প্রবাহ শুকিয়ে খরস্রোতা নদী তিস্তা এখন শুধুই বালুচর। অভিন্ন এ নদীর ভারতের অংশে বাঁধ নির্মাণ ও একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে উত্তরের জীবনরেখা তিস্তার এখন মরণদশা। এছাড়া এর প্রভাবে উত্তরের বড় নদ-নদীগুলো পানিশূন্য হওয়ায় নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। চর জেগে নদী রূপ নিচ্ছে ফসলি মাঠে। এমন অবস্থায় দখল, দূষণরোধ আর ভারতের সঙ্গে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় না করা গেলে নেমে আসতে পারে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়।
উত্তরে তিস্তার সঙ্গে এক অনবদ্য প্রেম ব্রহ্মপুত্রের। তাদের মিলন হয়েছে কুড়িগ্রামের চিলমারীতে। গাইবান্ধার ঘাঘট, কুড়িগ্রামের দুধকুমার, লালমনিরহাটের ধরলা, কানাঘুষায় মজেছিল রংপুরের চিকলিও।
এদিকে মাহিগঞ্জে আদি রংপুরের গোড়াপত্বন করে অভিমানে মুখ লুকিয়েছে ইছামতী। তার সঙ্গে করতোয়ার আর দেখা হবে না জেনে ত্রী স্রোতা নদী তিস্তা ভুলে গিয়েছে আত্রাই এবং পুনর্ভবা নদীকেও। কারণ কল্লোলিনী তিস্তার উর্মীশালা নেই, রয়ে গেছে কেবল কালের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি। নদীর বুকে এখন বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। মৌসুমি শস্যে ভরে গেছে নদীর পেট। তাই নদীর জৌলুস এখন কেবলই অতীত।
এদিকে আনন্দ নেই পঞ্চগড়ের মহানন্দাতেও। যতটুকু ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকা তা যেন কেবল এই পাথরজীবিদের প্রয়োজনেই। এছাড়া মহানন্দার দু:খ ছুঁয়েছে সৈয়দপুরের সর্বমঙ্গলা নদীকে। সৈয়দপুর শহর ঘেঁষা এ নদী অবৈধ দখলে প্রায় নিঃশেষ। অবশিষ্ট প্রস্থ মাত্র দুই ফুট। নদী গবেষকরা সর্বমঙ্গলার নাম দিয়েছেন পৃথিবীর সরুতম নদী। সর্বমঙ্গলার কপালেই আজ যত অমঙ্গল।
অভিন্ন নদীতে বাধ দিয়ে ভারতের পানি আটকিয়ে একদিকে যেমন গলা টিপে মেরে ফেলা হয়েছে উত্তরে নদ-নদীকে। অন্যদিকে দেশীয় দখল আর রাষ্ট্রীয় অবহেলায় করা হয়েছে নদীকে মেরে ফেলার সকল আয়োজন। কোথাও দখল, কোথাও দূষণ, কোথাও আবার নদীকে খাল দেখিয়ে দেয়া হয়েছে লিজ।
রংপুর উত্তরাঞ্চলের পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘উজান থেকে পলি এসে ভরাট হয়ে গিয়েছে। এখন নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা কমে গিয়েছে। এই কারণে অল্প বৃষ্টি হলেই আমাদের বন্যা দেখা দেয়। এইসব নদী খনন করলে আমরা বন্যা থেকে অনেকটা মুক্তি পাবো।’
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যানে রংপুর বিভাগে ২৭৭ টি নদীর নাম রয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, দিনাজপুর ও পঞ্চগড়ের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রায় বিশটি করে প্রায় চল্লিশটি নদী এখন পানিশূন্য। নীলফামারীর বড় নদীগুলো এখন মৃত। লালমনিরহাটের ১২-১৩টি নদ-নদীর কোনোটিই শুষ্ক মৌসুমে নদীর বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেঁচে থাকে না। একইভাবে গাইবান্ধা-ঠাকুরগাঁও ও রংপুরের নদ-নদীরও অবস্থাও সংকটাপন্ন। তাহলে নদী ও প্রকৃতির সঙ্গে মানবসভ্যতার যে নিবীড় সম্পর্ক তার ভবিষ্যতই কী?
বেরোবির ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মো. মোস্তাফিজার রহমান বলেন, ‘তিস্তা তো একটা নদী না, এইটা একটা সিস্টেম। তিস্তার সাথে অনেকগুলো শাখা নদী, উপনদী, বিল জড়িত ছিল। সম্পূর্ণ তিস্তার পানি ব্যবস্থা সিস্টেমই তো নষ্ট হয়ে গিয়েছে। স্যাটেলাইট ইমেজে দেখলে তিস্তা নদী খুঁজেই পাওয়া যায় না। হয়ত বর্ষার সময় একটু পানি আসে। এইটা কমবে না, প্রত্যেক বছর বাড়তে থাকবে।’
মৃতপ্রায় নদীতে প্রতিনিয়ত জাগছে চর। নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলায় ১১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তার বুকে বছরে অন্তত ১০০ চরে হচ্ছে মৌসুমি চাষাবাদ। একসময়ের খরস্রোতা তিস্তার বুকে যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই ফসলের খেত। বালু মাটির ওপর পলি জমায় ফলছে ধান, গম, আলু, ভুট্টা, কুমড়া, রসুন, পেঁয়াজ, মরিচসহ অনেক শস্য। কৃষি বিভাগের হিসেবে, ১১৫ কিলোমিটার তিস্তার বুকে এখন চরজমির সংখ্যা প্রায় ৯০ হাজার হেক্টর।
নদী গবেষক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘তিস্তা নদী শুষ্ক মৌসুমে ছিল ১ কিলোমিটার আর বর্ষার সময় দুই কিলোমিটার। এখন যে কোথাও ১০ কিলোমিটার আবার ১২ কিলোমিটার সেটা তো ভেঙে ভেঙে হয়েছে।’
রংপুর বিভাগের জীবনরেখা তিস্তা বো বটেই! উত্তরের শতাধিক এরও বেশি ছোট বড় নদ-নদী এখন পানিশূন্য। নদী নয় যেন পড়ে আছে স্রোতশ্বিনীর কঙ্কাল। যে জলে জীবন চলে, সে জলহীন নদী যেন উত্তরের পানি কেন্দ্রিক অর্থনীতিকে দিয়েছে অখণ্ড অবসর। রাষ্ট্রীয় আর নাগরিকদের যৌথ চেষ্টায় এসব নদ-নদীকে রক্ষা করা না গেলে জলবায়ু পরিবর্তনে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সবচেয়ে বড় খেসারত যে এ অঞ্চলের মানুষকেই দিতে হবে এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়।