পুলিশি বর্বরতায় সরাসরি রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ছিল: এইচআরডব্লিউ
- আপডেট সময় : ০১:৫৮:৫৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৮ জানুয়ারী ২০২৫
- / ৩৬১ বার পড়া হয়েছে
গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশি বর্বরতায় সরাসরি রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ছিল বলে মন্তব্য করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
সোমবার (২৭ জানুয়ারি) প্রকাশিত এক রিপোর্টে এই তথ্য জানিয়েছে সংস্থাটি। এছাড়া গত বছরের ওই আন্দোলনের সময় পুলিশের ভূমিকা মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের চেয়ে রাজনৈতিক নেতারা বেশি নির্ধারণ করে দিতেন বলেও রিপোর্টে উঠে এসেছে।
এমনকি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দীর্ঘদিন ধরে দায়মুক্তির ব্যবস্থা থেকে উপকৃত হওয়া শক্তিশালী এবং রাজনৈতিক নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে অন্তর্বর্তী সরকার লড়াই করছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে এইচআরডব্লিউ-এর ৫০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। সংস্থাটি বলছে, পুরোনো নিপীড়নমূলক ভূমিকায় ফিরেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, যা বাংলাদেশের জন্য সংকট ডেকে আনবে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া ডিরেক্টর ইলেইন পিয়ারসন বলেছেন, “গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে গিয়ে প্রায় ১০০০ বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছেন। এটি বাংলাদেশে অধিকার-সমৃদ্ধ ভবিষ্যত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী সুযোগের সূচনা করেছে। কঠিন এই লড়াইয়ে জয়ের মাধ্যমে অর্জন করা সব অগ্রগতি হারিয়ে যেতে পারে যদি অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত এবং কাঠামোগত সংস্কার না করে। কাঠামোগত এমন সংস্কার করতে হবে যা ভবিষ্যত সরকারের যেকোনও দমন-পীড়নকে প্রতিরোধ করতে পারে।”
“আফটার দ্য মনসুন রেভোলিউশন: এ রোডম্যাপ টু লাস্টিং সিকিউরিটি সেক্টর রিফর্ম ইন বাংলাদেশ” শিরোনামের এই প্রতিবেদনে বিশদ বিবরণ দেওয়া হয়েছে যে— অতীতে কীভাবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং নিরাপত্তা বাহিনী সবসময় রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।
এদিকে বলপূর্বক গুমের সাথে জড়িত কর্মকর্তারা এইচআরডব্লিউকে আরও বলেছেন, শেখ হাসিনা বা তার সরকারের সিনিয়র সদস্যরা এই ধরনের অসংলগ্ন আটকের বিষয়ে অবগত ছিলেন এবং কিছু ক্ষেত্রে হাসিনা সরাসরি বলপূর্বক গুম বা হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
নিরাপত্তা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা এইচআরডব্লিউকে বলেছেন, আবদুল্লাহিল আমান আজমির আটক এবং গোপন আটককেন্দ্রে থাকা অবস্থায় তার স্বাস্থ্য খারাপ হওয়ার বিষয়ে হাসিনা সরাসরি অবগত ছিলেন। তিনি বলেন, আজমি সাবেক সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে তার সহকর্মী হওয়ায় তিনি শেখ হাসিনার কাছে তাকে (আজমিকে) মুক্তি দেওয়ার অনুমতি চেয়েছিলেন, কিন্তু প্রতিবার তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন হাসিনা।
তিনি এইচআরডব্লিউর কাছে দাবি করেছেন, হাসিনা এমনকি আজমিকে হত্যা করার পরামর্শও দিয়েছেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, “আমি তা করিনি। কিন্তু আমি তার মুক্তির বিষয়ে (হাসিনার কাছে) আবেদন করা বন্ধ করে দিয়েছিলাম।”
অন্য একজন কর্মকর্তা বলেন, “আমার ১০-১১ বছরের চাকরি জীবনে, আমি র্যাবের হাতে গুম ও হত্যার ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি। এগুলো বাস্তব। র্যাব যে গুম ও ক্রসফায়ারে জড়িত তা পুলিশ সদর দপ্তরের বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বা বিশেষ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুমোদন ছাড়া অসম্ভব।”
রিপোর্টে বলা হয়েছে, “এছাড়াও নিরাপত্তা বাহিনী জোপূর্বক গুমের বিষয়ে নতুন গঠিত তদন্ত কমিশনের তদন্তে বাধা দিচ্ছে বলে উদ্বেগজনক ইঙ্গিত রয়েছে। কমিশনের সদস্যরা বলেছেন, তারা বেআইনিভাবে আটকের আটটি নতুন স্থান শনাক্ত করেছেন। গোপন এই আটকস্থানের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন প্রমাণাদি নিরাপত্তা বাহিনী ধ্বংস করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে বলেও উদ্বেগ রয়েছে।”
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলো তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে চলেছে। এইচআরডব্লিউ জুলাই এবং আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে দায়ের করা আটটি ফার্স্ট ইনফরমেশন রিপোর্ট (এফআইআর) পর্যালোচনা করেছে, যার মধ্যে হাসিনা ও আওয়ামী লীগের মন্ত্রীসহ ২৯৭ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং অজ্ঞাত ব্যক্তি রয়েছেন ৬০০ জন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “জবাবদিহিমূলক শাসন ব্যবস্থায় পদ্ধতিগত বাধার কারণে নিরাপত্তা বাহিনীর অপব্যবহার এবং রাজনৈতিক প্রতিশোধের বিরক্তিকর পরিচিত প্যাটার্ন পুনরায় আবির্ভূত হয়েছে, আর এবার সেটি আওয়ামী লীগ সমর্থকদের লক্ষ্য করে “
“উদাহরণস্বরূপ, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে প্রথম দুই মাসে হত্যা, দুর্নীতি বা অন্যান্য অপরাধের অভিযোগে কয়েক হাজার লোকের বিরুদ্ধে, প্রধানত আওয়ামী লীগের সদস্যদের বিরুদ্ধে এক হাজারের বেশি পুলিশ মামলা দায়ের করা হয়েছে,” প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিপুল সংখ্যক “অজ্ঞাত” লোকের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক অভিযোগ দায়ের করে চলেছে। এর মাধ্যমে কার্যত পুলিশকে প্রায় যে কাউকে গ্রেপ্তার করতে এবং বারবার আটক ব্যক্তিদের পুনঃগ্রেপ্তার করার ক্ষমতা দেয় যদিও তারা কোনও মামলায় আসামি না হযেও থাকে।”
এইচআরডব্লিউ জানিয়েছে, মনসুন বা বর্ষা বিপ্লবের সময় হাসিনা সরকারকে নিজেদের রিপোর্টিংয়ে মাধ্যমে সমর্থন করার জন্য পুলিশ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ আনছে। গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত, কর্তৃপক্ষ বর্ষা বিপ্লবের বিষয়ে প্রতিবেদন করার জন্য কমপক্ষে ১৪০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ দায়ের করেছে। এইচআরডব্লিউ আমজাদ হোসেন এবং নিজাম উদ্দিন নামে দু’জন স্বাস্থ্যসেবা কর্মীর সাথেও কথা বলেছে, যারা ছাত্র বিক্ষোভের সময় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন এবং ছাত্র বিক্ষোভকারী ওয়াসিম আকরামকে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন।
এইচআরডব্লিউ এর এই প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারকে আইন প্রয়োগের তত্ত্বাবধানে থাকা কর্মীদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাঠামোগত সংস্কারের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
এছাড়া প্রসিকিউশন এবং বিচার বিভাগ যাতে নির্বাহী বিভাগ থেকে স্বাধীন এবং রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ থেকে সুরক্ষিত থাকে তা নিশ্চিত করার জন্যও সরকারকে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক এই মানবাধিকার সংস্থা।