যমুনায় রেলসেতু: সুফল পাবে কি রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ?
- আপডেট সময় : ০১:০১:১৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫
- / ৩৪২ বার পড়া হয়েছে
শূন্য বুকে দু’টি বাঁকা রেখায় দেশের উত্তর ও দক্ষিণ কূলের বিচ্ছেদ কালিমা পুরোপুরি ঘুচে যাচ্ছে বহতা যমুনায়। ত্বরান্বিত হতে যাচ্ছে দুই প্রান্তের যোগাযোগ ও অর্থনীতির গতিপথও।
যোগাযোগের সে নতুন দ্বার, ডুয়েলগেজ ডাবল ট্র্যাকে দৃশ্যমান হয়েছে দেশের বড় রেলসেতু। তিন বছরের বেশি সময়ে ১৬ হাজর ৭৮১ কোটি টাকায় নির্মিত এই সেতু এখন উত্তরের সাড়ে তিন কোটিরও বেশি মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।
বৃহৎ এই অবকাঠামোর ফলে, পশ্চিমাঞ্চল রেলের এক হাজার ৭০০ কিলোমিটার পথ ছুটে ৪২টি আন্তঃনগর, ছয়টি আন্তঃদেশিয় ও ১৮টি মালবাহী ট্রেনকে আর থেমে যেতে হবে না সিরাজগঞ্জের যমুনা পাড়ে। এ পথের রেলে গতির বাড়ায় পণ্য পরিবহন সুবিধা বাড়বে।
যোগাযোগে গতি আনতে যমুনায় রেলসেতু নির্মাণ হলেও এর পুরো সুফল পেতে বেগ পেতে হবে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জকে। নাটোরের আব্দুলপুর থেকে রাজশাহী ডাবল লাইন নির্মাণ না হলে বাণিজ্যিক সুবিধা পাবে না গুরুত্বপূর্ণ এই জেলার ব্যবসায়ীরা। এ পথে গতি আনতে দ্রুত ডাবল রেলপথ নির্মাণের দাবি স্থানীয়দের। পশ্চিমাঞ্চল রেল বলছে, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে যোগাযোগ ও অর্থনীতিতে উন্মোচিত হবে নতুন দ্বার।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আবদুল ওদুদ বলেন, ‘নতুন রেল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আমরা ভারত থেকে যেসব পণ্য আমদানি-রপ্তানি হবে, সেটা একেবারে আমরা ঢাকা পর্যন্ত নিয়ে গেতে পারবো। সেটা আমাদের বিরাট লাভবান হবে।’
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক মামুনুল ইসলাম বলেন, ‘সিরাজগঞ্জ থেকে আমরা আমাদের উত্তরাঞ্চলের যে জেলা আছে সেগুলোতে প্রায় ১২০ কিলোমিটার ঘুরে যেতে হয়। টাইমের সাথে মানির একটা সম্পর্ক আছে। এটা অর্থনৈতিক বিষয়। এ দিকে দেখলে এটা হলে এই অঞ্চলের আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নতি হবে।’
রেল যোগাযোগের এ সুবিধার সঠিক ব্যবহারে এখন থেকেই পরিকল্পনা আঁকছেন রাজশাহী অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা।
রাজশাহী চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মাসুদুর রহমান রিঙ্কু বলেন, ‘আমাদের যমুনা রেল সেতু চালু হয়ে গেলে এটার উপর আমাদের জিএমদের সাথে বসতে হবে। কারণ এই অঞ্চলে যে ট্রেনের বগিগুলো দিবে সেগুলোতে আমরা ব্যবসার জন্য কীরকম সুযোগ-সুবিধা পাবো।’
রেলগাড়ির এই গতিময় সেতুকে ঘিরে উত্তরের মানুষের স্বপ্ন বেড়েছে অনেকগুণ। পণ্যের পরিবহন হবে, এই অঞ্চলে বাড়বে শিল্পের বিনিয়োগ, একইসাথে রাজশাহী থেকে কনটেইনার ট্রেন চলবে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত। পাশাপাশি কক্সবাজার পর্যন্ত এক্সপ্রেস ট্রেনের প্রত্যাশা এই অঞ্চলের মানুষের। তবে বাস্তবতা কি বলছে?
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক মামুনুল ইসলাম বলেন, ‘যমুনা সেতু হওয়ার প্রেক্ষিতে আমাদের ট্রেন বাড়ানো সম্ভব হবে না। কারণ অনেকগুলো ফ্যাক্টরের উপর নির্ভর করে। আমাদের ২০৪৫ সাল পর্যন্ত একটা মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হয়েছে। ওখানে ফেস বাই ফেস ইউনিগেজে চলে যাওয়ার একটা সম্ভবনা আছে। স্পেশালি দু’টি বন্দরের সাথে কানেকশন করা। অলরেডি আমরা মংলা বন্দরের সাথে কানেকশন করে ফেলেছি। পোর্ট ফ্যাসিলিটিস পাওয়ার কারণে দু’টি প্রজেক্টই আমাদের পাইপলাইনে আছে।’
সেই সাথে যমুনা রেল সেতু থেকে নাটোরের আব্দুলপুর জংশন পর্যন্ত প্রায় ৯১ কিলোমিটার পথ। যার মধ্যে মাত্র ২০ কিলোমিটারে আছে ডাবল রেল। পাশাপাশি এ পথে ৬৬টি ট্রেনকে পাসিং করতে গতি হারায় ট্রেন, নষ্ট হয় সময়। তাতে বাণিজ্যিক সুবিধা খুব বেশি হবে না বলছে ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ রেশম শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি লিয়াকত আলী বলেন, ‘সারাদেশের অন্তত বিভাগগুলোতে যদি আমরা সরাসরি পৌঁছাতে পারতাম তাহলে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক যে দুরবস্থা সেটা কিন্তু লাঘব হতো।’
রহমান জুটমিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচলাক ফজলুর রহমান বলেন, ‘জুটমিলের যে প্রোডাক্টগুলো আমরা এক্সপোর্ট করি সেটা তো রাজশাহী থেকে একেবারে চট্টগ্রাম পোর্ট পর্যন্ত পৌঁছাতে হয়। স্টেশনে আনলোড করে দেখা গেল আবার পোর্ট পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে, তাহলে কেয়ারিং খরচ ডাবল হেয় যাবে। সেজন্য পরিবহনের ক্ষেত্রে এটা আমাদের খুব একটা লাভ হবে না।’
আর এক যুগ ধরে রাজশাহী-আব্দুলপুর ডাবল রেল প্রকল্প এখনও রয়েছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা পর্যায়ে তাতে আশাহত এ অঞ্চলের বিশিষ্ট নাগরিকরা। প্রকল্প নিয়ে অনিশ্চয়তায় পশ্চিমাঞ্চল রেল কর্তৃপক্ষও।
রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খাঁন বলেন, ‘এক যুগের উপরে আমরা কিন্তু সরকারকে জানিয়ে আসছি যে, রাজশাহী অঞ্চলে ডাবল লাইনটা দিতে হবে। এটা না হলে কিন্তু ব্রিজ যেটা হচ্ছে বাস্তবায়ন হলেও আমরা মনে করি যে আমাদের সুযোগ-সুবিধা থেকে আমরা বঞ্চিত হবো।’
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক মামুনুল ইসলাম বলেন, ‘রাজশাহী থেকে আব্দুলপুর ভিজিবিলিটি চলছে। অলরেডি কিছু রিপোর্ট সাবমিট করা হয়েছে। প্রাথমিক একটা ধাপ বা ফান্ডিং সার্চ করার স্টেপ আমরা নিয়েছি।’
ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো বলছে, যমুনা রেলসেতু পারাপারে গতি আসলেও দুর্বল রেলপথের কারণে এখনই সে সুবিধা পাবে না রাজশাহী অঞ্চল।
উত্তরের ভূগোলে পকেটে থাকা রাজশাহী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের জন্য যমুনা রেলব্রিজের পূর্ণ সেবা পেতে প্রয়োজন আব্দুলপুর থেকে রাজশাহী পর্যন্ত ডাবল রেলের। তবে সে প্রকল্প কবে নাগাদ বাস্তবায়ন হবে, তা যেমন নিশ্চিত নয়, যমুনা রেলসেতুর পূর্ণ সেবাও নিশ্চিত নয় রাজশাহী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাসিন্দাদের জন্য। তাই পূর্ণ সেবার অপেক্ষায় দুই অঞ্চলের মানুষরা।