ঢাকা ১০:০১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

পথশিশুরা জড়াচ্ছে গ্যাং সংস্কৃতি ও মাদক কারবারে

অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট সময় : ০৩:০৩:৩২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫
  • / ৩৫১ বার পড়া হয়েছে
৭১ নিউজ বিডির সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

শিশুর জন্য এক টুকরো সাজানো বাগান, সে তো সবারই চাওয়া। কিন্তু পথশিশুদের ভাগ্যে কি তা জোটে? অনাদরে-অবহেলায় মৌলিক অধিকার বঞ্চিত হয়ে মলিন আর জীর্ণ-শীর্ণ জীবন তাদের। যাদের রোজকার জীবনে নেই আহারের নিশ্চয়তা, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক অধিকার তো আরও দূরের বিষয়। সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, সুযোগসন্ধানীদের হাত ধরে পথশিশুরা জড়াচ্ছে গ্যাং সংস্কৃতি ও মাদক কারবারে। এমন বাস্তবতায় শিশু অধিকার কর্মীদের দাবি, শিশুদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় গঠনের। আর সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর বলছে, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সুরক্ষায় বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো জরুরি।

মৌলিক অধিকার বঞ্চিত এসব শিশুর নেই কোন নাগরিক সুবিধা। নির্যাতন, অপুষ্টি আর নিরাপত্তাহীনতায় বেড়ে ওঠা ভয়াবহ এক শৈশব।

যে বয়সটা পড়ার সময়, সেই বয়সে কাজে কেউ তাদের করে না আদর, নেয় না বুকে গুঁজে। ঝরা ফুলের মতোই ভাগ্য এসব শিশুদের। অবহেলা আর অনাদর যাদের নিত্যসঙ্গী।

মা হারিয়ে বাবার সাথে পথের ধারে ঠাঁই হয়েছে চার বছরের শিশু সিয়ামের। যেন পথের ফুল নিজের হাতে বুনছে ফুলের মালা। বিক্রি করে যোগাবেন দুই ভাই-বোনের খাবার।

এক শিশু জানায়, নুডুলস তার প্রিয়, ছোটবেলায় মা নুডুলস খাওয়াতো। তারপর থেকে অন্য কারো হাতে নুডুলস খাই না। আমার অনেক মন চায় স্কুলে যেয়ে বাচ্ছাদের সাথে খেলতে। আরেক শিশু জানায়, ফুল বেইচ্চা টেহা দিয়া ভাত খাই।

শৈশবের গ্লানিময় বাস্তবতা নিয়ে পথেই বেড়ে উঠছে হাজারো শিশু। পাতে মেলে না পুষ্টিকর খাবার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২৩-এর জরিপ বলছে, সারাদেশে পথশিশুর সংখ্যা প্রায় ১০ লক্ষাধিক। যার প্রায় ৮২ শতাংশই ছেলে। যাদের ১৩ শতাংশ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন আর ৬ শতাংশ এতিম।

সমীক্ষার তথ্য আরও বলছে, প্রতি ৫ জনে একজন ছিন্নমূল শিশু ভাঙারি সংগ্রহ করে। ১৫ শতাংশ শিশু বিভিন্ন দোকানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে আর ৯ শতাংশ পথেঘাটে ফেরি করে বেড়ায়। সার্ভে অন স্ট্রিট চিলড্রেনের তথ্য বলছে, খোলা আকাশের নিচে বসবাসকারী শিশুদের ৮২.৯ শতাংশ নির্যাতনের শিকার হয়।

সমাজ বিশ্লেষকদের মতে, অপরাধী সংগঠনগুলোর টার্গেটের শিকার হচ্ছে পথশিশুরা। ব্যবহৃত হচ্ছে গ্যাং কালচার ও মাদক বহনের মত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে। এই ভয়াবহতা থেকে মুক্তি পেতে টেকসই প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারিভাবে উদ্যোগ নেয়ার তাগিদ দেন তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ৈর সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘রাষ্ট্র বা বেসরকারি উন্নয়র প্রতিষ্ঠানগুলো যদি সঠিকভাবে পরিচালিত করতে বা বড় করতে না পারে এরাই সমাজের ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলবে। কীভাবে নষ্ট করবে, তারা নানা ধরনের অপরাধের সাথে নিজেরা বেঁচে থাকার জন্য জড়িত হবে। সমাজের যারা স্বার্থান্বেষী জনগোষ্ঠী তাদের একত্র করে বিভিন্ন গ্যাং, দল বা উপদল তৈরি করে এদের নিয়ে নানা ধরনের অপরাধ করাবে। এর মাধ্যমে সমাজের স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট হবে।’

শিশু অধিকারকর্মীরা বলছেন, অবহেলিত এই জনগোষ্ঠীকে পেছনে রেখে দেশের সার্বিক অগ্রগতি সম্ভব নয়। প্রয়োজনে শিশুদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় গঠনেরও পরামর্শ তাদের।

শিশু অধিকার কর্মী জাহাঙ্গীর নাকির বলেন, ‘সে যে খাবার খাচ্ছে সেটা কিন্তু অস্বাস্থ্যকর। এবং যখন তারা অসুস্থ হচ্ছে তখন তারা চিকিৎসা পাচ্ছে না। শিশুদের জন্য যে বাজেট হয় সেটা কিন্তু কাজে আসে না।’

বাসস্থান, নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সবধরনের সংকট আর আলোকের ঝর্ণাধারায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের ফেরাতে কাজ করছে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা। শুধু প্রকল্পে আটকে না থেকে তা কার্যকরে গতি আনতে সবাইকে সমন্বিত উদ্যোগে গুরুত্ব দেন তারা।

সেভ দ্য চিলড্রেনের চাইল্ড প্রোটেকশন অ্যান্ড চাইল্ড রাইটস গভর্নেন্সের পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘পরিকল্পনা থাকতে হবে, বাজেট থাকতে হবে, জবাবদিহিতা থাকতে হবে মনিটরিং থাকতে হবে। এখন প্রকল্প এটা করে না। প্রকল্প আমাদের শিক্ষা দেয় এটা কাজ করবে কি করবে না, টেস্টের মতো। কিন্তু যখন টেস্টেড হয়, যে এটি ভালো কাজ করবে তাহলে সেটিকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি নেয়া দরকার।’

সমাজসেবা অধিদপ্তর বলছে, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চলমান রয়েছে বিভিন্ন মেয়াদি প্রকল্প। অপব্যবহার আর শোষণ থেকে শিশুদের সুরক্ষায় বাজেট বৃদ্ধিরও আশ্বাস দেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, ‘মেন্টাল ডেভেলপমেন্ট, শারিরীক, মানসিক বিকাশের পাশাপাশি সে যেন পরিবারে ফিরে যেতে পারে এবং কর্মসংস্থানে নিয়োজিত থাকতে পারে এজন্য তাদের আমরা বিনোদনমূলক কর্মসূচিতে যুক্ত করে থাকি। এজন্য ৪৩ কোটি টাকার বাজেট রাখা হয়েছে। আগামী অর্থবছরে আমরা আশা করি এ বাজেট আরো বৃদ্ধি করা হবে।’

অন্ধকার আর অবহেলার নিয়তি থেকে পথের শিশুরা ফিরবে কবে বা কিভাবে ফিরবে আলোর পথে? এই প্রশ্ন হয়তো সবার, কিন্তু উত্তর মেলানোর দায়িত্ব ঠিক কার?

নিউজটি শেয়ার করুন

পথশিশুরা জড়াচ্ছে গ্যাং সংস্কৃতি ও মাদক কারবারে

আপডেট সময় : ০৩:০৩:৩২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫

শিশুর জন্য এক টুকরো সাজানো বাগান, সে তো সবারই চাওয়া। কিন্তু পথশিশুদের ভাগ্যে কি তা জোটে? অনাদরে-অবহেলায় মৌলিক অধিকার বঞ্চিত হয়ে মলিন আর জীর্ণ-শীর্ণ জীবন তাদের। যাদের রোজকার জীবনে নেই আহারের নিশ্চয়তা, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক অধিকার তো আরও দূরের বিষয়। সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, সুযোগসন্ধানীদের হাত ধরে পথশিশুরা জড়াচ্ছে গ্যাং সংস্কৃতি ও মাদক কারবারে। এমন বাস্তবতায় শিশু অধিকার কর্মীদের দাবি, শিশুদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় গঠনের। আর সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর বলছে, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সুরক্ষায় বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো জরুরি।

মৌলিক অধিকার বঞ্চিত এসব শিশুর নেই কোন নাগরিক সুবিধা। নির্যাতন, অপুষ্টি আর নিরাপত্তাহীনতায় বেড়ে ওঠা ভয়াবহ এক শৈশব।

যে বয়সটা পড়ার সময়, সেই বয়সে কাজে কেউ তাদের করে না আদর, নেয় না বুকে গুঁজে। ঝরা ফুলের মতোই ভাগ্য এসব শিশুদের। অবহেলা আর অনাদর যাদের নিত্যসঙ্গী।

মা হারিয়ে বাবার সাথে পথের ধারে ঠাঁই হয়েছে চার বছরের শিশু সিয়ামের। যেন পথের ফুল নিজের হাতে বুনছে ফুলের মালা। বিক্রি করে যোগাবেন দুই ভাই-বোনের খাবার।

এক শিশু জানায়, নুডুলস তার প্রিয়, ছোটবেলায় মা নুডুলস খাওয়াতো। তারপর থেকে অন্য কারো হাতে নুডুলস খাই না। আমার অনেক মন চায় স্কুলে যেয়ে বাচ্ছাদের সাথে খেলতে। আরেক শিশু জানায়, ফুল বেইচ্চা টেহা দিয়া ভাত খাই।

শৈশবের গ্লানিময় বাস্তবতা নিয়ে পথেই বেড়ে উঠছে হাজারো শিশু। পাতে মেলে না পুষ্টিকর খাবার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২৩-এর জরিপ বলছে, সারাদেশে পথশিশুর সংখ্যা প্রায় ১০ লক্ষাধিক। যার প্রায় ৮২ শতাংশই ছেলে। যাদের ১৩ শতাংশ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন আর ৬ শতাংশ এতিম।

সমীক্ষার তথ্য আরও বলছে, প্রতি ৫ জনে একজন ছিন্নমূল শিশু ভাঙারি সংগ্রহ করে। ১৫ শতাংশ শিশু বিভিন্ন দোকানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে আর ৯ শতাংশ পথেঘাটে ফেরি করে বেড়ায়। সার্ভে অন স্ট্রিট চিলড্রেনের তথ্য বলছে, খোলা আকাশের নিচে বসবাসকারী শিশুদের ৮২.৯ শতাংশ নির্যাতনের শিকার হয়।

সমাজ বিশ্লেষকদের মতে, অপরাধী সংগঠনগুলোর টার্গেটের শিকার হচ্ছে পথশিশুরা। ব্যবহৃত হচ্ছে গ্যাং কালচার ও মাদক বহনের মত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে। এই ভয়াবহতা থেকে মুক্তি পেতে টেকসই প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারিভাবে উদ্যোগ নেয়ার তাগিদ দেন তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ৈর সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘রাষ্ট্র বা বেসরকারি উন্নয়র প্রতিষ্ঠানগুলো যদি সঠিকভাবে পরিচালিত করতে বা বড় করতে না পারে এরাই সমাজের ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলবে। কীভাবে নষ্ট করবে, তারা নানা ধরনের অপরাধের সাথে নিজেরা বেঁচে থাকার জন্য জড়িত হবে। সমাজের যারা স্বার্থান্বেষী জনগোষ্ঠী তাদের একত্র করে বিভিন্ন গ্যাং, দল বা উপদল তৈরি করে এদের নিয়ে নানা ধরনের অপরাধ করাবে। এর মাধ্যমে সমাজের স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট হবে।’

শিশু অধিকারকর্মীরা বলছেন, অবহেলিত এই জনগোষ্ঠীকে পেছনে রেখে দেশের সার্বিক অগ্রগতি সম্ভব নয়। প্রয়োজনে শিশুদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় গঠনেরও পরামর্শ তাদের।

শিশু অধিকার কর্মী জাহাঙ্গীর নাকির বলেন, ‘সে যে খাবার খাচ্ছে সেটা কিন্তু অস্বাস্থ্যকর। এবং যখন তারা অসুস্থ হচ্ছে তখন তারা চিকিৎসা পাচ্ছে না। শিশুদের জন্য যে বাজেট হয় সেটা কিন্তু কাজে আসে না।’

বাসস্থান, নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সবধরনের সংকট আর আলোকের ঝর্ণাধারায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের ফেরাতে কাজ করছে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা। শুধু প্রকল্পে আটকে না থেকে তা কার্যকরে গতি আনতে সবাইকে সমন্বিত উদ্যোগে গুরুত্ব দেন তারা।

সেভ দ্য চিলড্রেনের চাইল্ড প্রোটেকশন অ্যান্ড চাইল্ড রাইটস গভর্নেন্সের পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘পরিকল্পনা থাকতে হবে, বাজেট থাকতে হবে, জবাবদিহিতা থাকতে হবে মনিটরিং থাকতে হবে। এখন প্রকল্প এটা করে না। প্রকল্প আমাদের শিক্ষা দেয় এটা কাজ করবে কি করবে না, টেস্টের মতো। কিন্তু যখন টেস্টেড হয়, যে এটি ভালো কাজ করবে তাহলে সেটিকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি নেয়া দরকার।’

সমাজসেবা অধিদপ্তর বলছে, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চলমান রয়েছে বিভিন্ন মেয়াদি প্রকল্প। অপব্যবহার আর শোষণ থেকে শিশুদের সুরক্ষায় বাজেট বৃদ্ধিরও আশ্বাস দেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, ‘মেন্টাল ডেভেলপমেন্ট, শারিরীক, মানসিক বিকাশের পাশাপাশি সে যেন পরিবারে ফিরে যেতে পারে এবং কর্মসংস্থানে নিয়োজিত থাকতে পারে এজন্য তাদের আমরা বিনোদনমূলক কর্মসূচিতে যুক্ত করে থাকি। এজন্য ৪৩ কোটি টাকার বাজেট রাখা হয়েছে। আগামী অর্থবছরে আমরা আশা করি এ বাজেট আরো বৃদ্ধি করা হবে।’

অন্ধকার আর অবহেলার নিয়তি থেকে পথের শিশুরা ফিরবে কবে বা কিভাবে ফিরবে আলোর পথে? এই প্রশ্ন হয়তো সবার, কিন্তু উত্তর মেলানোর দায়িত্ব ঠিক কার?