ঢাকা ০৯:০৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৪ মে ২০২৫, ৩১ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

মারা গেছেন বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র প্রেসিডেন্ট

আর্ন্তজাতিক ডেস্ক
  • আপডেট সময় : ০৫:২৬:০৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৪ মে ২০২৫
  • / ৩৪৫ বার পড়া হয়েছে
৭১ নিউজ বিডির সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

উরুগুয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসে মুহিকা ৮৯ বছর বয়সে মারা গেছে, যিনি ‘পেপে’ নামেও পরিচিত ছিলেন। ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত উরুগুয়ে শাসন করা এই সাবেক গেরিলা যোদ্ধা “বিশ্বের সবচেয়ে গরিব প্রেসিডেন্ট” হিসেবে পরিচিত ছিলেন। খুবই সাধারণ জীবনযাপনের কারণেই তৈরি হয়েছিল তার এই পরিচিতি।

উরুগুয়ের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইয়ামান্দু ওরসি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স’-এ (সাবেক টুইটার) তার মৃত্যুর খবর জানিয়ে লেখেন- “আপনি আমাদের যা কিছু দিয়েছেন এবং জনগণের প্রতি আপনার গভীর ভালোবাসার জন্য ধন্যবাদ”।

প্রয়াত এই রাজনীতিবিদের মৃত্যুর সঠিক কারণ এখনো জানা যায় নি। তবে দীর্ঘদিন ধরে তিনি খাদ্যনালীর ক্যান্সারে ভুগছিলেন।

তিনি প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় তার জীবনযাপন বা চলাফেরা ছিল খুবই সহজ ও সাধারণ। ভোগবাদ বিরোধী মনোভাব এবং বিভিন্ন সামাজিক সংস্কারের কারণে তার ব্যাপক পরিচিতি তৈরি হয়েছিল। তার শাসনামলে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে উরুগুয়ে গাঁজা সেবনের বৈধতা দেয়। এছাড়া গর্ভপাতের অধিকার, সমলিঙ্গের বিয়ের স্বীকৃতি দিয়েছিল উরুগুয়ে।

মুহিকা লাতিন আমেরিকা ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে সুপরিচিত এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। মাত্র ৩৪ লাখ জনসংখ্যার দেশ উরুগুয়ের একজন রাষ্ট্রপতি, তবুও বিশ্বজুড়ে ছিল তার জনপ্রিয়তা। যদিও তার পরে যারা তার উত্তরাধিকার হিসেবে এসেছিল ওই পদে তারা দেশটিতে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। তাকে দেখলে কেউ মনেই করতে পারতেন না যে তিনি একজন রাজনীতিবিদ। যদিও বাস্তবতা ছিল একেবারেই ভিন্ন।

তিনি বলতেন, রাজনীতি, বই কিংবা কৃষিকাজের প্রতি তার আগ্রহের বিষয়টি তার মায়ের কাছ থেকে পাওয়া। যিনি মন্টেভিডিও শহরের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে তাকে বড় করেছেন। যুবক বয়সেই তিনি উরুগুয়ের ঐতিহ্যবাহী দল “ন্যাশনাল পার্টির” সদস্য হন। যা পরে তার সরকারের মধ্য ডানপন্থী বিরোধী শক্তি হয়ে ওঠে।

১৯৬০-এর দশকে তিনি তুপামারোস ন্যাশনাল লিবারেশন মুভমেন্ট (এমএলটিএন) প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছিলেন। যেটি ছিল একটি বামপন্থী গেরিলা সংগঠন। যারা ছিনতাই, অপহরণ ও বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। যদিও মুহিকা সবসময়ই বলে এসেছেন তিনি কখনো কাউকে হত্যা করেননি।

কিউবার বিপ্লব ও আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্র দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এমএলএন-টি উরুগুয়ের সরকারের বিরুদ্ধে গোপন প্রতিরোধের একটি প্রচারণা শুরু করে। যদিও তখন উরুগুয়ের সরকার ছিল সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক। তবে বামপন্থীরা সেটিকে ক্রমাগত কর্তৃত্ববাদী বলে অভিযুক্ত করে আসছিল।

এই সময়ের মধ্যে মুহিকা চারবার ধরা পড়ে কারাবন্দি হন। ১৯৭০ সালে তাকে ছয়বার গুলিও করা হয়েছিল। তিনি বেঁচে ফিরেছিলেন মৃত্যুর মুখ থেকে। তিনি দুইবার কারাগার থেকে পালিয়েছিলেন। একবার ১০৫ জন সহযোগীকে নিয়ে একটি সুড়ঙ্গ দিয়ে পালিয়ে ছিলেন। যা ছিল উরুগুয়ের ইতিহাসে অন্যতম বড় জেল পালানোর ঘটনা।

১৯৭৩ সালে সামরিক বাহিনী উরুগুয়ের ক্ষমতা দখল করলে, তারা মুহিকাসহ ৯ জন বন্দিকে “জিম্মি” করে গেরিলা হামলা বন্ধের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছিল। ১৯৭০ ও ১৯৮০ এর দশকে তিনি ১৪ বছরেরও বেশি সময় কারাবন্দি ছিলেন। তাকে নির্যাতন করা হয় এবং নিভৃত সেলে রাখা হয়। ১৯৮৫ সালে দেশে গণতন্ত্র ফিরলে তিনি মুক্তি পান।

তিনি বলতেন, কারাগারে তিনি পাগলামির স্বাদ পেয়েছেন। বিভ্রমে ভুগতেন এবং এমনকি তিনি কথা বলতেন পিঁপড়ার সাথেও।

নিজের সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, যেদিন তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন সেই দিনটি ছিল তার কাছে সবচেয়ে আনন্দের দিন। সেই দিনটি তার কাছে এতটাই আনন্দের দিন ছিল যে সেটি রাষ্ট্রপতি হওয়ার দিনের চেয়েও আনন্দের ছিল।

মুক্তির কয়েক বছর পর, তিনি দেশের নিম্নকক্ষ, প্রতিনিধি পরিষদ এবং উচ্চকক্ষে সিনেটে আইনপ্রণেতা হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০০৫ সালে তিনি উরুগুয়ের বামপন্থী জোট ‘ফ্রেন্তে অ্যাম্পলিও’ সরকারের মন্ত্রী হন। ২০১০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

তিনি যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তখন তার বয়স ছিল ৭৪ বছর। তবে বিশ্বের কাছে তার খুব একটা পরিচিতি ছিল না। তিনি নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে লাতিন আমেরিকার বামপন্থী জোটে তিনি এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে ওঠেন। তার পরিচিতি তখন তৈরি হয়েছিল ব্রাজিলের লুলা দা সিলভা এবং ভেনেজুয়েলার হুগো শাভেজের মতোই।

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, তিনি নিজের মতো করেই দেশ পরিচালনা করেছেন। এটি করতে গিয়ে তিনি নিতেন সাহসী ও বাস্তববাদী নানা সিদ্ধান্ত। তাঁর শাসনামলে উরুগুয়ের অর্থনীতি বার্ষিক গড়ে পাঁচ দশমিক চার শতাংশ হারে বেড়ে দাড়িয়েছিল। কমেছিল বেকারত্বের হার।

এই সময়ে উরুগুয়ে বেশ কিছু সামাজিক আইন পাস করে বিশ্বজুড়ে নজর কাড়েন মুহিকা। যেগুলোর মধ্যে গর্ভপাত বৈধকরণ, সমলিঙ্গ বিবাহ স্বীকৃতি এবং গাঁজা বাজার নিয়ন্ত্রণ।

মুহিকা প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় রাষ্ট্রপতির জন্য বরাদ্দ রাজপ্রাসাদে না গিয়ে শহরের বাইরে নিজের সাধারণ বাড়িতে স্ত্রী লুসিয়া টোপোলানস্কির সঙ্গে থাকতেন।

তার স্ত্রী নিজেও ছিলেন একজন রাজনীতিক ও সাবেক গেরিলা। তাদের কোনো গৃহকর্মী বা নিরাপত্তা বাহিনীও ছিল না।

মুহিকা খুবই সাধারণ পোশাক পরতেন। ১৯৮৭ সালের একটি হালকা নীল রঙের ভক্সওয়াগেন গাড়ি চালাতেন এবং নিজের বেতনের বেশিরভাগই দান করে দিতেন। সাদামাটা জীবন যাপনসহ এসব কারণে সংবাদ মাধ্যমগুলো তাকে “বিশ্বের সবচেয়ে গরিব প্রেসিডেন্ট” হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল। এই যে তাকে গরীব প্রেসিডেন্টে হিসেবে বলা হতো সেটি তিনি সব সময় প্রত্যাখ্যান করেছেন।

তিনি বলতেন, “তারা বলে আমি নাকি সবচেয়ে গরিব প্রেসিডেন্ট। না, আমি তা না। ২০১২ সালে নিজ বাড়িতে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “”দরিদ্র তারা যারা আরও বেশি চায়, কারণ তারা এক অন্তহীন দৌড়ে রয়েছে”।

মুহিকা ব্যক্তিগতভাবে মিতব্যায়ী নীতি অবলম্বন করলেও, তার সরকার উল্লেখযোগ্যভাবে জনসাধারণের ব্যয় বৃদ্ধি করে। ফলে রাজস্ব ঘাটতি বাড়তে থাকে। তখন বিরোধীরা তাকে অপচয়কারী হিসেবে অভিযুক্তও করেছিলেন। তবে শিক্ষাখাতে মুহিকার ভুমিকা নিয়ে কিছু প্রশ্ন ছিল। তার সময়ে উরুগুয়ের শিক্ষাখাতে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অগ্রগতি না করার জন্য সমালোচনা তৈরি হয়েছিল।

লাতিন আমেরিকার এই অঞ্চলের অন্যান্য নেতাদের মতো, তার বিরুদ্ধে কখনও দুর্নীতি বা দেশের গণতন্ত্রকে দুর্বল করার অভিযোগ ওঠেনি।

শাসনামলের শেষে তার জনপ্রিয়তা ছিল প্রায় ৭০ শতাংশ। তিনি সিনেটরও নির্বাচিত হয়েছিলে। এরপর তিনি বিশ্ব ভ্রমণে কিছু সময়ও ব্যয় করেছিলেন।

রাষ্ট্রপতি পদ ছাড়ার আগে তিনি একবার বলেছিলেন, “বিশ্ব কী নিয়ে এত বিস্মিত? আমি তো সামান্য জিনিসে বাঁচি, সাধারণ বাড়িতে থাকি, পুরনো গাড়ি চালাই? তাহলে এই পৃথিবী কি নিয়ে এত পাগল”।

২০২০ সালে মুহিকা রাজনীতি থেকে অবসর নেন। তবে উরুগুয়ের রাজনীতিতে তিনি ছিলেন এক কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে।

তার রাজনৈতিক উত্তরসূরি ইয়ামান্দু ওরসি ২০২৪ সালের নভেম্বরে উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং তার দল ফ্রেন্তে অ্যাম্পলিও পার্লামেন্টে সবচেয়ে বেশি আসন পায়।

গত বছর, মুহিকা জানিয়েছিলেন যে তার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। তিনি বলছিলেন যে মৃত্যু তার খুব সন্নিকটে।

গত বছরের নভেম্বরে বিবিসিকে দেওয়া শেষ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “সবার ক্ষেত্রে মৃত্যু অনিবার্য এবং সম্ভবত এটি জীবনের মধ্যে লবণের মতো।”

নিউজটি শেয়ার করুন

মারা গেছেন বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র প্রেসিডেন্ট

আপডেট সময় : ০৫:২৬:০৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৪ মে ২০২৫

উরুগুয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসে মুহিকা ৮৯ বছর বয়সে মারা গেছে, যিনি ‘পেপে’ নামেও পরিচিত ছিলেন। ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত উরুগুয়ে শাসন করা এই সাবেক গেরিলা যোদ্ধা “বিশ্বের সবচেয়ে গরিব প্রেসিডেন্ট” হিসেবে পরিচিত ছিলেন। খুবই সাধারণ জীবনযাপনের কারণেই তৈরি হয়েছিল তার এই পরিচিতি।

উরুগুয়ের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইয়ামান্দু ওরসি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স’-এ (সাবেক টুইটার) তার মৃত্যুর খবর জানিয়ে লেখেন- “আপনি আমাদের যা কিছু দিয়েছেন এবং জনগণের প্রতি আপনার গভীর ভালোবাসার জন্য ধন্যবাদ”।

প্রয়াত এই রাজনীতিবিদের মৃত্যুর সঠিক কারণ এখনো জানা যায় নি। তবে দীর্ঘদিন ধরে তিনি খাদ্যনালীর ক্যান্সারে ভুগছিলেন।

তিনি প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় তার জীবনযাপন বা চলাফেরা ছিল খুবই সহজ ও সাধারণ। ভোগবাদ বিরোধী মনোভাব এবং বিভিন্ন সামাজিক সংস্কারের কারণে তার ব্যাপক পরিচিতি তৈরি হয়েছিল। তার শাসনামলে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে উরুগুয়ে গাঁজা সেবনের বৈধতা দেয়। এছাড়া গর্ভপাতের অধিকার, সমলিঙ্গের বিয়ের স্বীকৃতি দিয়েছিল উরুগুয়ে।

মুহিকা লাতিন আমেরিকা ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে সুপরিচিত এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। মাত্র ৩৪ লাখ জনসংখ্যার দেশ উরুগুয়ের একজন রাষ্ট্রপতি, তবুও বিশ্বজুড়ে ছিল তার জনপ্রিয়তা। যদিও তার পরে যারা তার উত্তরাধিকার হিসেবে এসেছিল ওই পদে তারা দেশটিতে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। তাকে দেখলে কেউ মনেই করতে পারতেন না যে তিনি একজন রাজনীতিবিদ। যদিও বাস্তবতা ছিল একেবারেই ভিন্ন।

তিনি বলতেন, রাজনীতি, বই কিংবা কৃষিকাজের প্রতি তার আগ্রহের বিষয়টি তার মায়ের কাছ থেকে পাওয়া। যিনি মন্টেভিডিও শহরের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে তাকে বড় করেছেন। যুবক বয়সেই তিনি উরুগুয়ের ঐতিহ্যবাহী দল “ন্যাশনাল পার্টির” সদস্য হন। যা পরে তার সরকারের মধ্য ডানপন্থী বিরোধী শক্তি হয়ে ওঠে।

১৯৬০-এর দশকে তিনি তুপামারোস ন্যাশনাল লিবারেশন মুভমেন্ট (এমএলটিএন) প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছিলেন। যেটি ছিল একটি বামপন্থী গেরিলা সংগঠন। যারা ছিনতাই, অপহরণ ও বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। যদিও মুহিকা সবসময়ই বলে এসেছেন তিনি কখনো কাউকে হত্যা করেননি।

কিউবার বিপ্লব ও আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্র দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এমএলএন-টি উরুগুয়ের সরকারের বিরুদ্ধে গোপন প্রতিরোধের একটি প্রচারণা শুরু করে। যদিও তখন উরুগুয়ের সরকার ছিল সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক। তবে বামপন্থীরা সেটিকে ক্রমাগত কর্তৃত্ববাদী বলে অভিযুক্ত করে আসছিল।

এই সময়ের মধ্যে মুহিকা চারবার ধরা পড়ে কারাবন্দি হন। ১৯৭০ সালে তাকে ছয়বার গুলিও করা হয়েছিল। তিনি বেঁচে ফিরেছিলেন মৃত্যুর মুখ থেকে। তিনি দুইবার কারাগার থেকে পালিয়েছিলেন। একবার ১০৫ জন সহযোগীকে নিয়ে একটি সুড়ঙ্গ দিয়ে পালিয়ে ছিলেন। যা ছিল উরুগুয়ের ইতিহাসে অন্যতম বড় জেল পালানোর ঘটনা।

১৯৭৩ সালে সামরিক বাহিনী উরুগুয়ের ক্ষমতা দখল করলে, তারা মুহিকাসহ ৯ জন বন্দিকে “জিম্মি” করে গেরিলা হামলা বন্ধের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছিল। ১৯৭০ ও ১৯৮০ এর দশকে তিনি ১৪ বছরেরও বেশি সময় কারাবন্দি ছিলেন। তাকে নির্যাতন করা হয় এবং নিভৃত সেলে রাখা হয়। ১৯৮৫ সালে দেশে গণতন্ত্র ফিরলে তিনি মুক্তি পান।

তিনি বলতেন, কারাগারে তিনি পাগলামির স্বাদ পেয়েছেন। বিভ্রমে ভুগতেন এবং এমনকি তিনি কথা বলতেন পিঁপড়ার সাথেও।

নিজের সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, যেদিন তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন সেই দিনটি ছিল তার কাছে সবচেয়ে আনন্দের দিন। সেই দিনটি তার কাছে এতটাই আনন্দের দিন ছিল যে সেটি রাষ্ট্রপতি হওয়ার দিনের চেয়েও আনন্দের ছিল।

মুক্তির কয়েক বছর পর, তিনি দেশের নিম্নকক্ষ, প্রতিনিধি পরিষদ এবং উচ্চকক্ষে সিনেটে আইনপ্রণেতা হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০০৫ সালে তিনি উরুগুয়ের বামপন্থী জোট ‘ফ্রেন্তে অ্যাম্পলিও’ সরকারের মন্ত্রী হন। ২০১০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

তিনি যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তখন তার বয়স ছিল ৭৪ বছর। তবে বিশ্বের কাছে তার খুব একটা পরিচিতি ছিল না। তিনি নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে লাতিন আমেরিকার বামপন্থী জোটে তিনি এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে ওঠেন। তার পরিচিতি তখন তৈরি হয়েছিল ব্রাজিলের লুলা দা সিলভা এবং ভেনেজুয়েলার হুগো শাভেজের মতোই।

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, তিনি নিজের মতো করেই দেশ পরিচালনা করেছেন। এটি করতে গিয়ে তিনি নিতেন সাহসী ও বাস্তববাদী নানা সিদ্ধান্ত। তাঁর শাসনামলে উরুগুয়ের অর্থনীতি বার্ষিক গড়ে পাঁচ দশমিক চার শতাংশ হারে বেড়ে দাড়িয়েছিল। কমেছিল বেকারত্বের হার।

এই সময়ে উরুগুয়ে বেশ কিছু সামাজিক আইন পাস করে বিশ্বজুড়ে নজর কাড়েন মুহিকা। যেগুলোর মধ্যে গর্ভপাত বৈধকরণ, সমলিঙ্গ বিবাহ স্বীকৃতি এবং গাঁজা বাজার নিয়ন্ত্রণ।

মুহিকা প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় রাষ্ট্রপতির জন্য বরাদ্দ রাজপ্রাসাদে না গিয়ে শহরের বাইরে নিজের সাধারণ বাড়িতে স্ত্রী লুসিয়া টোপোলানস্কির সঙ্গে থাকতেন।

তার স্ত্রী নিজেও ছিলেন একজন রাজনীতিক ও সাবেক গেরিলা। তাদের কোনো গৃহকর্মী বা নিরাপত্তা বাহিনীও ছিল না।

মুহিকা খুবই সাধারণ পোশাক পরতেন। ১৯৮৭ সালের একটি হালকা নীল রঙের ভক্সওয়াগেন গাড়ি চালাতেন এবং নিজের বেতনের বেশিরভাগই দান করে দিতেন। সাদামাটা জীবন যাপনসহ এসব কারণে সংবাদ মাধ্যমগুলো তাকে “বিশ্বের সবচেয়ে গরিব প্রেসিডেন্ট” হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল। এই যে তাকে গরীব প্রেসিডেন্টে হিসেবে বলা হতো সেটি তিনি সব সময় প্রত্যাখ্যান করেছেন।

তিনি বলতেন, “তারা বলে আমি নাকি সবচেয়ে গরিব প্রেসিডেন্ট। না, আমি তা না। ২০১২ সালে নিজ বাড়িতে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “”দরিদ্র তারা যারা আরও বেশি চায়, কারণ তারা এক অন্তহীন দৌড়ে রয়েছে”।

মুহিকা ব্যক্তিগতভাবে মিতব্যায়ী নীতি অবলম্বন করলেও, তার সরকার উল্লেখযোগ্যভাবে জনসাধারণের ব্যয় বৃদ্ধি করে। ফলে রাজস্ব ঘাটতি বাড়তে থাকে। তখন বিরোধীরা তাকে অপচয়কারী হিসেবে অভিযুক্তও করেছিলেন। তবে শিক্ষাখাতে মুহিকার ভুমিকা নিয়ে কিছু প্রশ্ন ছিল। তার সময়ে উরুগুয়ের শিক্ষাখাতে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অগ্রগতি না করার জন্য সমালোচনা তৈরি হয়েছিল।

লাতিন আমেরিকার এই অঞ্চলের অন্যান্য নেতাদের মতো, তার বিরুদ্ধে কখনও দুর্নীতি বা দেশের গণতন্ত্রকে দুর্বল করার অভিযোগ ওঠেনি।

শাসনামলের শেষে তার জনপ্রিয়তা ছিল প্রায় ৭০ শতাংশ। তিনি সিনেটরও নির্বাচিত হয়েছিলে। এরপর তিনি বিশ্ব ভ্রমণে কিছু সময়ও ব্যয় করেছিলেন।

রাষ্ট্রপতি পদ ছাড়ার আগে তিনি একবার বলেছিলেন, “বিশ্ব কী নিয়ে এত বিস্মিত? আমি তো সামান্য জিনিসে বাঁচি, সাধারণ বাড়িতে থাকি, পুরনো গাড়ি চালাই? তাহলে এই পৃথিবী কি নিয়ে এত পাগল”।

২০২০ সালে মুহিকা রাজনীতি থেকে অবসর নেন। তবে উরুগুয়ের রাজনীতিতে তিনি ছিলেন এক কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে।

তার রাজনৈতিক উত্তরসূরি ইয়ামান্দু ওরসি ২০২৪ সালের নভেম্বরে উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং তার দল ফ্রেন্তে অ্যাম্পলিও পার্লামেন্টে সবচেয়ে বেশি আসন পায়।

গত বছর, মুহিকা জানিয়েছিলেন যে তার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। তিনি বলছিলেন যে মৃত্যু তার খুব সন্নিকটে।

গত বছরের নভেম্বরে বিবিসিকে দেওয়া শেষ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “সবার ক্ষেত্রে মৃত্যু অনিবার্য এবং সম্ভবত এটি জীবনের মধ্যে লবণের মতো।”