নির্বাচনী চাপের মুখে পদত্যাগের হুমকি দিলেন ড. ইউনূস: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস

- আপডেট সময় : ০৬:১২:১৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৪ মে ২০২৫
- / ৩৫৩ বার পড়া হয়েছে

সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস বলেছে, ‘গত আগস্টে ছাত্রদের নেতৃত্বে একটি আদর্শবাদী আন্দোলন যখন শেখ হাসিনার ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচারী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে, তখন বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ গণতন্ত্রের আসন্ন পুনরুজ্জীবন উদযাপন করেছিল। এর প্রায় ৯ মাস পর অন্তর্বর্তী সরকার তাদের সবাইকে হতাশ করেছে, যারা এখনই একটি জাতীয় নির্বাচন চায়। এখন দেশটির খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব শান্তিতে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস হুমকি দিচ্ছেন, তাঁকে যদি কাজ চালিয়ে যেতে দেওয়া না হয় এবং ধীরেসুস্থে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে না দেওয়া হয়, তাহলে তিনি পদত্যাগ করবেন।’
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, অধ্যাপক ইউনূস একজন আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন ও সম্মানিত ব্যক্তি। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য তাঁকেই সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি হিসেবে মনে করা হচ্ছিল। রাস্তায় যখন রক্তপাত চলছিল, তখন তাঁকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু তাঁর সহযোগীরা বলছেন, দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল ও সেনাবাহিনীর মধ্যে এক ধরনের জোট তৈরি হওয়ায় তিনি কাজ করতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন বলে মনে করছেন। এই উদীয়মান জোট তাঁর নীতির সমালোচনা করছে এবং বলছে, তিনি নির্বাচন আয়োজনে অত্যন্ত ধীর গতিতে এগোচ্ছেন।’
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস বলেছে, গত বৃহস্পতিবার অধ্যাপক ইউনূস হুমকি দিয়ে বলেন, তিনি যদি অবাধে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক ও সামরিক সমর্থন না পান, তাহলে পদত্যাগ করবেন। অধ্যাপক ইউনূস তাঁর পদত্যাগের ঘোষণার একটি খসড়া বক্তৃতাও তৈরি করেছিলেন বলে তাঁর সরকারের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে অন্যান্য উপদেষ্টারা তাঁকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, তিনি পদত্যাগ করলে বাংলাদেশ আরও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে পড়বে। ওই কর্মকর্তা টেলিফোনে বলেন, এ বছরই নির্বাচন হতে হবে—সম্প্রতি সেনাপ্রধানের দেওয়া এমন বক্তব্যে অধ্যাপক ইউনূস অসন্তুষ্ট হয়েছেন। একই সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের সমালোচনায় তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্বাচন যত তাড়াতাড়ি হবে শেখ হাসিনার পুরোনো শত্রুরা তত লাভবান হবে। তারা নির্বাচনে জয় পাওয়ার মতো অবস্থায় রয়েছে। শেখ হাসিনার দল লাঞ্ছনার মধ্যে রয়েছে এবং সম্প্রতি তাঁর দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশটিতে কার্যত কোনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নেই। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে এবং তা ঠিক করার চেষ্টাও বেশ এলোমেলো। ফলে পুরো দেশ পর্যুদস্ত অবস্থায় রয়েছে। অধ্যাপক ইউনূস সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ক্রমবর্ধমান চাপের মধ্যে রয়েছেন। তাঁর কোনো নিজস্ব রাজনৈতিক সমর্থন নেই।
অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও গবেষণা ফেলো মোবাশ্বের হাসান এ বিষয়ে দ্য নিউইয়র্ক টাইমসকে বিশেষজ্ঞ মত দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘অধ্যাপক ইউনূস একজন খ্যাতিমান ব্যাংকার হতে পারেন, তিনি প্রতিষ্ঠান চালানোর ব্যাপারেও দক্ষ সংগঠক হতে পারেন, কিন্তু তাঁর মধ্যে যে অভাবটি দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে, সেটি হলো, তাঁর দৃঢ় ও শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব নেই।’
মোবাশ্বের হাসান মনে করেন, অধ্যাপক ইউনূস তাঁর উপদেষ্টাদের দ্বারা সম্ভবত একটু বেশিই প্রভাবিত হচ্ছেন।
অধ্যাপক ইউনূসের একজন ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তা দ্য নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, দেশের গণতন্ত্রকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য যাদের তাঁকে সাহায্য করার কথা ছিল, তারা তাঁকে উপেক্ষা করছেন বলে মনে করছেন ড. ইউনূস। এরই মধ্যে গত বুধবার সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, ‘ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত।’ এরপরই তিনি সম্ভবত ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলেছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অধ্যাপক ইউনূস এর আগে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। তবে তিনি কোনো স্পষ্ট সময়সীমা উল্লেখ করেননি। তিনি তাঁর মন্ত্রীসভাকে জানিয়েছেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত নয় বলে তিনি মনে করেন। গত নভেম্বরে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অধ্যাপক ইউনূস বলেছিলেন, ‘নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে। এটি আর থামবে না। এই পথেই আমাদের অনেক কাজ শেষ করতে হবে।’
দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) জোর দিয়ে বলছে যে, যে দেশের ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণের আগে একটি গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেট দরকার। তাদের চিরকালের প্রতিদ্বন্দ্বী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ার পর, সাবেক এই বিরোধী দলটি ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ নিতে চাইছে। বিএনপি প্রথম দিকে অধ্যাপক ইউনূসের সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে নীতিগত বিরোধের কারণে তারা সহযোগিতা বন্ধ করে দিয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে, অধ্যাপক ইউনূস ও তাঁর কর্মকর্তারা দেশের সবচেয়ে বড় সমুদ্রবন্দর চট্রগ্রাম বন্দরকে বেসরকারিকরণ করতে চান, মিয়ানমারের যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলের জন্য একটি সাহায্য করিডোর খুলতে চান এবং বাংলাদেশের প্রধান কর কর্তৃপক্ষকে (এনবিআর) আলাদা করতে চান।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে, দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতাকে স্থিতিশীল করা ৮৪ বছর বয়সী এই অর্থনীতিবিদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ এবং কখনো কখনো অসাধ্য বলে এরই মধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। দেশের দুটি বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের একটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ার পর অন্যটি দ্রুত নির্বাচন চাইছে। এমন পরিস্থিতিতে অধ্যাপক ইউনূস সময় নিতে চাইছেন বলে মনে করা হচ্ছে। এতে সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল বিশ্লেষকেরাও বিরক্ত হচ্ছেন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মোবাশ্বের হাসান নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। এটি সম্পূর্ণরূপে সরকারের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাতে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র আন্দোলনকারীরা সরকার পতনের পর থেকে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সঙ্গে সহিংস সংঘাতে লিপ্ত হয়েছেন। তারা বিএনপিকেও সেই জায়গাতে বসাতে ভয় পাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে দেশের বেশির ভাগ মানুষ এখনো অধ্যাপক ইউনূসের ওপরেই আস্থা রাখছেন।
অধ্যাপক ইউনূসের একজন সাবেক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম গত ফেব্রুয়ারিতে ন্যাশনাল সিটিজেনস পার্টি (এনসিপি) নামে একটি রাজনৈতিক দল খোলেন। তিনি আশা করেন, ছাত্ররা তাঁর দলে ভিড়বে। নাহিদ ইসলাম বলেছেন, তিনি অধ্যাপক ইউনূসকে পদত্যাগ না করার জন্য অনুরোধ করেছেন। গত বৃহস্পতিবার তাঁরা দুজনে কথা বলেছেন। তখন অধ্যাপক ইউনূস বলেছেন, দায়িত্ব নেওয়ার সময় তাঁকে যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, সেসব প্রতিশ্রুতি এখন ভঙ্গ করা হচ্ছে।
নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, ‘বিভিন্ন গোষ্ঠী অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে এবং সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। তিনি (অধ্যাপক ইউনূস) মনে করছেন, তাঁর পক্ষে আর কার্যকরভাবে তার দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়।’