ডি ফিল’ ডিগ্রি অর্জন করেন। মনমোহন সিংয়ের মেয়ে দামন সিং তাঁর বইয়ে বাবার তৎকালীন অবস্থার কথা লিখেছেন। জানিয়েছেন কীভাবে তাঁকে অর্থের অভাবের মুখে পড়তে হয়েছে। তার পরও ড. সিং সততা বিসর্জন দেননি। সম্ভবত এই পরিস্থিতি এবং জীবনসংগ্রামই ভারতের গভর্নর, অর্থমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের অর্থনীতিকে নতুন দিকনির্দেশনা দেওয়ার কাজে এসেছিল। মনমোহন সিং বরাবরই তাঁর সরল ও শান্ত স্বভাবের জন্য পরিচিত ছিলেন। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে ভারতকে উদারীকরণের পথে আনার জন্য তিনি সর্বদা স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
‘ভাবীকাল আমার বিচার করবে’
প্রধানমন্ত্রী হিসাবে বছরে একবার করে সাংবাদিক সম্মেলন করতেন মনমোহন সিং। তাছাড়া তিনি সাংবাদিকদের সামনে বিশেষ আসতেন না। শেষ সাংবাদিক সম্মেলন যখন হচ্ছে, তখন তার সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক কেলেঙ্কারির অভিয়োগ উঠেছে। কয়লা কেলেঙ্কারি, কমনওয়েলথ গেমস কেলেঙ্কারি-সহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে সরকার বিপর্যস্ত। মনমোহনের ব্যক্তিগত সততা নিয়ে কারো মনে কোনো প্রশ্ন না থাকলেও প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তার সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে এবং দুর্নীতির অভিয়োগ নিয়ে একাধিক প্রশ্ন হয়েছিল সেই সাংবাদিক সম্মেলনে।
মনমোহন সেই সময় বলেছিলেন, ”ভাবীকাল আমার কাজের বিচার করবে।” আশা করেছিলেন, ইতিহাস তাকে মনে রাখবে।
তারপরও তিনি রাজ্যসভার সদস্য থেকেছেন। দেশের অর্থনীতি নিয়ে কথা বলেছেন, পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে সোচ্চার থেকেছেন। প্রতিবার বাজেটের পর তিনি তার মতামত জানিয়েছেন।
‘অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’
২০০৪ সালে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ লোকসভা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। তখন কংগ্রেসের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সোনিয়া গান্ধী। কংগ্রেসের মধ্যে থেকে দাবি ওঠে, সোনিয়াকে প্রধানমন্ত্রী হতে হবে।
কিন্তু বিজেপি-সহ সঙ্ঘ পরিবারের জানায়, তারা কিছুতেই ‘বিদেশিনী’ সোনিয়াকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মানবে না। উমা ভারতী ঘোষণা করেন, সোনিয়া প্রধানমন্ত্রী হতে তিনি চুল কামিয়ে ফেলবেন। সুষমা স্বরাজও একই ঘোষণা করেন।
শেষপর্যন্ত সোনিয়া প্রধানমন্ত্রী হননি। তিনি জানিয়ে দেন, মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী হবেন। সোনিয়া সরকারেও আসেননি। মনমোহন দায়িত্ব নেয়ার পর বিজেপি অন্য সমালোচনা শুরু করে। তার পরের দশ বছর বিজেপি প্রচার করে, মনমোহন হলেন দেশের সবচেয়ে দুর্বল প্রধানমন্ত্রী এবং তার সময়ে প্রধানমন্ত্রীর অফিসকেই কেউ গুরুত্ব দেয় না। ক্ষমতার আসল চাবিকাঠি সোনিয়া গান্ধীর হাতে। তার কথাতেই সরকার চলে।
এই অভিযোগ নিয়ে আলোচনা কম হয়নি। মনমোহনের মিডিয়া পরামর্শদাতা সঞ্জয় বারুও অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার নামে একটা বই লিখে ফেলেন। তবে কংগ্রেস নেতারা বারবার বলেছেন, এটা বিজেপি-র নিছক প্রচার কৌশল। এর মধ্যে বিন্দুমাত্র সত্যতা নেই।
যাবতীয় অভিযোগ সত্ত্বেও মনমোহন ও সোনিয়ার মধ্যে পারষ্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্কে কখনো চিড় ধরেনি।
কিন্তু দুর্বল প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগ মনমোহনকে ব্যথিত করেছিল। প্রয়াত বিজেপি নেত্রী সুষমা স্বরাজ সেসময় লোকসভার বিরোধী নেতা। তার নেতৃত্বে বিজেপি সাংসদরা মনমোহনকে একটা স্মারকলিপি দিতে গিয়েছিলেন। সুষমা পরে জানান, মনমোহন সেই স্মারকলিপিতে চোখ বুলিয়ে সেটা টেবিলে ফেলে দিয়ে বলেছিলেন, তিনি এটা মানতে পারবেন না। সুষমার ধারণা ছিল, দুর্বল প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা শুনতে শুনতে মনমোহন দেখাতে চেয়েছিলেন, তিনি কঠিন হতেও জানেন।
মনমোহনের পররাষ্ট্রনীতি
মনমোহন সবসময় প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক চেয়েছেন। তিনি চাইতেন, আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে নিতে। তিনি পাকিস্তানের সঙ্গেও আলোচনার পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী হামলার পর সেই আলোচনার পথে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হ.য়নি।
বাংলাদেশের সঙ্গেও তিনি তিস্তা চুক্তি করে ফেলতে চেয়েছিলেন। খসড়াও তৈরি ছিল। কিন্তু মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায় বিরোধিতা করায় শেষ পর্যন্ত তা হয়নি।
তবে মনমোহনের আমলে অ্যামেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তি হয়েছিল, যার জেরে বামপন্থি দলগুলি তার সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নেয়। প্রকাশ কারাটের নেতৃত্বে বামপন্থিদের দাবি ছিল, অ্যামেরিকার সঙ্গে এই চুক্তি করা যাবে না। আর মনমোহনের বিশ্বাস ছিল, এই চুক্তিতে দেশের লাভ হবে. পারমানবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে যাবতীয় বাধা কেটে যাবে।
এই ক্ষেত্রে মনমোহন জানিয়ে দেন, বামেদের দাবি তিনি মানবেন না। তিনি চুক্তি করবেনই। বামেরা সমর্থন তুলে নেয়। তারপর সমাজবাদী পার্টি এবং অন্যদের সমর্থন নিয়ে সরকার টিকিয়ে রাখেন মনমোহন।
প্রধানমন্ত্রীর শোক
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সামাজিক মাধ্যম এক্সে জানিয়েছেন, ”মনমোহন সিং যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, আমি তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। সেই সময় তাদের মধ্যে বহুবার প্রশাসনিক বিষয়ে কথা হয়েছে। সবসময়ই তার জ্ঞান ও নম্রতার পরিচয় পেয়েছি। এই শোকের সময়ে আমি তার পরিবার ও অসংখ্য অনুগামীর পাশে আছি।”
কংগ্রেস সাংসদ প্রিয়াঙ্কা গান্ধী রাতেই এইমস যান। মনমোহনের মৃত্যুর পর তিনি বলেছেন, ”রাজনীতির দুনিয়ায় খুব কম মানুষই মনমোহন সিংয়ের মতো শ্রদ্ধা পান। যারা দেশের জন্য কাজ করবেন, দেশকে ভালোবাসবেন, তাদের কাছে মনমোহন অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন।”
রাহুল গান্ধী বলেছেন, ”মনমোহন সিং তার গভীর প্রজ্ঞা থেকে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার নম্রতা এবং অর্থনীতি সম্পর্কে জ্ঞান দেশকে অনুপ্রাণিত করবে। আমি আমার অভিভাবক ও পথপ্রদর্শককে হারালাম।”