নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের লক্ষ্যে আগামীকাল (শুক্রবার, ২৮ ফেব্রুয়ারি) আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে নতুন রাজনৈতিক দল। সব ধর্ম, জাতি, গোষ্ঠীর অংশ নিশ্চিত করে গঠিত হচ্ছে দলটির কেন্দ্রীয় কমিটি। তবে নেতৃত্বে বিরোধের জেরে নতুন দলে যোগ দিচ্ছে না ইসলামী ছাত্রশিবির থেকে আসা নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতা। পুরোনো বিভাজনের রাজনীতি থেকে মুক্ত হতে না পারলে অভ্যুত্থানের শক্তি দুর্বল হতে পারে বলে মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।
রাজধানীর বাংলামোটরের বাণিজ্যিক ভবনের ১৫ তলায় নানা শ্রেণি পেশার মানুষের পদচারণা। আগামীকাল মানিক মিয়া এভিনিউতে আত্মপ্রকাশ হতে যাচ্ছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নতুন রাজনৈতিক দল। দল গঠনের আগে, তাই জানাক কার্যালয়ে একের পর এক বৈঠক, প্রস্তুতিমূলক সভা।
নতুন রাজনৈতিক দলের ১৫১ জনের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আহ্বায়ক এবং সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন, সদ্য সাবেক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এবং আখতার হোসেন। মুখ্য সংগঠক পদে আসতে পারেন হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলম এবং সমন্বয়কারী পদে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তবে শীর্ষ পদের জন্য চলছে শেষ মুহূর্তের বোঝাপড়া।
এদিকে সম্ভাব্য শীর্ষ নেতাদের বেশিরভাগই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসায় অসন্তোষ দলের বাকি নেতাদের মধ্যে। তবে শীর্ষ পদের জন্য প্রতিযোগিতা থাকলেও সবার ত্যাগের মানসিকতা আছে বলে মনে করেন নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক।
সারজিস আলম বলেন, 'আপনি গ্রেটার পার্সপ্রেকটিভে নিজে কতটুকু ব্যক্তিস্বার্থ ত্যাগ করতে প্রস্তুত আছেন। এবং আমরা আমাদের জায়গা থেকে মনে করি যে, নির্দিষ্ট একটা পদ, ধরুন আহ্বায়ক, পদ তো একটা, সেখানে পাঁচজন ডিমান্ড করলে সবার কথা চিন্তা করে যে একজন সেখানে এগিয়ে থাকবে তিনি বসবেন। বাকি চারজনকে এটুকু মেনে নেয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। আমরা মনে করি আমাদের সবার সেটি আছে। দু'একটা বিচ্ছিন্ন বিষয় আলাদা বিষয়।'
গণঅভ্যুত্থানের এক মাস পর ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের লক্ষ্যে তরুণ নাগরিকদের সমন্বয়ে ৫৫ সদস্য নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে জাতীয় নাগরিক কমিটি। এর পর বাড়তে থাকে সংগঠনটির কলেবর। সাড়ে ৫ মাসে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৮৮ জনে। যোগ দেয় ছাত্র শক্তি, অধিকার পরিষদ, এবি পার্টি, বাম সংগঠনসহ কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতারা।
২৪ এর ডিসেম্বরে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতারা সরাসরি যুক্ত হলে আরো গতি পায় জাতীয় নাগরিক কমিটির কার্যক্রম। সভা, সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে দেখা যায় ছাত্রশিবিরের সাবেক ও বর্তমান নেতাকর্মীদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি।
তবে চলতি মাসে রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ উপলক্ষ্যে নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধ শুরু হয়। এরপর অভ্যুত্থানের কৃতীত্ব নিয়ে বিরোধে জড়ান ছাত্রশক্তি ও শিবির নেতারা। অভিযোগ ওঠে অতীতে শিবির সংশ্লিষ্টতার কারণে নতুন দলে গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়া হচ্ছে না।
এমন প্রেক্ষাপটে জানাক থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পদত্যাগ করেন সাবেক শিবির নেতা মোহাম্মদ হিজবুল্লাহ। অন্যদিকে নতুন দলে না থাকার ঘোষণা দেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সাবেক দুই সভাপতি, জানাকের যুগ্ম আহ্বায়ক আলী আহসান জুনায়েদ ও সদস্য সচিব রাফে সালমান রিফাত।
আত্মপ্রকাশের শুরুতে এমন বিভাজন হলে দলের শক্তি বিভাজিত হয়ে যেতে পারে বলে মনে করেন সমাজ বিজ্ঞানীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ড. স ম আলী রেজা বলেন, 'এরা অনেক ভালো অলটারনেটিভ নিয়ে আসছে। তখন আমরা তাদেরকে পছন্দ করবো। কিন্তু আপনি প্রথমে যদি বিভাজনের দিকে চলে যান, তাহলে নতুনত্বকে বাধাগ্রস্ত করবে। তাহলে আপনি যে ন্যারিটিভস দাঁড় করাতে চাচ্ছেন, এটা তো তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে যাবে। আওয়ামী লীগ রেজিমের বিরুদ্ধে যারা ছিলেন, অনেকে হয়তো সামনে যাননি, তার রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে। অনেকে পেছনে থেকে এটার রসদ জুগিয়েছে। একটা অংশ কন্ট্রিবিউট করেছে তাকে তো আপনি ইগনোর করতে পারেন না। পুরোনো বিভাজনের রাজনীতি থেকে মুক্ত হতে না পারলে অভ্যুত্থানের শক্তি দুর্বল হতেই পারে।'
তবে নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেনের দাবি নেতৃত্ব বাছাইয়ে পূর্বের রাজনৈতিক পরিচয় মুখ্য হিসেবে দেখা হয়নি।
আখতার হেসেন বলেন, 'পূর্বের রাজনৈতিক যে পরিচয়গুলো আছে সেগুলোকে আমরা কোনোভাবেই মুখ্য হিসেবে আমরা এখানে দেখিনি। বরং পূর্বের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাকে আমরা আমাদের মতাদর্শের সঙ্গে মিলিয়ে কীভাবে সুশৃঙ্খলভাবে বাংলাদেশের মানুষকে একটি নতুনধারার রাজনীতি উপহার দিতে পারি, সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। নানা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, তাদের সকলের একটা রিপ্রেজেন্টেশন রেখে, তাদের সকলের পক্ষে হয়ে নাগরিক মর্যাদার প্রশ্নটিকে আমরা সবথেকে গুরুত্ব দিয়ে থাকবো।'
এদিকে বুধবার ১১তম সাধারণ সভায় সিদ্ধান্ত হয়, দল আত্মপ্রকাশের পর সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে থেকে যাবে জাতীয় নাগরিক কমিটি। কেউ রাজনৈতিক দলে যুক্ত হলে বাতিল হবে জানাকের সদস্যপদ।