এক দশকে অন্তত এক কোটি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। লক্ষণ প্রকাশ না পাওয়ায় ৮০ শতাংশ কিডনি বিকল হওয়ার পর বুঝতে পারেন রোগীরা। শুরুতেই ডায়াবেটিক ও উচ্চ রক্তচাপ নির্ণয় ও চিকিৎসা নিশ্চিত করা গেলে অর্ধেকের বেশি রোগীর কিডনি বিকল রোধ করা সম্ভব। তবে ঘরে বসে ডায়ালাইসিস জনপ্রিয় করা গেলে বিকল কিডনি দিয়েও মানুষ কর্মজীবন চালিয়ে নিতে পারবেন বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
মায়ের দেয়া কিডনিতে তিন বছর সুস্থ থাকার পর আবারও কিডনি বিকল হয়েছে আশরাফের। বাইং হাউজের কোয়ালিটি অডিটর হিসেবে আড়াই লাখ টাকা বেতন পেলেও হারিয়েছেন চাকরি। গত ১২ বছরে ৬০ লাখ টাকা শেষ হয়েছে। কিডনি দাতার সংকটে খণ্ডকালীন চাকরি করে দুই সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে তীব্র কষ্টে জীবন পার হচ্ছে তার।
আশরাফ বলেন, ডায়ালাইসিস করি বলে আমাকে কোম্পানিগুলো অ্যালাউ করছে না। সবার কাছে রিকুয়েস্ট কেউ যদি আমাকে কাজে লাগাতে পারেন যেক্ষেত্রে আমার লাইফটা সহজ হয়ে যায়।'
দীর্ঘদিন ধরে উচ্চরক্তচাপে ভুগলেও বুঝতে পারেননি আশরাফ। একইভাবে ১৫ বছর ধরে ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ শেষ পর্যন্ত কিডনি বিকল করেছে নাজমা বেগমের। গবেষণা বলছে, লক্ষণ প্রকাশ না পাওয়ায় ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ কিডনি বিকল হওয়ার পর টের পান ভুক্তভোগী।
কিডনি, মেডিসিন, ডাঢয়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ বিশেষজ্ঞ ডা. মো. আবদুস শুকুর বলেন, 'ডায়াবেটিস, হাইপার টেনশনে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কিডনি রোগ কাভার করে। এটা কিডনি রোগের জন্য একটা বড় কারণ। যে সমস্ত ব্যক্তিদের ডায়াবেটিস আছে বা নিজের নেই কিন্তু বংশে কারও ডায়াবেটিস বা প্রেসার আছে তাদের নিয়মিতভাবে চেকআপ করা উচিত।'
ডায়ালাইসিসের রোগীর প্রতিমাসে গড়ে ৪৬ হাজার টাকা খরচ হওয়ায় একটি বড় অংশ অল্পসময় পরই বিনা চিকিৎসায় মারা যান। সরকারি যে সকল সেন্টারে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায় ডায়ালাইসিস করা যায় সেখানে প্রতি বছর হাতেগোনা রোগী জায়গা করে নিতে পারেন।
জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউটের স্যানডর ডায়ালাইসিস সার্ভিসের কনসালটেন্ট ডা. কে ইউ এম শামসুন নাহার বলেন, 'এক বছরে যখন ১৯ হাজার সেশনের জন্য একটা রোগী সেটআপ হয়ে যায় তখন তারা লাইফ লং এখানে ডায়ালাইসিস নেয়। এক্ষেত্রে যদি কোনো রোগী মারা যায় বা কোনো রোগী ঢাকার বাইরে চলে যায়, কোনো রোগী যদি ডিসকন্টিনিউ করে সেক্ষেত্রে আমরা দুই-চারজন রোগী নতুন করে ঢুকাতে পারি।'
ডায়ালাইসিস ছাড়াও কিডনি রোগীকে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫টি ওষুধ খেতে হয়। ফার্মাসিস্টদের দাবি, সরকার এই ওষুধগুলোতে শুল্ক কর মওকুফ করলে কমবে দাম। তবে চিকিৎসকরা বলছেন, সরকার ও ওষুধ কোম্পানি দু'পক্ষকেই ছাড় দিতে দীর্ঘমেয়াদি রোগের ক্ষেত্রে।
একজন ফার্মাসিস্ট বরেন, 'ডায়ালাইসিসের যে ফ্লুইড সেটা আমদানি, উৎপাদন এবং বিতরণ পর্যায়ে অর্থাৎ এই তিন পর্যায়েই সরকারের ভ্যাট প্রযোজ্য না। যদি ডায়ালাইিস একটা লোক নেয় সেই লোকই তো বাকি সাতটা ওষুধ খাচ্ছে। তাহলে সেই ওষুধগুলোতে কেন আমরা বিতরণ পর্যায়ে এবং উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাটকে প্রত্যাহার করবো না।'
সিকেডি অ্যান্ড ইউরোলোজি হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম বলেন, 'পার্টিকুলার ট্রান্সপ্ল্যান্ট রোগী এবং কিডনি ডায়ালাইসিস রোগীদের যেসব ওষুধ লাগে এদের ট্যাক্স একদম মওকুফ করা যেতে পারে। ডায়ালাইসিস রিলেটেড যেসব ওষুধ সেগুলো যদি আমাদের দেশে প্রোডাকশন করা সম্ভব হয় তাহলে সেগুলো আমরা করবো। কিন্তু সবচেয়ে কম খরচে যেন করা যায় সেটা মাথায় রাখতে হবে।'
তবে উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশে পেরিটোনিয়াল তথা ঘরে বসে ডায়ালাইসিস জনপ্রিয় করা গেলে কমবে রোগীর আনুষঙ্গিক খরচ, সচল থাকবে রোগীর কর্মক্ষমতা। এক্ষেত্রে ওষুধ কোম্পানিগুলোকে দেশেই ফ্লুইড তৈরি আহ্বান যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞের।
সিলেট কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতালের চেয়ারম্যান ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'ইনসেপ্টার সাথে কথা বললাম, কটা মিটিং করলাম। তারা আমাকে বললেন তারা বানিয়ে দেবে। ইনসেপ্টা যদি এক বা দুই ডলারে পিডিএফ রিড করতে পারে তাহলে খরচ এত কমবে যে মানুষের আর আগের মতো কষ্ট হবে না। আর যেগুলো টেকনিক্যাল সমস্যা যেগুলো আছে যেগুলোর জন্য নার্সদের যত ট্রেনিং দেই এটা তত ইমপ্রুভ হয়।'
মাত্র এক দশকে এক কোটি বেড়ে কিডনি রোগীর সংখ্যা তিন কোটি ছাড়িয়েছে। কিডনি বিকল রোগীদের প্রায় ৯২ শতাংশ অর্থের অভাবে শেষ পর্যন্ত ডায়ালাইসিস চালিয়ে নিতে পারেন না, অনেকেই প্রাথমিক পর্যায়ে প্রাণ হারান। তাই ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপে ভুগতে থাকাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এবং বয়স ত্রিশ হলে বছরে অন্তত একবার কিডনি পরীক্ষার আহ্বান বিশেষজ্ঞদের।