মারা গেলেন শুনশান দ্বীপের বাসিন্দা ‘রবিনসন ক্রুসো’
- আপডেট সময় : ০৩:২৫:২৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৫
- / ৩৪৫ বার পড়া হয়েছে
শুনশান দ্বীপের একমাত্র বাসিন্দা। দীর্ঘ ৩২ বছর সেভাবেই নিভৃতবাস। সেখান থেকে শহরে ফেরা সইল না শরীরে। মাত্র তিন বছরের মধ্যেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন ইতালির ‘রবিনসন ক্রুসো’, মাউরো মোরান্দি। ৮৫ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। তাঁর প্রয়াণে শোকের ছায়া নাগরিক সমাজে। (Mauro Morandi)
ছোটবেলায় পড়া গল্পের সঙ্গে জীবন মিলে যায় মাউরোর। তাই ইতালির ‘রবিনসন ক্রুসো’ হিসেবেই পরিচিত তিনি। তবে গল্পের নায়ক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে, অসহায় অবস্থায় ২৮ বছর নির্বাসন কাটিয়েছিলেন নির্জন দ্বীপে। বাস্তবের নায়ক মাউরো স্বেচ্ছায় ওই জীবন বেঁছে নিয়েছিলেন। দীর্ঘ ৩২ বছর একা, শুধুমাত্র নিজের সঙ্গে বসবাস করার সিদ্ধান্ত নেন। (Robinson Crusoe of Italy)
১৯৩৯ সালে মোদেনায় জন্ম মাউরোর। বাবা ছিলেন জিমন্যাস্ট, দেশের হয়ে নাম কুড়িয়েছিলেন তিনি। মা ছিলেন তামাক সংস্থায় কর্মরত। কয়েক বছরের মধ্যেই বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায় তাঁদের। পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষকতার চাকরি নেন মাউরো। সময়ের আগেই অবসর গ্রহণ করেন। ছোট থেকেই সমুদ্র টানতো মাউরোকে। নৌকা বেয়ে পলিনেশিয়া যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। ১৯৮৯ সালে ভূমধ্যসাগরের বুকে, সার্ডিনিয়ার উত্তরে বুদেলি দ্বীপটি চোখে পড়ে মাউরোর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দ্বীপটি সেনার আশ্রয়স্থল হয়ে উঠলেও, তার পর থেকে জনমানবহীন অবস্থাতেই পড়েছিল। জানা যায়, ১৯৮৯ সালে সমাজ-সংসার থেকে পালিয়েই যাচ্ছিলেন মাউরি। ভোগবিলাস, দেখনদারির জীবনে আর পোষাচ্ছিল না তাঁর।
সেই মতো নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন মাউরো। কিন্তু জলপথে হঠাৎই ওই দ্বীপে গিয়ে আটকে যায় তাঁর নৌকা আর তাতেই সবকিছু পাল্টে যায়। প্রথম দেখাতেই দ্বীপটির প্রেমে পড়ে যান তিনি। গোটা জীবন সেখানেই কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন। সেই কাজে সফলও হন মাউরি। দ্বীপের তৎকালীন কেয়ারটেকার মাউরোর হাতে দায়িত্ব ছেড়ে বেরিয়ে যান। এর পর একাই গোটা ওই দ্বীপটির কেয়ারটেকার হয়ে ওঠেন মাউরো। স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলেন নিজেকে। সকলের চোখের আড়ালে, নিজের জন্য অন্য এক জীবন গড়ে তোলেন।।
যে ৩২ বছর ওই দ্বীপে ছিলেন মাউরো, সেখানকার গোলাপি বালির সমুদ্রসৈকত একেবারে ঝকঝকে রেখেছিলেন তিনি। জল থেকে উঠে ডাঙায় বিশ্রাম করত কচ্ছপের দল। আবর্জনার টুকরো পর্যন্ত পড়ে থাকতে দেখা যেত না। কেউ কখনও সেখানে নামলে, নিজে দায়িত্ব নিয়ে সেখানকার বাস্তুতন্ত্র বোঝাতেন সেখানে সৌর বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেন তিনি। নিজের জন্য বাড়ি তৈরি করেন। সেভাবেই দীর্ঘ ৩২ বছর কাটিয়ে দেন।
বেশিদিন সুখ ছিল না কপালে। ওই দ্বীপের দখলদারি নিয়ে আইনি ঝামেলা শুরু হয়। লা মাদালেনা ন্যাশনাল পার্ক কর্তৃপক্ষ ওই দ্বীপের দখলদারি নিয়ে টানাপোড়েন শুরু হয় তাঁর। দ্বীপটিকে পরিবেশ শিক্ষার ভরকেন্দ্র করে তুলতে চেয়েছিলেন ন্যাশনাল পার্ক কর্তৃপক্ষ। মাউরো সেটিকে নিজের করে রেখে দিতে চেয়েছিলেন, মানুষের উপদ্রবের বাইরের রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রভাব-প্রতিপত্তি, এবং অর্থবল, দুই দিক থেকেই হেরে যান মাউরো। ২০২১ সালে ওই দ্বীপ থেকে বিতাড়ন করা হয় তাঁকে।
এর পর, লা মোদালেনায় ফিরে গিয়ে এক-শয্যার ছোট ফ্ল্যাট নেন। পড়ে গিয়ে আঘাত পাওয়ার পর গত বছর বৃদ্ধাশ্রমেও ছিলেন বেশ কিছু দিন। শহুরে জীবন একেবারেই পোষাচ্ছিল না তাঁর। জানিয়েছিলেন, লড়াই করতে করতে ক্লান্ত তিনি। ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাঁকে ওই দ্বীপ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে।
মাউরোকে নিয়ে বই লেখা হয়েছে, গান বোনা হয়েছে, তথ্যচিত্রও তৈরি হয়েছে। করোনার সময় যখন গোটা দুনিয়া ঘরবন্দি, সেই সময় একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “প্রচুর বই পড়েছি আমি। অনেক ভাবনা-চিন্তা ছিল। আমার মনে হয়, মানুষ বই পড়তে ভয় পান। কারণ যত বেশি পড়বেন, তত বেশি প্রশ্ন জাগবে মনে, অনেক ভাবনা-চিন্তা ভিড় করবে, যা তথাকথিত সমাজের জন্য বিপজ্জনক। কারণ সমালোচনা করলে, অন্য ভাবে ভাবলেই, জীবন ঘেঁটে যাবে।”
মাউরো বলতেন, “সহজ-সরল জীবনই ছোট-বড় প্রাপ্তি লুকিয়ে রয়েছে। সময়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে।” তিনি যেভাবে দ্বীপটিকে আগলে রেখেছিলেন, ভবিষ্যতে কেউ না কেউ সেই দায়িত্ব নেবেন বলে আশাবাদী ছিলেন। ২০২৩ সালে মাউরোর জীবনী লিখেছিলেন অ্যান্তোনিও রিনাল্দিজ। তিনি জানিয়েছেন, ৩ জানুয়ারি মোদেনায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন মাউরো। ব্রেন হ্যামরেজ হয়েছিল তাঁর।