তিন বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়ে গেলেও রাশিয়ার অর্থনীতিতে যেন বইছে প্রবৃদ্ধির ফুলঝুরি। আন্তর্জাতিক অঙ্গণে এই ইমেজ ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করলেও যুদ্ধে মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ করে রাশিয়া ক্রমেই পরিণত হতে যাচ্ছে তলাবিহীন ঝুড়িতে। বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধে অর্থ ব্যয়ের কারণে অসনীয় চাপ পড়ছে রুশ অর্থনীতিতে। যা কোনভাবেই স্বীকার করছে না রাশিয়া।
২০২২ সালে ইউক্রেনে পুরোদমে আগ্রাসন শুরুর পরও রাশিয়ার অর্থনীতিতে সেই আঁচ লাগেনি। যুদ্ধ পরিচালনা করেও গেল বছর যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপের শীর্ষ অর্থনীতির দেশগুলোর তুলনায় বেশ ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে দেশটিতে। বেকারত্ব হারও কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। প্রতিরক্ষা বাজেটের কারণে যদিও অভ্যন্তরীণ ব্যয়ে কাটছাঁট করতে হচ্ছে, সেটাও সীমিত।
ইউক্রেনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ আর পশ্চিমাদের সঙ্গে পরোক্ষ এই যুদ্ধ চালিয়েও অর্থনীতির এই স্থিতাবস্থা নিজ দেশের নাগরিক, প্রতিবেশী এমনকি পুরো বিশ্বের জন্য বার্তা রাশিয়া এখনও দাঁড়িয়ে আছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এই বার্তা দিলেও বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়া দেখাচ্ছে শুধু ইতিবাচকটাই।
অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়া নিজেদের অর্থনীতি নিয়ে মরীচিকার মতো অবস্থান তৈরি করে রেখেছে। এই দেশের প্রবৃদ্ধি দ্রুতগতিতে হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এই প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল নয়। খুব দ্রুতই এই সমস্যা দৃশ্যমান হবে বলে মনে করছেন তারা। কারণ রাশিয়ার মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, সুদের হার দুই দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ বাড়ানোর পর।
ইগর লিপসিটস অর্থনীতি বিশ্লেষক বলেন, ‘রাশিয়ার মূল্যস্ফীতি অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। যা থেকে বের হওয়ার উপায় নেই। আপনি অর্থ ব্যয় করবেন, কিন্তু তাতে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যাবে। অর্থের প্রবাহ কমে গেলে আবার প্রবৃদ্ধি কমে যাবে।’
মার্কিন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের পর নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষরের সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, রাশিয়ার অর্থনীতি বড় সংকটের মধ্যে রয়েছে। ইউক্রেন ইস্যুতে চুক্তি না করে রাশিয়াকে ধ্বংস করছেন পুতিন। বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধক্ষেত্রে অপ্রতিরোধ্য থাকলেও দেশের অর্থনীতিতে যে চাপ পড়ছে, তা সামাল দিতে দ্রুতই আলোচনার টেবিলে বসতে হবে পুতিনকে।
কিন্তু এই আলোচনার আগে পশ্চিমাদের সঙ্গে খেলছেন পুতিন। কিয়েভকে সামরিক সহায়তা দিতে গেলেই চড়াও হচ্ছে মস্কো। সমরাস্ত্র সরবরাহ করতে গিয়েও অনেক সময় পিছিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমারা। একইভাবে অর্থনীতি নিয়ে একই কৌশলে এগোচ্ছেন পুতিন। বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়া যদি বছরের পর বছর যুদ্ধে অর্থ ব্যয় করতে পারে, যুক্তরাষ্ট্র হয়তো একটা পর্যায়ে গিয়ে ইউক্রেনকে যুদ্ধবিরতিতে আসতে বলবে, যেটা ক্রেমলিনের পক্ষে যাবে।
যুদ্ধে বিনিয়োগ নিয়ে বরাবরই লুকোচুরি করছে রুশ প্রশাসন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বলছে, সামরিক খাতে বিনিয়োগের জন্য বিভিন্ন ব্যাংক কে বাধ্য করা হচ্ছে ঋণ দিতে। ২০২৪ সালের শেষদিকে, দেশটিতে ব্যক্তিগত ঋণ ৭১ শতাংশ বেড়েছে। এরমধ্যে ৬০ শতাংশই গেছে যুদ্ধ-সংক্রান্ত নানা প্রতিষ্ঠানে। এতে করে প্রতিষ্ঠানগুলো যেকোন সময় হয়ে পড়তে পারে ঋণখেলাপি, ব্যাংকগুলোতেও দেখা দিতে পারে তারল্য সংকট।
ইগর লিপসিটস বলেন, ‘রাশিয়ার অর্থ ভাণ্ডার সংকুচিত হচ্ছে। জাতীয় বাজেট কমছে। মন্ত্রণালয় ঘোষণা করে দিয়েছে চলতি বছর অনেক বাজেট ঘাটতি হবে। তারা করও বাড়িয়ে দেবে। অনেক কোম্পানি কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে পারে।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, পুতিন এখন ফিন্যান্সিয়াল টাইম বোমের ওপরে আছেন। মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কে ছুঁইছুঁই। ইউক্রেনে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সেনাবাহিনীতে সমানে সদস্য নিয়োগ দেয়ায় কর্মী সংকট পৌঁছেছে চরমে। বিশ্লেষকরা বলছেন, মস্কো কোনভাবেই একসঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে পারবে না। ভবিষ্যতেও কঠিন সংকটের মুখে পড়তে হবে।