ঢাকা ০৯:৫০ অপরাহ্ন, শনিবার, ০১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১৯ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

অবহেলা-দূষণে প্রাণহীন হয়ে উঠছে নদীর পানি

অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট সময় : ০৩:৩৮:৩৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • / ৩৪৯ বার পড়া হয়েছে
৭১ নিউজ বিডির সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

দেশের নদীর প্রতি মানুষের অবহেলা এবং নিরন্তর দূষণ আজ এক করুণ চিত্রের জন্ম দিয়েছে। ঢাকাকে ঘিরে রাখা বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর পানি এক সময় ছিল অমৃতধারা, আজ তা কেবল বিষাদময় স্রোত। যে নদী ছিল জীবনের প্রাণশক্তি, সমৃদ্ধির প্রতীক, আজ সেগুলিই মৃতপ্রায়। নদীর পানি হয়ে উঠেছে প্রাণহীন। পরিবেশগত এমন বিপর্যয় মানবজীবনের জন্যও মহাবিপদ হয়ে উঠছে। তাই আগামী প্রজন্মের জন্য এখন থেকেই নদীকে বাঁচাতে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

ছল ছল শব্দ, দূর-দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি এনে দেয় নির্মল প্রশান্তি। একটা সময় মাছের অভাব দেখেনি জেলে পরিবার। কৃষকের ছিল না পানির অভাব। এই অঞ্চলে সর্বত্রই ছিল সুপেয় পানি।

প্রায় নিষ্প্রাণ নদীতে কান পেতে এখন আর টের পাওয়া যায় না ঢেউয়ের ধ্বনি। নেই আল মাহমুদের সে নদী, যে নদীর শরীর ভরা বোয়াল মাছে। নদীর আশ্রয়ে গড়ে উঠেছে যে শহর, সেই শহরই যেন নদীকেই মেরেছে তিলে তিলে।

দোলাই নদী হয়ে ঢাকাকে আশ্রয় দিয়েছে যে বুড়িগঙ্গা, তার গর্ভে নেই প্রাণের অস্তিত্ব। পানির রঙ হয়েছে কালচে-দুর্গন্ধময়। নগরীর চারপাশের তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যার প্রায় একই দশা।

পরিবেশ অধিদপ্তরের সমীক্ষায় উঠে এসেছে, প্রতিদিন রাজধানীর চারপাশের নদীগুলোতে প্রায় সাড়ে চার হাজার টন বর্জ্য ও ৫৭ লাখ গ্যালন দূষিত পানি ফেলা হয়।

গবেষণায় দেখা যায়, বুড়িগঙ্গার পানি দূষণের ৩৫ শতাংশ আসে ট্যানারি থেকে। মাত্রাতিরিক্ত দূষণের ফলে রাসায়নিক বর্জ্য নদীর পানি থেকে ভূগর্ভস্থ বিশুদ্ধ পানিতে ঢুকছে প্রতিনিয়ত।

গেল ৫ বছরে পানির রঙের মতই বদলেছে জেলের জীবন। তবু এখনো মাছের আশায় জাল পাতেন অনেকে। তবে বারবার হতাশ হয়েই ফিরতে হয় তাদের।

নদীর অবৈধ দখল, পরিবেশ দূষণ আর অনিয়ম বন্ধে ২০১৪ সালে গঠিত হয় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। ২০১৯ সালে, ৩ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট একটি রায়ে নদীকে জীবন্ত সত্তা বলে আদেশ জারি করা হয়। এরপর নদী রক্ষার জন্য নানা প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে কোটি কোটি টাকা। এরপরও কেন কমছে না নদী দূষণ?

পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, ‘ক্রোমিয়াম অত্যন্ত ক্ষতিকর জিনিসভ। সেটা অপসারণের কোনো প্ল্যান ছিল না। সলিড ওয়েস্ট অপসারণের কোনো পরিকল্পনা ছিল না। আমি এক সময় ওই প্রজেক্টের যে পিডি ছিল তার সাথে দেখা হয়েছে। আমি বললাম যে, তোমরা এটা করলা কী করে? তো বলে স্যার এটাই তো করতে পারছিলাম না। সবচেয়ে বড়লোক এলাকা গুলশান, বারিধারা, বনানী। এখানকার প্রত্যেকটা সুয়ারেজ লাইন লেকের সাথে কানেক্টেড। আগে এ বড় সাহেবদের ধরেন। মন্ত্রী, এমপি, বিজনেস ম্যানরা যেখানে থাকে সে জায়গাটা পরিষ্কার করেন, যে ইন্ডাস্ট্রি পলিউট করছে তার সুযোগ সুবিধা বন্ধ করে দেন।’

সংবিধানে নদীকে জনসম্পদ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হলেও সরকারের সদিচ্ছার যথেষ্ট অভাব রয়েছে বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা।

অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, ‘১৮ (ক) এর যে ধারা আছে, সেখানে বলা হচ্ছ রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি ইত্যাদি ইত্যাদি রক্ষা করা। এ আইন কার্যকরের সময় পার্লামেন্টে যিনি বড় কর্তা ছিলেন তখন সংসদ সদস্যরা এর থেকে নদী শব্দটা কেটে দিয়েছিল। অর্থাৎ রাষ্ট্র যারা চালায় তারা চান না নদীকে রক্ষা করা হোক।’

বেসরকারি গবেষণা বলছে, দূষণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়ছে নদী তীরবর্তী মানুষের জীবন, সেইসাথে কৃষি, জলজ স্বাস্থ্য, জনস্বাস্থ্য ও বিশুদ্ধ খাবার পানির যোগানও হুমকির মুখে।

মানবজীবনের জন্যও এক মহাবিপদ হয়ে উঠছে নদী দূষণে। বাড়ছে চর্মরোগ, শ্বাসকষ্ট, ক্যানসারসহ নানারকম রোগ।

সেন্টার ফর অল্টারনেটিভের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘জনগণ তাকেই লিডার করবে যখন তার মানসিকতা তাদের কাছাকাছি যাবে। কিন্তু এখানে যেটা সমস্যা হয়ে গেছে মন মানসিকতার মধ্যে আমরা যেটা বলি নদীমাতৃক দেশ সে জায়গায় এখনো যেতে পারি নি।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, কঠোর আইনের প্রয়োগ, জনগণের সচেতনতা ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছাই পারে নদীকে আগের রূপে ফিরিয়ে নিতে। তা না হলে আরও হুমকি পড়বে প্রাণ-প্রকৃতি।

নিউজটি শেয়ার করুন

অবহেলা-দূষণে প্রাণহীন হয়ে উঠছে নদীর পানি

আপডেট সময় : ০৩:৩৮:৩৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

দেশের নদীর প্রতি মানুষের অবহেলা এবং নিরন্তর দূষণ আজ এক করুণ চিত্রের জন্ম দিয়েছে। ঢাকাকে ঘিরে রাখা বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর পানি এক সময় ছিল অমৃতধারা, আজ তা কেবল বিষাদময় স্রোত। যে নদী ছিল জীবনের প্রাণশক্তি, সমৃদ্ধির প্রতীক, আজ সেগুলিই মৃতপ্রায়। নদীর পানি হয়ে উঠেছে প্রাণহীন। পরিবেশগত এমন বিপর্যয় মানবজীবনের জন্যও মহাবিপদ হয়ে উঠছে। তাই আগামী প্রজন্মের জন্য এখন থেকেই নদীকে বাঁচাতে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

ছল ছল শব্দ, দূর-দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি এনে দেয় নির্মল প্রশান্তি। একটা সময় মাছের অভাব দেখেনি জেলে পরিবার। কৃষকের ছিল না পানির অভাব। এই অঞ্চলে সর্বত্রই ছিল সুপেয় পানি।

প্রায় নিষ্প্রাণ নদীতে কান পেতে এখন আর টের পাওয়া যায় না ঢেউয়ের ধ্বনি। নেই আল মাহমুদের সে নদী, যে নদীর শরীর ভরা বোয়াল মাছে। নদীর আশ্রয়ে গড়ে উঠেছে যে শহর, সেই শহরই যেন নদীকেই মেরেছে তিলে তিলে।

দোলাই নদী হয়ে ঢাকাকে আশ্রয় দিয়েছে যে বুড়িগঙ্গা, তার গর্ভে নেই প্রাণের অস্তিত্ব। পানির রঙ হয়েছে কালচে-দুর্গন্ধময়। নগরীর চারপাশের তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যার প্রায় একই দশা।

পরিবেশ অধিদপ্তরের সমীক্ষায় উঠে এসেছে, প্রতিদিন রাজধানীর চারপাশের নদীগুলোতে প্রায় সাড়ে চার হাজার টন বর্জ্য ও ৫৭ লাখ গ্যালন দূষিত পানি ফেলা হয়।

গবেষণায় দেখা যায়, বুড়িগঙ্গার পানি দূষণের ৩৫ শতাংশ আসে ট্যানারি থেকে। মাত্রাতিরিক্ত দূষণের ফলে রাসায়নিক বর্জ্য নদীর পানি থেকে ভূগর্ভস্থ বিশুদ্ধ পানিতে ঢুকছে প্রতিনিয়ত।

গেল ৫ বছরে পানির রঙের মতই বদলেছে জেলের জীবন। তবু এখনো মাছের আশায় জাল পাতেন অনেকে। তবে বারবার হতাশ হয়েই ফিরতে হয় তাদের।

নদীর অবৈধ দখল, পরিবেশ দূষণ আর অনিয়ম বন্ধে ২০১৪ সালে গঠিত হয় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। ২০১৯ সালে, ৩ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট একটি রায়ে নদীকে জীবন্ত সত্তা বলে আদেশ জারি করা হয়। এরপর নদী রক্ষার জন্য নানা প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে কোটি কোটি টাকা। এরপরও কেন কমছে না নদী দূষণ?

পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, ‘ক্রোমিয়াম অত্যন্ত ক্ষতিকর জিনিসভ। সেটা অপসারণের কোনো প্ল্যান ছিল না। সলিড ওয়েস্ট অপসারণের কোনো পরিকল্পনা ছিল না। আমি এক সময় ওই প্রজেক্টের যে পিডি ছিল তার সাথে দেখা হয়েছে। আমি বললাম যে, তোমরা এটা করলা কী করে? তো বলে স্যার এটাই তো করতে পারছিলাম না। সবচেয়ে বড়লোক এলাকা গুলশান, বারিধারা, বনানী। এখানকার প্রত্যেকটা সুয়ারেজ লাইন লেকের সাথে কানেক্টেড। আগে এ বড় সাহেবদের ধরেন। মন্ত্রী, এমপি, বিজনেস ম্যানরা যেখানে থাকে সে জায়গাটা পরিষ্কার করেন, যে ইন্ডাস্ট্রি পলিউট করছে তার সুযোগ সুবিধা বন্ধ করে দেন।’

সংবিধানে নদীকে জনসম্পদ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হলেও সরকারের সদিচ্ছার যথেষ্ট অভাব রয়েছে বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা।

অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, ‘১৮ (ক) এর যে ধারা আছে, সেখানে বলা হচ্ছ রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি ইত্যাদি ইত্যাদি রক্ষা করা। এ আইন কার্যকরের সময় পার্লামেন্টে যিনি বড় কর্তা ছিলেন তখন সংসদ সদস্যরা এর থেকে নদী শব্দটা কেটে দিয়েছিল। অর্থাৎ রাষ্ট্র যারা চালায় তারা চান না নদীকে রক্ষা করা হোক।’

বেসরকারি গবেষণা বলছে, দূষণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়ছে নদী তীরবর্তী মানুষের জীবন, সেইসাথে কৃষি, জলজ স্বাস্থ্য, জনস্বাস্থ্য ও বিশুদ্ধ খাবার পানির যোগানও হুমকির মুখে।

মানবজীবনের জন্যও এক মহাবিপদ হয়ে উঠছে নদী দূষণে। বাড়ছে চর্মরোগ, শ্বাসকষ্ট, ক্যানসারসহ নানারকম রোগ।

সেন্টার ফর অল্টারনেটিভের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘জনগণ তাকেই লিডার করবে যখন তার মানসিকতা তাদের কাছাকাছি যাবে। কিন্তু এখানে যেটা সমস্যা হয়ে গেছে মন মানসিকতার মধ্যে আমরা যেটা বলি নদীমাতৃক দেশ সে জায়গায় এখনো যেতে পারি নি।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, কঠোর আইনের প্রয়োগ, জনগণের সচেতনতা ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছাই পারে নদীকে আগের রূপে ফিরিয়ে নিতে। তা না হলে আরও হুমকি পড়বে প্রাণ-প্রকৃতি।