সরকারি চাকরিতে পুলিশ ভেরিফিকেশন ছিল দলীয় কর্মী সংগ্রহের অস্ত্র!
- আপডেট সময় : ০১:২৪:১৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪
- / ৩৯৯ বার পড়া হয়েছে
কোটা না মেধা? লাখো তরুণের কণ্ঠে উচ্চারিত স্লোগান এটি। ১৭ বছরের শিক্ষাজীবন শেষে একটি সরকারি চাকরি পেতে রীতিমতো যুদ্ধ নামতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের। কোটার দাপট শেষে যে কয়টি চাকরি বেঁচে থাকতো মেধাবীদের জন্য, তাতেও প্রয়োজন হতো রাজনৈতিক পরিচয়ের। আর বয়সসীমা পার হয়ে গেলে অবশিষ্ট থাকতো বুক ভাঙা আর্তনাদ। শিক্ষার্থীরা বলছেন, রাজনীতিবিদরা পুলিশ ভেরিফিকেশনকে দলীয় কর্মী সংগ্রহের অস্ত্র হিসেবেই ব্যবহার করেছে।
শিক্ষাজীবন শেষে একটি সরকারি চাকরির অপেক্ষা। দিনরাত এক পড়ার টেবিলে। একে একে সরকারি চাকরি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে শুরু করেছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স মাস্টার্স শেষ করা আলামিন। এক দুই করে ২৬টি ভাইবার জন্য ডাক পেলেও অজানা কারণে বার বার ছিটকে পড়ছিলেন তিনি।
আলামিন বলেন, ‘ভাইভার আগে যে ভেরিফিকেশনগুলো হয় ওইগুলোতে আমার খুব ভালো পরীক্ষা এবং ভাইভা দেয়ার পরও কেমন যেন হচ্ছিল না। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ৩৫তম এসআই নিরস্ত্র এবং ডিজিএফআইয়ের একটা চাকরি। এই দুইটা চাকরি আমি আশাবাদী ছিলাম।’
ভালো লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা দেয়ার পরও কেন সরকারি চাকরি পাচ্ছিলেন না আলামিন? কারণ হিসেবে সামনে আসে ছাত্রদলের সংশ্লিষ্টতার কথা।
তিনি বলেন, ‘প্রশাসন কেন্দ্রীক যে চাকরিগুলো ছিল, সেগুলোতে আমার কাছে মনে হচ্ছিল যে ওরা অনেক বেশিকিছু জানতে চায়। যেমন আমার মাতৃকুল, পিতৃকুল। খুব ভালোভাবে জাজ করার চেষ্টা করতো বারবার, আমার জায়গা থেকে আমি আমার ক্লিয়ারেন্স দিতাম।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘পরিশ্রম করে সে তার যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাবে এটা সবচেয়ে বালো হবে এবং ভাইভাতে কোনো পক্ষপাতিত্ব করা হবে না সে যে দলেরই হোক। এটা অনেক ভালো একটা পদক্ষেপ হবে।’
অন্য একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘বৈষম্যটা দূর হোক। যেকোনো পরিচয় বা যেকোনো দলেই হোক না কেন ভেরিফিকেশনটা যেন অন্তত মেধার ভিত্তিতে হয়।’
সাধারণত চাকরি, পাসপোর্ট, লাইসেন্স, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ব্যবহার বা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে আবেদনকারীর দেয়া তথ্য সঠিক আছে কি না তা যাচাই করার পাশাপাশি প্রার্থীর চারিত্রিক ও সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে তথ্য যাচাই করতে পুলিশ ভেরিফিকেশন করা হয়। স্থানীয় থানার পুলিশ গোপনে বা প্রকাশ্যে প্রার্থীর উল্লিখিত ঠিকানায় সরজমিন তদন্ত করে থাকেন। পুলিশের তথ্য অনুসারে, ভেরিফিকেশনের সময় ২১টি বিষয় যাচাই করা হয়।
অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষক ড. মো. তৌহিদুল হক বলেন, ‘ব্যক্তি যে ঠিকানা দিয়েছেন সেটি ঠিক আছে কি না। এটা একটা মূল বিষয়। দ্বিতীয়ত তার নামে কোনো মামলা আছে কি না বা বড় ধরনের কোনো অভিযোগ আছে কি না। সেটি প্রয়োজনে দুই জায়গায় খতিয়ে দেখা উচিত। যেখানে স্থায়ী ঠিকানা আর তিনি যেখানে পড়াশোনা করেছেন সেই জায়গায়। এর বাইরে অন্যকিছু দেখতে যাওয়া মানেই হলো ওই ব্যক্তির মেধা বা তার যোগ্যতাকে ছোট বা খাট করে দেখা।’
পুলিশের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে বিব্রত বাংলাদেশ। গঠন হয়েছে পুলিশ সংস্কার কমিশন। কমিশন প্রধান বলছে, পুলিশ ভেরিফিকেশনের সংশোধনীর জন্য সুপারিশ করবে তারা। নাম পরিচয় এর পাশাপাশি চাকরি প্রার্থী কোনো মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বা নৈতিক স্খলনের রেকর্ড রয়েছে কি না পুলিশ ভেরিফিকেশনে এতটুকুই দেখা হবে। চাকরির প্রার্থীদের রাজনৈতিক পরিচয় না খোঁজার জন্য সুপারিশ করবে কমিশন।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফররাজ হোসেন বলেন, ‘পুলিশ ভেরিফিকেশন থাকবে তবে এভাবে থাকবে যে পুলিশ প্রথমে দেখবে যে এনআইডির ঠিকানা ঠিক আছে কি না। তার রাজনৈতিক পরিচয়, তার বাবার পরিচয় দেখার দরকার নেই। আর অতীতে শুনলাম যে দূরের আত্মীয় পর্যন্তও খোঁজ করা হতো। সুতরাং এখন এটা একেবারে সাধারণ হয়ে যাবে। অর্থাৎ এনআইডির ভিত্তিতে তদন্ত করা হবে।’
পুলিশ ভেরিফিকেশনকে নামে রাজনৈতিক অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ নতুন বাংলাদেশে আর না দেয়ার দাবি সাধারণ শিক্ষার্থীদের।