বছরের পর বছর লাখ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা টানতে টানতে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য তারা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিষফোঁড়া। তবে, শঙ্কা আছে, যেকোনো মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলার ভয়াবহ অবনতির। তবুও তাদের ফেরত পাঠাতে জাতিসংঘের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া বিকল্প দেখছে না বিশ্লেষকরা। অন্যদিকে, খাদ্য সহায়তা কাটছাঁট না করার জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন চান রোহিঙ্গারা।
এ তৃষ্ণা হয়তো মিটে যায় টিউবওয়েলের স্বচ্ছ কোমল পানিতে। কিন্তু, ঘরে ফেরার যে আজন্ম তৃষ্ণা, তা মেটাবে কে? বয়স যখন ৭ থেকে ৮ মাস তখন নির্যাতনের শিকার বাবা মার সাথে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তারা আশ্রয় নিয়েছেন বাংলাদেশে। এখন তাদের বয়স ৭ থেকে ৮ বছর।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বড় হওয়া এই শিশুরা বলছেন, তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে মন চায়, কিন্তু অন্তরে জুলুমের ভয়।
২০১৭ সালে সীমান্তে যে ঢল নেমেছিল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর, সরকারি হিসেবে এখন তা ১৩ লাখের মতো। যদিও বেসরকারি হিসেব বলছে, বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা আরও কয়েক লাখ বেশি। যখনই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আলোচনা উঠে, তখনই তাদের দাবি নাগরিকত্ব আর ভিটামাটি বুঝিয়ে দিয়ে তাদেরকে নিতে হবে মর্যাদার সাথে।
গলার কাঁটা হয়ে থাকা এই সংকট আরও কতদিন, কত মাস কিংবা কত বছর ধরে বয়ে যেতে হবে মানবিক বাংলাদেশকে? গত সাত মাসে ১৬টি অস্ত্র মামলায় ২৩ জন রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করেছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন।
ক্যাম্পগুলোতে অস্ত্র ও মাদক ব্যবসার কথা এখন হরহামেশাই শোনা যায়। ঘটছে মানব পাচারের ঘটনাও। সব মিলিয়ে রোহিঙ্গাদের কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতির শঙ্কা নিয়ে বাংলাদেশকে সহ্য করে যেতে হচ্ছে এই বিষফোঁড়া।
অধ্যাপক মাঈনুল হাসান খান বলেন, ‘আমরা রাখতে বাধ্য হয়েছি হয়ত। বা আমরা উদারতা দেখিয়ে তাদের গ্রহণ করেছি সত্য। কিন্তু তাদের পরিচর্যা করার মত সামর্থ্য আমাদের নাই।’
১৯৭৮ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে আবার ফেরত পাঠিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। আর এখন জাতিসংঘের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই।
অধ্যাপক মাঈনুল হাসান খান বলেন, ‘বর্তমান বিএনপির অবস্থা দিয়ে আমরা জিয়াউর রহমানকে বিচার করার চেষ্টা করি। কোনো দলীয় সরকার এ রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধান দিতে পারবে না। আমাদের শেষ ভরসা বলতে পারেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং জাতিসংঘ মহাসচিব। তারা চেষ্টা করলে, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নকে অনেকটা নৈতিকভাবে বাধ্য করতে পারবে যাতে করে এ রোহিঙ্গাদের একটা প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা তারা করে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো যদি তাকে ডিস্টার্ব করে যেতে থাকে, তাকে কাজ করতে না দেয় তাহলে বিলম্বিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।’
তবে জাতিসংঘ মহাসচিবের এই সফরকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে এক লাখ রোহিঙ্গাকে জড়ো করে ঐতিহাসিক যে ইফতার আয়োজন করেছেন প্রধান উপদেষ্টা, তা গোটা পৃথিবীর কাছে দৃষ্টান্ত।
এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেন, ‘৮-১০ বছরের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক ক্রাইসিস তৈরি হয়েছে। ইউক্রেনে, গাজায়, সিরিয়াতে। এগুলোর কারণে রোহিঙ্গা ইস্যু থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ফোকাসটা একটু সরে গিয়েছিল। আমি মনে করি জাতিসংঘ মহাসচিব এখানে আসায় আন্তর্জাতিক মনোযোগটা আবার এখানে আসবে। পাশাপাশি কমে যাওয়া খাদ্য সহায়তা হয়ত আবার বাড়বে।’
এদিকে প্রত্যাবাসনের ইস্যু ছাড়াও আরেকটি বড় সংকট এখন রোহিঙ্গাদের খাদ্য বাজেটে কাটছাঁট করার সিদ্ধান্ত। তবে এই বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেলেন, তার বাস্তবায়নই আপাতত জরুরি।