ফুটবল বিশ্বে আর্জেন্টিনার দিয়েগো মারাদোনা ও লিওনেল মেসির মতো তারকা ফুটবলারদের পাশে এই মুহূর্তে বিস্ময় ফুটবলার বলা হয় লেমিন ইয়ামালকে। তাঁর পায়ের জাদুতে মোহিত গোটা দুনিয়া। কুর্নিশ জানাতে কোনও ভুল করেন না ফুটবলপ্রেমীরা। সেই লেমিন ইয়ামাল কি এখন ইউরোপের সেরা ফুটবলার?
‘লেমিন হল এমন প্রতিভা যিনি সবার নজর কেড়ে দিতে পারেন।’ বার্সেলোনার বিরুদ্ধে ৩-৩ ড্র করার পর বলেছিলেন ইন্টার মিলানের কোচ সিমোনে ইনজাঘি।
“ফুটবলে একটা জিনিস আমাকে বার বার অবাক করে। আমরা সব সময় ভাবি রোনাল্ডো, মেসি, রুড গুলিত, মারাদোনা, এদের চেয়ে ভাল ফুটবলার আর হতেই পারে না। ঠিক তখনই ইয়ামালের মতো ফুটবলারদের পাওয়া গেল।’ বলেছিলেন ফ্রান্সের প্রাক্তন ফুটবলার থিয়েরি অঁরি।
ইন্টার মিলানের বিরুদ্ধে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ সেমিফাইনালের প্রথম লেগে তাঁর পারফরম্যান্সের পর গোটা বিশ্বে চমকে গেছে। তার একটা কারণ যদি বয়স হয়, দ্বিতীয়টা শৈল্পিক ফুটবল। ইন্টারের বিরুদ্ধে বার্সেলোনা ড্র করে মাঠ ছেড়েছে ঠিকই, কিন্তু ইয়ামালের বিস্ময়-ফুটবল নজর এড়ায়নি কারওরই। যে কারণে বলা হচ্ছে, তিনিই এখন বিশ্বের সেরা ফুটবলার। কেউ বলছেন তিনিই ভবিষ্যতের মারাদোনা, কারও মতে তিনিই মেসি। অনেকেই তাঁকে ফিফার বর্ষসেরা পুরস্কার দেওয়ার দাবি তুলেছেন।
ইয়ামালের প্রতিভা নিয়ে আর কারও কোনও সন্দেহ নেই। এখনই যদি তিনি খেলা ছেড়ে দেন, তা হলে বিশ্বের ৯৯ শতাংশ ফুটবলার যা অর্জন করতে পারেননি, সেটা অর্জন করেই খেলা ছাড়বেন। আর দু’মাস পরে হয়তো লা লিগা, স্প্যানিশ কাপ এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ত্রিমুকুটও জিতবেন।
স্বাভাবিক ভাবেই বার্সেলোনার আর এক নক্ষত্র লিয়োনেল মেসির সঙ্গে তাঁর তুলনা করছে এই প্রজন্ম। তার আগের প্রজন্মের চোখে তিনি মারাদোনা। যদিও ইয়ামাল নিজে বলেছেন, ‘এ সব তুলনার কোনও অর্থ নেই।’ সে যা-ই বলুন, মারাদোনা-মেসির সঙ্গে তুলনা অন্তত এখনই তিনি এড়িয়ে যেতে পারবেন না।
গত দু’বছরে যে ভাবে ইয়ামালের উত্থান হয়েছে তা অবিশ্বাস্য। প্রাক্তন কোচ জাভির অধীনে বার্সেলোনার প্রথম দলে সুযোগ পেয়েছিলেন ইয়ামাল। সেই সময় অর্থকষ্টে ভুগছিল স্পেনীয় ক্লাব। গোটা বিশ্বের কাছে হাসির উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছিল তারা। অর্থের টানাটানি থাকায় বেশি দাম দিয়ে ফুটবলারও কেনা যাচ্ছিল না। সেই সময়ে জাভি যে কতটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সেটা এখন বোঝা যাচ্ছে।
আধুনিক বিশ্বে বার্সলোনার ইয়ামালের উত্থানের খবর নজর এড়ায়নি কারও। ১৫ বছর বয়সেই তাঁকে সই করানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল প্যারিস সঁ জরমঁ। ইয়ামালকে বার্সেলোনায় রেখে দেওয়ার নেপথ্যে আসল নায়ক জাভিই।
স্পেনের এক সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জাভি ইয়ামালকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, বার্সেলোনার সঙ্গে প্রথম পেশাদার চুক্তিতে সই করলে তিনি প্রথম একাদশে নিয়মিত খেলার সুযোগ করে দেবেন।
কথা রেখেছিলেন জ়াভি। ২০২৩-এর এপ্রিলে, ১৫ বছর, ন’মাস এবং ১৬ দিন বয়সে ইয়ামালের অভিষেক হয় নীল-লাল জার্সি গায়ে। ক্লাবের সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসাবে অভিষেকের নজির গড়েন।
কথা রেখেছিলেন ইয়ামালও। ক্লাবের সঙ্গে চুক্তি করেন, যেখানে ‘রিলিজ় ক্লজ়’ (চুক্তি ভাঙিয়ে কোনও ফুটবলারকে নিতে গেলে যে অর্থ দিতে হয় সংশ্লিষ্ট ক্লাবকে) রাখা হয় ১০০ কোটি ইউরো (এখন ৯৬০০ কোটি টাকা)।
গত মার্চ মাসে বার্সেলোনার সভাপতি জোয়ান লাপোর্তা বলেছিলেন, ‘ইয়ামালের মতো খেলোয়াড়ের জন্য প্রচুর টাকার প্রস্তাব পাচ্ছি আমরা। অবশ্য সবই ফিরিয়ে দিয়েছি। লেমিনের উপর আমাদের বিশ্বাস রয়েছে। আমরা ওকে বিক্রি করতে চাই না।’
বয়স ভুলে যান, গত দুটো বছর ইয়ামালের যেমন গিয়েছে, তা অনেক খেলোয়াড় সারা জীবনেও অর্জন করতে পারেন না।
রিয়াল বেটিসের বিরুদ্ধে অভিষেকে মাত্র সাত মিনিট খেলেছিলেন ইয়ামাল। লিগ খেতাব জিতেছিল বার্সেলোনা। পরের মরসুমে তিনি আরও নিজেকে প্রকাশ করে সবার দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছেন।
স্বাভাবিক কারণেই মেসির সঙ্গে ইয়ামালের তুলনা হচ্ছে। তাঁর বাবা নাসরাউই নিজেই বলেছেন, মেসির থেকেও বড় ফুটবলার হতে পারেন ইয়ামাল। ইউরো কাপের সময় খুদে ইয়ামালকে মেসির কোলে ধরে থাকার ছবি ভাইরাল হয়েছে। তবে মেসি যখন নিজের সোনালি সময় কাটিয়েছেন, তার থেকে এখনকার ফুটবল অনেকটাই বদলে গিয়েছে। তাই ইয়ামালকে আরও বেশি অনুশীলনের মধ্যে থাকতে হবে। ফুটবল যুদ্ধে একজন জয়ী সৈনিক হিসেবে পরিচিতি পেতে গেলে অধ্যবসায় এবং একাগ্রতা শেষ কথা বলবে।
ভুললে চলবে না মহম্মদ সালাহকেও। ইয়ামালের দ্বিগুণ বয়সী ফুটবলার গত কয়েক বছরে একাই ইপিএল মাতিয়ে দিয়েছেন। লিভারপুলের সাম্প্রতিক সাফল্যের পিছনে সবার আগে সালাহ ছাড়া আর কারওর নাম করা যাবে না। ইয়ামাল ইউরোপ কেন, বিশ্বের সেরা ফুটবলার কি না, তা বিচার করবে সময়। সেদিনের অপেক্ষায় অবশ্যই ইয়ামালকে দেখতে চাইছে সারা বিশ্ব।