সভ্যতা গড়ার কারিগরদের জন্য আজকের দিনটি, মে দিবস। সারাবিশ্বেই পালিত হচ্ছে শ্রমিকের অধিকার আদায়ের দিনটি। ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে ১৮৮৬ সালে শ্রমজীবীদের আত্মত্যাগে পূরণ হয় দাবি। বিশ্বব্যাপী তৈরি হয় শ্রম আইন। কিন্তু বাংলাদেশে অনেক পেশায় এর বাস্তবায়ন নেই। তাদের প্রতিবাদ, কষ্ট আর অভিমান ফুটে উঠে গানে। উঠে আসে জীবন-জীবিকার গল্প, পূর্ব পুরুষের ইতিহাস।
দেশের মাটি, মানুষ আর জীবনের গল্প বলা হয় গানে। নদীর বুকে দাঁড়িয়ে মাঝি গায় তার ভাগ্যের গান, মাঠের মাটিতে দাঁড়িয়ে কৃষক শোনায় ফসলের আশা, আর শহরে গরমে কাজ করা কামার হাতুড়ির শব্দে জানান দেয় তার গল্পের কথা। সব পেশা সংগ্রামের গল্প উঠে আসে সুরের গুঞ্জনে। পেশাজীবীদের সুরে আছে এক অন্য শক্তি।
এই গান শুধু বিনোদন নয়। এখানে লুকিয়ে আছে বেঁচে থাকার আকুতি, অধিকারের দাবি কিংবা প্রতিবাদ। কখনো আবার এই গান হয়ে ওঠে প্রতিবাদের ভাষা। তাই গানও রুপবদলেছে পেশা থেকে পেশায়।
মাঝির গানে বাজে ভাটির কান্না, জোয়ারের ডাক। মাঝি বলেন, ‘যখন সময় তখন গান করে নিজেকে আমোদ-ফুর্তিতে রাখি।’
কৃষকের গান ফসলের মতোই। মাটির ঘ্রাণ আর পরিশ্রমের ছবি আঁকে শব্দে শব্দে। এ গান শুধুই কৃষকের। শুনেছেন পূর্বপুরুষের কণ্ঠে আর এখন গান ধরেছেন নিজেই।
কৃষকদের একজন বলেন, ‘পাট ও ধান কাটার সময় গান গাইতো বিভিন্ন ধরনের।’
ডকের পাশে ঘাটে, লেবারদের বুকে জমে থাকা ক্লান্তি রূপ নেয় গুনগুন গানে। গান এখানে মনের কথা বলে। অনেক জাহাজের শ্রমিক গানের আসরে বসে প্রতি সপ্তাহেই।
জাহাজের শ্রমিকদের একজন বলেন, ‘বন্ধুদের সাথে রাত ১০ থেকে ১২ টা পর্যন্ত গানের আড্ডা দিতে দিতে বেজে যায়।’
কামারের হাতুড়ি শুধু লোহা গড়ে না, গড়ে ইতিহাস। কঠোর বাস্তবতার আগুনে তাদের গান হয়ে ওঠে সাহসের জ্বলন্ত শিখা। এই যে কামার হাতুড়ির আর আগুন তাপে পুড়ে যে কাজ শুরু হয় সে কাজ শেষ হয় ১২ ঘণ্টা পর। দিনে ৮ থেকে ৯০০ টাকায় কাজ করে পায় হতে, হয় অসুস্থ৷ তবু করতে হচ্ছে এই যুদ্ধ।
কামারদের একজন বলেন, ‘যে পরিমাণ টাকা পায় তা দিয়ে ছেলে মেয়েদের খাওয়া-পড়াতেই শেষ। তাহলে চাকরি কোথা থেকে করাবো। এ হিসেবে আমাদের আগুনে পুড়ে জীবন শেষ এমনিতেও শেষ।’
১৮৮৬ সালে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে শ্রমজীবী মানুষ আত্মত্যাগে পূরণ হয় দাবি। তাই বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে পয়লা মে পালন করা হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। কিন্তু এখনো দেশের শ্রমজীবী মানুষের সেই চাওয়া রয়েই গেছে।
তবু তারা আশায় বাঁচেন। ধরেন তাদের নিজ পেশার, নিজস্ব গান। গবেষকরা বলছেন, তাঁতি কামার কুমার থেকে সব পেশার আছে আলাদা আলাদা গান, সুর ও প্রকাশভঙ্গি। এই গানগুলো পেশাজীবীদের ইতিহাস।
লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, ‘প্রত্যেকটা গানে শ্রমজীবী মানুষদের তাদের যে সৃজনশীলতা, তাদের যে শ্রমঘন উৎপাদনশীলতা এবং প্রাণ প্রকৃতির সাথে তার যে জীবনের সম্পর্ক এখান থেকে আসলে এই গান তৈরি হয়েছে।’