ঢাকা ১০:২৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৬ জুন ২০২৫, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

প্রস্তাবিত বাজেট একমুখী ও গতানুগতিক: বিএনপি

অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট সময় : ০৫:০২:৩৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ৪ জুন ২০২৫
  • / ৩৬০ বার পড়া হয়েছে
৭১ নিউজ বিডির সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) বাজেটবিষয়ক বক্তব্যে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী জানিয়েছেন, আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট একমুখী ও গতানুগতিক হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে বাজেট দেয়া উচিত ছিল বলেও মত দেন তিনি। আজ (বুধবার, ৪ জুন) দলের পক্ষে আমির খসরু লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। সেখানেই এ তথ্য জানানো হয়।

বিএনপির পক্ষ থেকে দেয়া বাজেটবিষয়ক বক্তব্য তুলে ধরা হলো—

২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর প্রথম বাজেট। একই সঙ্গে, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে একটি বড় নীতিনির্ধারণী উপলক্ষ। পতিত স্বৈরাচারি সরকার অর্থনীতিকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে রেখে গেছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম অঙ্গীকার ছিল ন্যায্য ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থা। জনগণের জীবনযাত্রার অগ্রাধিকার। এ কারণেই ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক পরিকল্পনা। এটি রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকেও গভীর তাৎপর্য বহন করে।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯১ সালের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন ও জুলাই অভ্যুত্থান গণতন্ত্রের সংগ্রাম। বার্ষিক বাজেট গণতন্ত্রের একটি মৌলিক স্তম্ভ। বাজেট রাজনৈতিক সরকারের জনগণ থেকে প্রাপ্ত ম্যান্ডেট ও অগ্রাধিকার প্রতিফলিত করার কৌশল ও বাস্তবায়ন কাঠামোর আর্থিক প্রতিবেদন। প্রতিটি দফা যাচাই-বাছাই ও কাটছাঁট করে অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ জনগণের মৌলিক অধিকারের আইনি কাঠামো প্রদান করেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ‘ম্যাগনা কার্টা’ কর আরোপের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকে সীমিত করেছিল। যুক্তরাজ্যে ‘গৌরবময় বিপ্লব’ কর ও ব্যয়ের উপর সংসদের কর্তৃত্বকে সুদৃঢ় করেছিল। ‘প্রতিনিধিত্ব ছাড়া কর আরোপ নয়’- এই স্লোগান আমেরিকান বিপ্লবের ভিত্তি।

আমরা এক যুগান্তকারী নজির তৈরি করতে পারতাম। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল সর্বক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহযোগিতা করছে। আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আন্দোলনকারী রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করে ন্যূনতম জাতীয় ঐকমত্য স্থাপনের মাধ্যমে বাজেট প্রণয়ন করবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চাইলে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামত নিতে পারত। বিশেষজ্ঞ, নাগরিক সমাজ, ব্যবসায়ী ও তরুণ প্রতিনিধিরাও অংশ করতে পারতেন। তাহলে বাজেট একটি সমন্বিত অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতীক হতো। দেশের বিভিন্ন কণ্ঠের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠত এই বাজেট। কিন্তু সে সুযোগটি কাজে লাগানো হয়নি। বাজেট প্রণয়ন একমুখী, অংশগ্রহণহীন ও গতানুগতিক ধারার হত না। নতুন চিন্তার প্রতিফলন ঘটত।

বর্তমানের বিশেষ পরিস্থিতিতে এই সংলাপ আরো জরুরি ছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলছে, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করবে। অর্থাৎ ২০২৫-২৬ বাজেটীয় বছরে নির্বাচিত সরকার আসবে। ওয়েস্টমিনিস্টার ঐতিহ্য অনুসরণকারী অনেক দেশেই ‘অন্তর্বর্তীকালীন শাসন সংক্রান্ত রীতিনীতি’ আছে, যা বাংলাদেশে নাই। সাধারণ নির্বাচন আসন্ন হলে বা নতুন সরকারের সম্ভাবনা থাকলে বাজেট অনুমোদনের ভিন্ন পন্থা থাকে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নীতি-কাঠামোর বড় ধরনের পরিবর্তন করে না। উল্লেখযোগ্য কর সমন্বয় বা নতুন, বৃহৎ আকারের আর্থিক প্রতিশ্রুতিও দেয় না।

রাজনৈতিক সংলাপ হলে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে ব্যয় বরাদ্দে বাস্তবসম্মত পুনর্বিন্যাস হত। স্বৈরাচারি সরকারের সীমাহীন জনবান্ধবহীন নীতি-কাঠামো উদ্ভূত দীর্ঘমেয়াদী উচ্চ মূল্যস্ফীতিজনিত সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যয় নির্বাহের সংকট থেকে মুক্তির দিকনির্দেশনা থাকত। দারিদ্র বৃদ্ধির হারে লাগাম টানা যেত। মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির নিচে থাকায় প্রকৃত আয় কমেছে। দারিদ্র্য বৃদ্ধির পাশাপাশি ভোক্তা ব্যয়ের উপরও চাপ সৃষ্টি করেছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ স্থবির হওয়ায় আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক প্রায় সব খাতেই কর্মসংস্থান কমেছে। ফলে সমাজে ভাঙন ধরেছে; দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে। কৃষি উৎপাদন প্রবৃদ্ধি গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে। অপর্যাপ্ত, ত্রুটিপূর্ণ, দুর্নীতিগ্রস্ত সামাজিক সুরক্ষা খাতে পেনশন ও কৃষি ভর্তুকি অন্তর্ভুক্ত করে বরাদ্দ বাড়ানোর চেষ্টা হিসেবে দেখানো হলেও সামাজিক সুরক্ষার জন্য সরকারি বরাদ্দ অপর্যাপ্ত থেকে যাচ্ছে। আজ অবধি সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচিগুলো অধিকারভিত্তিক হল না।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ কমানো উদ্বেগজনক। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, কলেজ ও স্কুলগুলোকে পূর্ণাঙ্গ কর মওকুফের আওতায় আনা যেত। এতে তরুণ সমাজের শিক্ষা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ হত। সামাজিক সমতা ও মেধাভিত্তিক সমাজ নির্মাণে সহায়ক হত। শিক্ষার দুর্বল ফলাফল ও তরুণদের মধ্যে উচ্চশিক্ষা, কর্মসংস্থান বা প্রশিক্ষণ না থাকার বিশাল হার ডেমগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক লভ্যাংশ অর্জনের পথে প্রতিবন্ধক। এসব খাতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ না হলে মানবসম্পদ উন্নয়ন ও দারিদ্র্য হ্রাসে অগ্রগতি সম্ভব নয়। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন দুরূহ হয়ে যাচ্ছে।

অর্থনৈতিক কাঠামোর দুর্বলতাগুলোর সমাধানে সুস্পষ্ট রূপরেখার প্রয়োজন ছিল। প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল, বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির পথ-নকশা উপস্থাপন। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে শিল্প কারখানা স্থাপন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষিতে অগ্রাধিকার দেওয়ার দরকার ছিল। জরুরি ছিল ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি বিভিন্ন খাতে সহায়তার মাধ্যমে আরো নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির। বিশাল সুদের হারের সাথে অতিরিক্ত কর ও শুল্ক শিল্পে বড় চাপ সৃষ্টি করবে। বিশেষ করে, উৎপাদনশীল খাতগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কর্মসংস্থানও কমতে পারে। মধ্যম ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির উপর আর্থিক চাপ বাড়লে অর্থনৈতিক অস্থিরতা বাড়তে পারে। দারিদ্র্য বিমোচনের অগ্রগতিও থমকে যেতে পারে।

ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় কমানো, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা হ্রাস এবং ‘কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস’ কমানোরও কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকায় উদ্যোক্তারা অনিশ্চিত ও প্রতিকূল পরিবেশের মুখোমুখি হবেন।

অনলাইন ব্যবসার ওপর শুল্ক বাড়ানোয় ডিজিটাল উদ্যোক্তারা চাপে পড়বেন। এই খাত নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও ডিজিটাল রূপান্তরে বড় ভূমিকা রাখতে পারত। তরুণ উদ্যোক্তাদের হতাশা বাড়বে। উদ্ভাবনও নিরুৎসাহিত হবে।

আর্থিক খাতের ভঙ্গুরতাও কাটেনি। পুঁজিবাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীগণ অবহেলিতই থেকে গেলেন। ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা নাজুক। খেলাপি ঋণ আদায়, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা এবং করজাল সম্প্রসারণের মত পদক্ষেপ নিলে রাজস্ব আহরণে নতুন ভিত্তি তৈরি হত। সরকার ব্যাংক খাতের উপর বেশি নির্ভরশীল। ‘ঋণ করে ঋণ শোধ’ দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ কর ফাঁকি প্রদানকারীদের পুরস্কৃত করছে। নিয়মিত করদাতাদের প্রতি এটি অবিচার। করব্যবস্থার প্রতি আস্থা কমতে পারে। আয়কর স্লাবে কর হারের পরিবর্তন অধিকাংশ করদাতাদের উপর আরও অভিঘাত ফেলবে। কর ফাঁকি ও জালিয়াতি রোধ এবং করজাল সম্প্রসারণ না করে ভ্যাট বৃদ্ধির মাধ্যমে বরাবরের মত করের বোঝা সাধারণ জনগণের কাঁধে চাপানো হয়েছে। পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। জীবনযাত্রার মান কমছে।

অপ্রয়োজনীয়, দুর্নীতিগ্রস্ত ও অদক্ষ উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বন্ধ বা সংস্কারের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। এসব প্রকল্পের অর্থনৈতিক ফলাফল পর্যালোচনা করা জরুরি। প্রয়োজনে রিভিউ বা রিনেগোসিয়েট করা যেতে পারে। এতে ব্যয় কমিয়ে জনকল্যাণে বরাদ্দ বাড়ানো সম্ভব হবে।

বিএনপির ১৮০ দিনের পরিকল্পনা

অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা, মানুষের আস্থা অর্জন এবং ভবিষ্যতের জন্য দৃঢ় ভিত্তি গড়তে প্রয়োজন স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও উদ্ভাবনী অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। গতানুগতিকতা ছেড়ে সাহসী ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে। তাহলেই জাতির জন্য আশা, আস্থা ও পুনর্গঠনের দিগন্ত উন্মোচন হবে।

বিশ্বের অনেক দেশে রাজনৈতিক দল নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম ১০০ দিনে কী কী কাজ করবে, তার পরিকল্পনা প্রকাশ করে থাকে। জনগণের ক্ষমতায়নের দল হিসেবে বিএনপি বাংলাদেশে এমন একটি বাস্তবসম্মত সংস্কৃতি প্রবর্তন করতে চায়।

জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠনের পর প্রথম ১৮০ দিনের মধ্যে আমাদের লক্ষ্য ও পরিকল্পনা নির্বাচনের আগেই নির্ধারণ করা হবে।

এই ৬ মাসের পরিকল্পনার ভিত্তিতে একটি অ্যাকশন-ওরিয়েন্টেড রোডম্যাপ প্রণয়ন করা হবে। বিভিন্ন সেক্টরে বিএনপি কী-কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, আমরা সেগুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরব। এখানে সার-সংক্ষেপ দেওয়া হল—

শিক্ষা ব্যবস্থা: প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের অর্থনৈতিক সুবিধা ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করা এবং তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আওতায় আনা হবে।

দেশের ও প্রবাসী শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হবে। মূল লক্ষ্য হবে – প্রাথমিক পর্যায় থেকে বহু ভাষা, ক্রীড়া, কৃষ্টি এবং ব্যক্তিগত ও পেশাগত উন্নয়নসহ বাস্তবানুগ বিষয়সমূহ শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা।

সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্লাম্বিং, ইলেকট্রিশিয়ান, মেকানিক্স, ডেন্টাল হাইজেনিস্ট, মেডিক্যাল টেকনিশিয়ান ইত্যাদির স্বল্পমেয়াদি ‘ট্রেড কোর্স’ চালু করা হবে।

শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাস্তবমুখী করতে এপ্রেন্টিসশিপ, ইন্টার্নশিপ এবং ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। প্রাথমিকভাবে বিভাগীয় শহরগুলোতে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে স্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক স্থাপন করে এই কার্যক্রম শুরু করা হবে। ফলে শিক্ষার্থীগণ হাতে কলমে শিক্ষা লাভ করবে এবং কর্মজীবনে ব্যপক হারে প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি করবে।

জেলা পর্যায়ে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনোভেটিভ বিজনেস আইডিয়া বাণিজ্যিকিকরণ করতে প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়ায় সিড ফান্ডিং বা ইনোভেশন গ্র্যান্ট প্রদান করা হবে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো, ক্যাম্পাস থেকে ব্যবসায়িক উদ্যোক্তা তৈরি করা। তারা নতুন এবং সৃজনশীল ব্যবসায়িক ধারণা বাস্তবায়ন করে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারবেন।

স্বাস্থ্য সেবা: রোগ প্রতিরোধকে প্রাধান্য দিয়ে টিকাদান, স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং সচেতনতা তৈরির একাধিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, স্যানিটেশন এবং পুষ্টির উপর জনগণের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করা হবে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য স্পেশালাইজড ট্রেনিং স্কিম শুরু করা হবে। তারা রোগের দ্রুত শনাক্তকরণ এবং প্রতিরোধে দক্ষ হয়ে উঠবেন। নিরাপদ পানি সরবরাহের জন্য আধুনিক পরিশোধন ব্যবস্থা ও বৃষ্টির পানি সংগ্রহের জন্য পর্যায়ক্রমে দেশব্যাপী রিসার্ভার তৈরি করা হবে। জনগণ নিরাপদ পানি পাবে।

নারীর ক্ষমতায়ন: প্রায় প্রান্তিক চার কোটি পরিবারের মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে ৫০ লাখ দরিদ্র গ্রামীণ পরিবারের জন্য ‘ফ্যামিলি কার্ড’ চালু করা হবে। এই কার্ড মূলত পরিবারের নারী প্রধানের নামে ইস্যু করা হবে। তাদের প্রতিমাসে রাষ্ট্রীয়ভাবে আর্থিক সহায়তা অথবা প্রয়োজনীয় খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হবে। এর মাধ্যমে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হবে এবং পরিবারগুলো ধীরে ধীরে স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে। নারীদের নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে। বিচারিক প্রক্রিয়ায় ধর্ষক-নিপীড়কদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। নারীদের জন্য ইউনিয়ন পর্যায়ে ডেডিকেটেড সাপোর্ট সেল প্রতিষ্ঠা করা হবে। সেখানে যেকোনো লাঞ্চিত নারীর জন্য প্রয়োজন মোতাবেক নারী ডাক্তার, আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী সর্বাঙ্গীন সহায়তা নিশ্চিত করবে। নারীদের স্বনির্ভরতা বাড়াতে ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্পে যোগ্যতার ভিত্তিতে স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা হবে। তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং ডেভেলপমেন্ট ও মার্কেটিং সাপোর্ট প্রদান করা হবে।

শহীদদের স্বীকৃতি: জুলাই গঅভ্যূত্থানে এবং ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে সব শহীদের তালিকা প্রস্তুত করে নিজ-নিজ এলাকায় তাদের নামে সরকারি স্থাপনার নামকরণ করা হবে। শহীদ পরিবারগুলোসমূহকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করা হবে। গণঅভ্যুত্থানে ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে যেসব গণতন্ত্রকামী ব্যক্তি পঙ্গু হয়েছেন, চোখ হারিয়েছেন তাদেরও স্বীকৃতি ও চাকরির সহায়তা প্রদান করা হবে।

কৃষি খাত ও গ্রামীণ উন্নয়ন: কৃষকের নামে জমির পরিমাণ ও খতিয়ানসহ প্রয়োজনীয় তথ্যসংবলিত ‘ফার্মার্স কার্ড’ চালু করা হবে। বর্গাচাষি ও ক্ষুদ্র কৃষকের জন্য কমপক্ষে একটি মৌসুমি ফসলের জন্য সম্পূর্ণ উৎপাদন খরচ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বহন করা হবে। এর ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং কৃষিজমি অনাবাদি থাকবে না। ভূমিহীনদের জন্যও কর্মসংস্থান তৈরি হবে। কৃষকের কাছ থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে রাষ্ট্র ন্যায্যমূল্যের ভিত্তিতে সরাসরি উৎপাদিত পণ্য ক্রয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করবে এবং দেশব্যাপী কোল্ড স্টোরেজ তৈরির কাজ শুরু হবে। কৃষিজাত পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ, মানোন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি করে কৃষি খাতকে রপ্তানিমুখীন গড়ে তোলা হবে। এলাকাভিত্তিক ডাটাবেস তৈরির করা হবে। কৃষকের জমির ও উৎপাদিত ফসলের পরিমানের তথ্য-উপাত্ত নির্ণয় করে টার্গেটেড পলিসি সাপোর্ট দেওয়া হবে। বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য চাঁদাবাজি, মধ্যস্বত্বভোগী ও ফ্যাসিবাদের রেখে যাওয়া সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। দেশব্যাপী খাল খননের কার্যক্রম ব্যাপকভাবে শুরু করা হবে। বন্যা ও খরা থেকে কৃষকদের সুরক্ষিত রাখার কর্মসূচি নেওয়া হবে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানো হবে। ডিজিটাল প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতি সচল, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের প্রসার, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি এবং নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ও জনশক্তি রপ্তানির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে।

শিল্প খাত: শিল্প খাতের বিকাশে বিনিয়োগ বান্ধব নীতি গ্রহণ করে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা হবে। যেসব বিনিয়োগে বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, সেই ধরনের প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। বিনিয়োগ সহজ করতে, কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন থেকে শুরু করে ব্যাংকিং সাপোর্ট নিশ্চিতের লক্ষ্যে ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ বাস্তবায়ন করা হবে। নতুন শিল্প সৃষ্টির জন্য কৃষি, মৎস্য ও অন্যান্য উৎপাদনমুখী খাতকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। পাটকল, বস্ত্রকল, চিনিকলসহ আওয়ামী দুঃশাসনে বন্ধ হয়ে যাওয়া মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পসমূহের তালিকা প্রস্তুত করে সেগুলো পুনরায় চালুর দৃশ্যমান উদ্যোগ নেওয়া হবে।

তথ্যপ্রযুক্তি খাত: ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উন্নয়নের জন্য দেশব্যাপী প্রোডাকশন ফেসিলিটি, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং ট্রেনিং প্রোগ্রাম হাতে নেয়া হবে। তারা আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে সরবরাহকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে পণ্য বিশ্বব্যাপী বিক্রি করতে সক্ষম হবেন। বাংলাদেশে ফেসবুক, গুগল, ইউটিউব, ইত্যাদি সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মের অফিস খোলার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। ফ্রিল্যান্সার তরুণ-যুবকদের সুবিধার্থে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাংলাদেশে পেপাল এবং অন্যান্য পেমেন্ট মেথডসহ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম শুরু করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। ফ্রিল্যান্সিং, আউটসোর্সিং এবং ডাটা প্রসেসিংকে উৎসাহিত করার জন্য জেলা পর্যায়ে যোগ্যতাভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন কার্যক্রম নেয়া হবে।

প্রবাসী কল্যাণ: প্রবাসী শ্রমিকদের জীবন, মর্যাদা ও কর্মের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। বিমানবন্দরসহ সব ক্ষেত্রে হয়রানিমুক্ত সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা হবে। প্রবাসী বাংলাদেশীদের বিনিয়োগে উৎসাহ, সুযোগ ও প্রণোদনা দেওয়া হবে। সেই লক্ষ্যে বিদেশের বাংলাদেশী দূতাবাসগুলোকে গতিশীল করা হবে। প্রবাসীদের জন্য বিশেষ ‘ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ফেয়ার’ আয়োজনের মাধ্যমে প্রবাসীদের কাছে বিনিয়োগ নীতিমালা, বিশেষ সুবিধাসমূহ ও ইকোনমিক ক্লাইমেট তুলে ধরা হবে। যেসব দেশে বাংলাদেশ থেকে নিয়মিত জনশক্তি রপ্তানি হয় সেসব দেশের কর্মসংস্থান চাহিদা বিশ্লেষণ করে স্কিল এবং ক্যাপাবিলিটির প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে ভোকেশনাল ও টেকনিক্যাল শিক্ষাকার্যক্রম চালু করে দক্ষ জনশক্তি বিদেশে রপ্তানির জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।

নগর ব্যবস্থাপনা: নারীদের সার্বক্ষণিক নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করতে প্রাথমিকভাবে ঢাকার বিভিন্ন রুটে ‘শুধুমাত্র নারী যাত্রী’ বাস চালু করা হবে। পরীক্ষামূলকভাবে সেখানে ড্রাইভার ও সহকারী হিসেবেও নারীরা থাকবেন। ট্রাফিক সমস্যার সমাধানে দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিক কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। ট্রাফিক লাইটে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহারের পাশাপাশি ট্রাফিক আইনের কঠোর প্রয়োগ, জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি, লেইন-ভিত্তিক যানবাহন প্ল্যান ইত্যাদি উদ্ভাবনী সমাধান বাস্তবায়ন করা হবে। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা বৃদ্ধি করে নগরীতে ট্রাফিকজ্যাম কমানো হবে।

পরিবেশ ব্যবস্থাপনা: ৫ বছরে ২৫ থেকে ৩০ কোটি বৃক্ষ রোপনের কর্মসূচি ইতোমধ্যে ঘোষিত হয়েছে। তৃনমূল থেকে শুরু করে রাজধানী পর্যন্ত ব্যাপকভাবে বৃক্ষ রোপন কর্মসূচি ও বৃক্ষমেলা আয়োজন করা হবে। দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন এবং মহানগরের প্রতিটি থানায় উন্মুক্ত মাঠের সংখ্যা বাড়িয়ে স্থানীয় পর্যায়ে প্রাকৃতিক পরিবেশের সুরক্ষা ও উন্নতি নিশ্চিত করতে গাছপালা রোপণ, সবুজ বেষ্টনী তৈরি এবং পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একটি ‘গ্রিন এন্ড ক্লিন’ বাংলাদেশ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হবে। পলিথিন নিষিদ্ধ করে পাটজাত ব্যাগকে উৎসাহিত করা হবে। সকল ‘ইকো-ফ্রেন্ডলি’ ও ‘সাস্টেইনেবল প্রোডাক্ট’কে উৎসাহিত করা হবে।

আইন-শৃঙ্খলা: ধর্ষণ, ছিনতাই, রাহাজানি, চুরিসহ সব নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের মাধ্যমে কঠোর অবস্থান নেওয়া হবে। যেকোনো মূল্যে বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান ঘটিয়ে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হবে। মাঠপর্যায়ে পুলিশের মনোবল বৃদ্ধির জন্য ট্রেনিং, কনসালটেশন, মোটিভেশন এবং মনিটরিংসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে পুলিশ সদস্যদের পেশাদারিত্ব, দক্ষতা এবং সেবামূলক মনোভাব বৃদ্ধি করা হবে। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।

কর্মসংস্থানমুখী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার
বিএনপির প্রধান অঙ্গীকার, কর্মসংস্থান সৃষ্টি। সরকার গঠন করলে এক কোটি মানুষের জন্য নতুন কর্মের সংস্থান করবে।

বিএনপির অতীতে সাফল্যের উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব থাকাকালীন উন্নয়ন নীতির একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল, শ্রমঘন শিল্প স্থাপন করা। পাশাপাশি উদ্বৃত্ত শ্রমকে বিদেশে রপ্তানির উদ্যোগ নেওয়া। এতে করে নতুন নতুন মানুষের কর্মের সংস্থান হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, জনমানুষ এক শ্রমবাজার থেকে আরেক শ্রমবাজারে প্রবেশও করেছে। যেমন পোশাকশিল্পের বিকাশের কারণে কৃষিনির্ভর গ্রামীণ শ্রমবাজার থেকে মানুষজন পোশাক কারখানার শহরের দিকে যেতে শুরু করে। সাধারণ মানুষের আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি শহুরে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ শুরু হয়। এর সরাসরি প্রভাব আমাদের অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিতে লক্ষ করা যায়।

সার্বিকভাবে ১৯৭৮ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ছিল ২ থেকে ৩ শতাংশ। ১৯৯১-১৯৯৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪-৫ শতাংশে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে ৬-৭ শতাংশ ছিল।

সার্বিক উন্নয়ন ও নতুন কর্মসংস্থানের জন্য বিএনপি এবার দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৮ শতাংশ। মূলত ১০টি খাতকে সার্বিক উন্নয়ন তথা কর্মসংস্থানের জন্য বিএনপি পরিকল্পনা তৈরি করেছে। এগুলো হচ্ছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ম্যানুফ্যাকচারিং, কৃষি, বিদেশে শ্রম রপ্তানি, আইসিটি ও ফ্রিল্যান্সিং, সেবা খাত, সবুজ জ্বালানি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং অন্যান্য।

বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিতকরণ
বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে বিএনপি সরকার বহুমুখী কৌশল গ্রহণ করবে। এই কৌশল কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে। বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করবে। উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করবে। নিম্নের ক্ষেত্রগুলোতে মনোনিবেশ প্রদান করবে।

নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামো সহজীকরণ ও আমলাতান্ত্রিক বাধা কমানো: ব্যবসায় নিবন্ধন, কর আনুগত্য এবং লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া সহজ করবে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কোম্পানি নিবন্ধন ও ট্রেড লাইসেন্সিং চালু করা হবে। এসব পদক্ষেপ উদ্যোক্তাদের সময় ও খরচ কমাবে। এটি ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ এবং নারী নেতৃত্বাধীন ব্যবসার জন্য বিশেষভাবে উপকারী।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ এবং স্টার্টআপগুলোর জন্য অর্থায়নের সুযোগ বৃদ্ধি: বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ সুবিধা প্রসারিত করা হবে। ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম চালু করা হবে। ঋণদাতাদের ঝুঁকি কমাবে। অতিরিক্ত জামানত ছাড়াই ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলোর ঋণ পাওয়া সহজ হবে। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল এবং ক্রাউডফান্ডিংয়ের মতো বিকল্প অর্থায়ন পদ্ধতিকে উৎসাহিত করা হবে। স্টার্টআপ এবং উচ্চ-প্রবৃদ্ধি সম্পন্ন ফার্মগুলোকে সাহায্য করবে।

অবকাঠামো ও শিল্প অঞ্চলে বিনিয়োগ: পরিবহন নেটওয়ার্ক এবং জ্বালানি সরবরাহসহ দক্ষ অবকাঠামো গড়ে তোলা শিল্প বিকাশের জন্য অত্যাবশ্যক। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) এবং শিল্প পার্ক স্থাপন ও সম্প্রসারণ করবে। ফলে বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে। উৎপাদনশীলতা বাড়বে। স্থানীয় শিল্পকে বৈশ্বিক মূল্য শৃঙ্খলায় সংযুক্ত হবে।

বহুমুখীকরণ, উৎপাদনশীলতা ও উদ্ভাবন: পোশাক শিল্প রপ্তানিতে প্রধান ভূমিকা রাখলেও রপ্তানি বৈচিত্র্য আনা প্রয়োজন। ওষুধ, তথ্যপ্রযুক্তি এবং কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে মনোযোগ দেওয়া হবে। এতে অর্থনৈতিক ঝুঁকি কমবে। উন্নত প্রযুক্তি গ্রহণে সহায়তা করা হবে। গবেষণা ও উন্নয়নকে উৎসাহিত করা হবে। উদ্ভাবন, উৎপাদনশীলতা এবং প্রতিযোগিতাসক্ষমতা বৃদ্ধিতে জোড় দেওয়া হবে।

আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা শক্তিশালীকরণ: আর্থিক খাতে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য সাহসী সংস্কার বাস্তবায়ন জরুরি। ব্যাংকিং খাতের সুশাসন উন্নত করা হবে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ানো হবে। অর্থায়নের জন্য পুঁজিবাজারের বিকশিত করা হবে।

ব্যাংকিং খাতকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের জন্য সহজীকরণ: ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য ঋণ প্রক্রিয়া সহজ করা জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম বাড়ানোর মাধ্যমে ছোট ব্যবসার জন্য জামানতের উপর নির্ভরতা কমানো হবে। নগদ প্রবাহভিত্তিক ঋণকে গুরুত্ব দিয়ে সম্পদভিত্তিক ঋণের পরিবর্তে ব্যবসার পারফরম্যান্স এবং ডিজিটাল লেনদেনের ইতিহাস দেখে ঋণ দেওয়া হবে। বিশেষ করে খুচরা ও পরিষেবা খাতে এটি কার্যকর হবে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ব্যাংকিংয়ের জন্য আলাদা বিভাগ খুলতে উৎসাহিত করা হবে। ক্ষুদ্র ব্যবসার হয়রানি বন্ধ করতে ঋণ শ্রেণিকরণ ও আদায় পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। একই সাথে ব্যাংকের স্বার্থও রক্ষা করতে হবে। গ্রামীণ উদ্যোক্তা এবং নারী পরিচালিত উদ্যোগগুলোতে পৌঁছাতে এজেন্ট ব্যাংকিং ও মোবাইল ব্যাংকিং সেবা বাড়ানো হবে। কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, হালকা প্রকৌশল, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং নারী উদ্যোক্তাদের মতো উৎপাদনশীল বেসরকারি খাতে বাধ্যতামূলক ঋণ কোটা চালু করা হবে।

পুঁজিবাজার উন্নতির জন্য পদক্ষেপ: তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে কঠোর স্বছতার নিয়ম এবং স্বাধীন নিরীক্ষা নিশ্চিত করা হবে। বিনিয়োগকারীর ভিত্তি সম্প্রসারণের জন্য বিনিয়োগ শিক্ষা প্রচার, লেনদেন খরচ কমানো এবং হিসাব খোলা সহজ করা হবে। ডিজিটাল ট্রেডিং প্ল্যাটফর্মগুলোকে আধুনিকীকরণ, অনলাইন আইপিও সাবস্ক্রিপশন ব্যবস্থাকে এর সঙ্গে যুক্ত করা এবং দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ফিনটেক প্রযুক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। কর্পোরেট বন্ডের জন্য একটি তারল্য বাজার তৈরি করতে পেনশন তহবিল, বিমা কোম্পানি এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা হবে।

আর্থিক পণ্যের বহুমুখীকরণ: আর্থিক পণ্যের বহুমুখীকরণে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এর মধ্যে রয়েছে; লিজ ও ফ্যাক্টরিংয়ের প্রসার ঘটানো, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ও অ্যাঞ্জেল বিনিয়োগের জন্য আইনি ও আর্থিক কাঠামো তৈরি, প্রাইভেট ইক্যুইটি তহবিল সহায়তা, ইসলামিক আর্থিক পণ্য যেমন মুদারাবা ও ইজারা বিকল্পগুলো বাড়ানো, সবুজ বন্ড এবং ব্লেন্ডেড ফাইন্যান্স উপকরণ চালু, মোবাইল অপারেটর এবং ফিনটেক প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে ডিজিটাল ঋণ প্রদান ইত্যাদি।

জ্বালানি ও বিদ্যুৎ কৌশল প্রণয়ন: প্রাকৃতিক গ্যাস, সৌর, জলবিদ্যুৎ ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে বাংলাদেশের আদর্শ মিশ্রণ নির্ধারণ ও সিস্টেম-ভিত্তিক পরিকল্পনা করতে একটি টাস্কফোর্স গঠন করবে। এই পরিকল্পনা কাঠামো হবে তথ্য-ভিত্তিক, আয়-ব্যয়-মডেলিং সমৃদ্ধ এবং জলবায়ু লক্ষ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। চুক্তি এবং ব্যয়-সুবিধা বিশ্লেষণ জনসাধারণের কাছে প্রকাশে সচেষ্ট থাকবে। এটি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনবে এবং সর্বসাধারণের কাছে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে। নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে ট্রান্সমিশন আধুনিকীকরণ ও ডিজিটাইজেশনে অধিক বরাদ্দ দেওয়া হবে। গ্রিড স্থিতিস্থাপকতা, স্মার্ট মিটারিং এবং আঞ্চলিক আন্তঃসংযোগকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। বাপেক্সকে শক্তিশালী করে গ্যাস, খনিজ অনুসন্ধানে গুরুত্ব দেয়া হবে। নবায়নযোগ্য ও সাশ্রয় প্রযুক্তিতে বিনিয়োগকারীদের জন্য কর প্রণোদনা দেওয়া হবে।

নীল অর্থনীতি: বঙ্গোপসাগরের বিশাল সামুদ্রিক সম্পদকে টেকসইভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং জলবায়ু সহনশীলতা অর্জনের লক্ষ্যে টেকসই সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা, সমুদ্রভিত্তিক শিল্প ও প্রযুক্তির উন্নয়ন, জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও সামুদ্রিক পরিবেশ সংরক্ষণ, উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন গবেষণা এবং উদ্ভাবন ও মানবসম্পদ উন্নয়নে জোর দেওয়া হবে।

প্রধান খাতসমূহ: মৎস্য ও সামুদ্রিক খাদ্য, নৌপরিবহন ও বন্দর, অফশোর গ্যাস ও খনিজ সম্পদ, নবায়নযোগ্য শক্তি (সমুদ্র-বায়ু ও জোয়ার শক্তি), সমুদ্র পর্যটন ও বিনোদন এবং সমুদ্র গবেষণা ও প্রযুক্তি। কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য সমন্বিত “ম্যারিটাইম জোন” ব্যবস্থাপনা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও আঞ্চলিক অংশীদারিত্ব এবং দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা এবং দক্ষতা উন্নয়ন ইত্যাদি উদ্যোগ নেওয়া হবে। সমুদ্র ও উপকূলীয় অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক লাভ নিশ্চিত করতে সামুদ্রিক সম্পদের বিজ্ঞানসম্মত জরিপ, মানচিত্রায়ন এবং সম্পদের প্রকৃত মজুত নির্ধারণ করা হবে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই পদ্ধতিতে সম্পদ আহরণ ও অর্থনৈতিক ব্যবহারের পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে।

সৃজনশীল শিল্প অর্থনীতি: বাংলাদেশের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আছে। বৃহৎ তরুণ জনগোষ্ঠী রয়েছে। ডিজিটাল অবকাঠামোও বাড়ছে। কিন্তু সৃজনশীল অর্থনীতি জিডিপিতে ০.৫ শতাংশেরও কম অবদান। উদীয়মান অর্থনীতিগুলোতে এই খাত ৩-৫ শতাংশ অবদান রাখে।

এই খাতের মধ্যে রয়েছে: চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন নির্মাণ, সঙ্গীত ও মঞ্চ শিল্পকলা, অ্যানিমেশন, ভিএফএক্স ও গেমিং, মেকআপ, পোশাক এবং নকশা, ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য বিষয়বস্তু তৈরি, সিজিআই এবং ক্রিয়েটিভ মিডিয়া সেবাদাতা সফটওয়্যার কোম্পানি, ইউটিউব, টিকটক এবং ইনফ্লুয়েন্সার অর্থনীতি ইত্যাদি।

বাণিজ্য সহজীকরণ ও শুল্ক পদ্ধতি উন্নয়ন: শুল্ক পদ্ধতি সহজ হলে এবং বাণিজ্য বাধা কমলে রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াবে। শুল্ক শ্রেণিবিন্যাস ডিজিটাইজ করা হবে। আমদানি প্রক্রিয়া, বিশেষ করে মূল কাঁচামালের জন্য ক্লিয়ারেন্স দ্রুততর করবে। ব্যবসায়ীদের খরচ কমাবে।

ডিজিটাল আর্থিক সেবার ব্যবহার বৃদ্ধি: ডিজিটাল আর্থিক সেবার প্রসার অর্থায়নের সুযোগ বাড়াবে। এটি বিশেষত সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চ লেনদেনসীমাসহ মার্চেন্ট ওয়ালেটের জন্য মোবাইল আর্থিক সেবা সক্রিয় করতে প্রোটোকল স্থাপন করা হবে। এটি পাইকারি লেনদেন সহজ করবে। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের জন্য ডিজিটাল পেমেন্টও সহজলভ্য করবে।

কর্পোরেট গভর্ন্যান্স ও সামাজিক দায়বদ্ধতা উন্নতকরণ: শক্তিশালী কর্পোরেট গভর্ন্যান্স ও কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা অনুশীলনে জোড় দেওয়া হবে। ফলে বেসরকারি খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়াবে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের কার্যক্রম টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করতে উৎসাহিত করা হবে। ফলে সমন্বিত প্রবৃদ্ধি এবং পরিবেশগত স্থিতিশীলতা এগুবে।

পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) শক্তিশালীকরণ: কার্যকর পিপিপি নীতি তৈরি ও বাস্তবায়ন জরুরি। অবকাঠামো ও সরকারি সেবায় বেসরকারি বিনিয়োগ জোগাড়ের উদ্যোগ নেয়া হবে। এই সহযোগিতামূলক পদ্ধতি সেবা প্রদান উন্নত করবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গতিশীল হবে।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও সবুজ প্রবৃদ্ধি: অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় জলবায়ু সহনশীলতা অন্তর্ভুক্ত করা টেকসই উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশ ক্লাইমেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট প্ল্যাটফর্ম (বিসিডিপি) এর মতো প্ল্যাটফর্ম স্থাপন করা হবে। জলবায়ু অভিযোজন ও প্রশমন প্রকল্পে বিনিয়োগ আকর্ষণের প্রচেষ্টা নেয়া হবে। সরকারি ও বেসরকারি খাত একত্রে কাজ করবে।

ঋণ ব্যবস্থাপনা ও রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি
রাজস্ব চাপ, মুদ্রানীতি কঠোরীকরণ এবং আর্থিক ভঙ্গুরতার কারণে সামস্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় উল্লেখযোগ্য ঝুঁকি বিদ্যমান। দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার স্বার্থে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাজস্ব কৌশল প্রণয়ন, কাঠামোগত সংস্কার এবং প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক, সমতা-ভিত্তিক টেকসই উন্নয়নের পথে গ্রহণ করা হবে। বিএনপি ঋণের বোঝা কমাতে ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ বৃদ্ধির কৌশলও নির্ধারণ করেছে। সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো—

ঋণ ব্যবস্থাপনা কৌশল: সরকারি ঋণের গঠনগত উন্নয়ন ও ঋণ সংগ্রহের ব্যয় হ্রাস বিষয়ক ‘মধ্যমেয়াদি ঋণ ব্যবস্থাপনা কৌশল (এমটিডিএস)’ প্রণয়ন করবে। সুদ পরিশোধের বোঝা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে রোলওভার ঝুঁকি কমাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণের ওপর নির্ভরতা হ্রাস করবে। রাজস্ব ও মুদ্রানীতির মধ্যে সমন্বয় বাড়িয়ে সরকারি ঋণ সংগ্রহকে অনুকূলিত করে ব্যক্তিখাতের ঋণ প্রবাহ সংকোচন বন্ধ করবে।

ব্যয় অগ্রাধিকরণ ও দক্ষতাবৃদ্ধির কৌশল: অভ্যন্তরীণ সুদ পরিশোধ ও পরিচালন ব্যয় নিয়ন্ত্রণে ঋণ ব্যবস্থাপনা ও ভর্তুকি যুক্তিসঙ্গতকরণ করা হবে। এক্ষেত্রে সরকারি ব্যয় পর্যালোচনা কাঠামো গঠন, নতুন প্রকল্পের জন্য কঠোর ব্যয়-লাভ বিশ্লেষণ নির্দেশিকা এবং কর্মক্ষমতা-ভিত্তিক বাজেটিং পদ্ধতি প্রণয়ন করা হবে।

স্বল্পমেয়াদী ঋণের উপর নির্ভরতা হ্রাস: স্বল্পমেয়াদি ঋণের ওপর নির্ভরতা হ্রাস করে সরকারের দায়ের পরিমাণ কমানো হবে। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারি খাতের ঋণগ্রহণের হার কমিয়ে ব্যক্তিখাতের ঋণ প্রবাহ বাড়িয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি সঞ্চার করা হবে।

ঋণ-উন্নয়ন-বিনিময় কৌশল: ঋণদাতা সংস্থাগুলোর সাথে আলোচনা করে বৈদেশিক ঋণকে স্থানীয় বিনিয়োগে রূপান্তর করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। রূপান্তরিত অর্থ জলবায়ু পরিবর্তন জনিত অভিযোজন বৃদ্ধি, শিক্ষা অবকাঠামো শক্তিশালীকরণ এবং স্বাস্থ্য কাঠামো তৈরির মত জনহিতকর কাজে ব্যবহার করা হবে। এতে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের ফলে সৃষ্ট বৈদেশিক সাহায্যের হ্রাসজনিত ফারাকও কমাবে। একদিকে বৈদেশিক ঋণের বোঝা কমবে, অন্যদিকে সম্পদ সরাসরি টেকসই ও সমতাভিত্তিক প্রবৃদ্ধি তৈরির চালিকাশক্তিতে নিয়োজিত হবে।

অবৈধ ঋণ পর্যালোচনা ও বাতিলকরণ প্রক্রিয়া: স্বৈরতান্ত্রিক শাসনকালে গৃহীত সব ঋণ পর্যালোচনা ও বাতিলকরণ প্রক্রিয়ার জন্য জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের অনুরোধ জানানো হবে।

রাজস্ব ব্যবস্থার যুগোপযোগীকরণ: এনবিআরকে একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হবে। নীতি প্রণয়নের কাজ করতে বর্তমানের শুল্ক ও বাণিজ্য কমিশনকে আওতাভুক্ত করে ‘বাংলাদেশ কর ও শুল্ক কমিশন’ নামে একটি পৃথক প্রতিষ্ঠান গড়া হবে।

কর কোড আধুনিকায়ন: প্রত্যক্ষ করকে অগ্রাধিকার দিয়ে ‘কর কোড’ আধুনিকায়ন করা হবে। সহজীকরণ এবং ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি উপজেলা পর্যায়ে অফিস স্থাপন করে করের আওতা বাড়ানো হবে।

প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি ব্যবস্থা: প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি ব্যবস্থা তথা বিদ্যুৎ বিল, ব্যাংক লেনদেন, ভূমি রেকর্ড ইত্যাদি একীভূত করে কর সনাক্তকরণ ড্যাশবোর্ড চালু, বন্ডেড গুদামের জন্য ব্লকচেইন-ভিত্তিক ট্র্যাকিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত ঝুঁকি মূল্যায়ন জালিয়াতি রোধে সহায়ক হবে।

সবুজ কর কাঠামো: উচ্চ কার্বন নিঃসরণকারী শিল্পের উপর কার্বন কর আরোপ করা হবে। উক্ত রাজস্ব জলবায়ু অভিযোজন তহবিলে যাবে।

কার্যকর ট্রান্সফার প্রাইসিং আইন: বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মাস্টার ও স্থানীয় নথি জমা এবং দেশওয়ারি রিপোর্টিং বাধ্যতামূলক করা হবে। মুনাফা স্থানান্তরের ওপর কঠোর জরিমানা আরোপ করা হবে।

বাজেট প্রক্রিয়ার সংস্কার
বাজেট অনুমোদনের জন্য প্রচলিত সাংবিধানিক পদ্ধতি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে। জবাবদিহিতা এবং বাংলাদেশে সংসদীয় তদারকি শক্তিশালী করার জন্য মৌলিক সাংবিধানিক ও পদ্ধতিগত সংস্কারও করা হবে। সংসদীয় কমিটিকে শক্তিশালী করা, স্বচ্ছতা এবং জনসাধারণের অংশগ্রহণ, নির্বাচনপূর্ব কেয়ারটেকার সরকারের জন্য পরিষ্কার নির্দেশিকাসহ বিস্তৃত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

প্রস্তাবিত বাজেট একমুখী ও গতানুগতিক: বিএনপি

আপডেট সময় : ০৫:০২:৩৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ৪ জুন ২০২৫

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) বাজেটবিষয়ক বক্তব্যে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী জানিয়েছেন, আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট একমুখী ও গতানুগতিক হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে বাজেট দেয়া উচিত ছিল বলেও মত দেন তিনি। আজ (বুধবার, ৪ জুন) দলের পক্ষে আমির খসরু লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। সেখানেই এ তথ্য জানানো হয়।

বিএনপির পক্ষ থেকে দেয়া বাজেটবিষয়ক বক্তব্য তুলে ধরা হলো—

২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর প্রথম বাজেট। একই সঙ্গে, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে একটি বড় নীতিনির্ধারণী উপলক্ষ। পতিত স্বৈরাচারি সরকার অর্থনীতিকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে রেখে গেছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম অঙ্গীকার ছিল ন্যায্য ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থা। জনগণের জীবনযাত্রার অগ্রাধিকার। এ কারণেই ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক পরিকল্পনা। এটি রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকেও গভীর তাৎপর্য বহন করে।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯১ সালের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন ও জুলাই অভ্যুত্থান গণতন্ত্রের সংগ্রাম। বার্ষিক বাজেট গণতন্ত্রের একটি মৌলিক স্তম্ভ। বাজেট রাজনৈতিক সরকারের জনগণ থেকে প্রাপ্ত ম্যান্ডেট ও অগ্রাধিকার প্রতিফলিত করার কৌশল ও বাস্তবায়ন কাঠামোর আর্থিক প্রতিবেদন। প্রতিটি দফা যাচাই-বাছাই ও কাটছাঁট করে অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ জনগণের মৌলিক অধিকারের আইনি কাঠামো প্রদান করেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ‘ম্যাগনা কার্টা’ কর আরোপের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকে সীমিত করেছিল। যুক্তরাজ্যে ‘গৌরবময় বিপ্লব’ কর ও ব্যয়ের উপর সংসদের কর্তৃত্বকে সুদৃঢ় করেছিল। ‘প্রতিনিধিত্ব ছাড়া কর আরোপ নয়’- এই স্লোগান আমেরিকান বিপ্লবের ভিত্তি।

আমরা এক যুগান্তকারী নজির তৈরি করতে পারতাম। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল সর্বক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহযোগিতা করছে। আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আন্দোলনকারী রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করে ন্যূনতম জাতীয় ঐকমত্য স্থাপনের মাধ্যমে বাজেট প্রণয়ন করবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চাইলে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামত নিতে পারত। বিশেষজ্ঞ, নাগরিক সমাজ, ব্যবসায়ী ও তরুণ প্রতিনিধিরাও অংশ করতে পারতেন। তাহলে বাজেট একটি সমন্বিত অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতীক হতো। দেশের বিভিন্ন কণ্ঠের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠত এই বাজেট। কিন্তু সে সুযোগটি কাজে লাগানো হয়নি। বাজেট প্রণয়ন একমুখী, অংশগ্রহণহীন ও গতানুগতিক ধারার হত না। নতুন চিন্তার প্রতিফলন ঘটত।

বর্তমানের বিশেষ পরিস্থিতিতে এই সংলাপ আরো জরুরি ছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলছে, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করবে। অর্থাৎ ২০২৫-২৬ বাজেটীয় বছরে নির্বাচিত সরকার আসবে। ওয়েস্টমিনিস্টার ঐতিহ্য অনুসরণকারী অনেক দেশেই ‘অন্তর্বর্তীকালীন শাসন সংক্রান্ত রীতিনীতি’ আছে, যা বাংলাদেশে নাই। সাধারণ নির্বাচন আসন্ন হলে বা নতুন সরকারের সম্ভাবনা থাকলে বাজেট অনুমোদনের ভিন্ন পন্থা থাকে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নীতি-কাঠামোর বড় ধরনের পরিবর্তন করে না। উল্লেখযোগ্য কর সমন্বয় বা নতুন, বৃহৎ আকারের আর্থিক প্রতিশ্রুতিও দেয় না।

রাজনৈতিক সংলাপ হলে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে ব্যয় বরাদ্দে বাস্তবসম্মত পুনর্বিন্যাস হত। স্বৈরাচারি সরকারের সীমাহীন জনবান্ধবহীন নীতি-কাঠামো উদ্ভূত দীর্ঘমেয়াদী উচ্চ মূল্যস্ফীতিজনিত সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যয় নির্বাহের সংকট থেকে মুক্তির দিকনির্দেশনা থাকত। দারিদ্র বৃদ্ধির হারে লাগাম টানা যেত। মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির নিচে থাকায় প্রকৃত আয় কমেছে। দারিদ্র্য বৃদ্ধির পাশাপাশি ভোক্তা ব্যয়ের উপরও চাপ সৃষ্টি করেছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ স্থবির হওয়ায় আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক প্রায় সব খাতেই কর্মসংস্থান কমেছে। ফলে সমাজে ভাঙন ধরেছে; দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে। কৃষি উৎপাদন প্রবৃদ্ধি গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে। অপর্যাপ্ত, ত্রুটিপূর্ণ, দুর্নীতিগ্রস্ত সামাজিক সুরক্ষা খাতে পেনশন ও কৃষি ভর্তুকি অন্তর্ভুক্ত করে বরাদ্দ বাড়ানোর চেষ্টা হিসেবে দেখানো হলেও সামাজিক সুরক্ষার জন্য সরকারি বরাদ্দ অপর্যাপ্ত থেকে যাচ্ছে। আজ অবধি সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচিগুলো অধিকারভিত্তিক হল না।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ কমানো উদ্বেগজনক। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, কলেজ ও স্কুলগুলোকে পূর্ণাঙ্গ কর মওকুফের আওতায় আনা যেত। এতে তরুণ সমাজের শিক্ষা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ হত। সামাজিক সমতা ও মেধাভিত্তিক সমাজ নির্মাণে সহায়ক হত। শিক্ষার দুর্বল ফলাফল ও তরুণদের মধ্যে উচ্চশিক্ষা, কর্মসংস্থান বা প্রশিক্ষণ না থাকার বিশাল হার ডেমগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক লভ্যাংশ অর্জনের পথে প্রতিবন্ধক। এসব খাতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ না হলে মানবসম্পদ উন্নয়ন ও দারিদ্র্য হ্রাসে অগ্রগতি সম্ভব নয়। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন দুরূহ হয়ে যাচ্ছে।

অর্থনৈতিক কাঠামোর দুর্বলতাগুলোর সমাধানে সুস্পষ্ট রূপরেখার প্রয়োজন ছিল। প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল, বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির পথ-নকশা উপস্থাপন। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে শিল্প কারখানা স্থাপন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষিতে অগ্রাধিকার দেওয়ার দরকার ছিল। জরুরি ছিল ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি বিভিন্ন খাতে সহায়তার মাধ্যমে আরো নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির। বিশাল সুদের হারের সাথে অতিরিক্ত কর ও শুল্ক শিল্পে বড় চাপ সৃষ্টি করবে। বিশেষ করে, উৎপাদনশীল খাতগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কর্মসংস্থানও কমতে পারে। মধ্যম ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির উপর আর্থিক চাপ বাড়লে অর্থনৈতিক অস্থিরতা বাড়তে পারে। দারিদ্র্য বিমোচনের অগ্রগতিও থমকে যেতে পারে।

ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় কমানো, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা হ্রাস এবং ‘কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস’ কমানোরও কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকায় উদ্যোক্তারা অনিশ্চিত ও প্রতিকূল পরিবেশের মুখোমুখি হবেন।

অনলাইন ব্যবসার ওপর শুল্ক বাড়ানোয় ডিজিটাল উদ্যোক্তারা চাপে পড়বেন। এই খাত নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও ডিজিটাল রূপান্তরে বড় ভূমিকা রাখতে পারত। তরুণ উদ্যোক্তাদের হতাশা বাড়বে। উদ্ভাবনও নিরুৎসাহিত হবে।

আর্থিক খাতের ভঙ্গুরতাও কাটেনি। পুঁজিবাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীগণ অবহেলিতই থেকে গেলেন। ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা নাজুক। খেলাপি ঋণ আদায়, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা এবং করজাল সম্প্রসারণের মত পদক্ষেপ নিলে রাজস্ব আহরণে নতুন ভিত্তি তৈরি হত। সরকার ব্যাংক খাতের উপর বেশি নির্ভরশীল। ‘ঋণ করে ঋণ শোধ’ দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ কর ফাঁকি প্রদানকারীদের পুরস্কৃত করছে। নিয়মিত করদাতাদের প্রতি এটি অবিচার। করব্যবস্থার প্রতি আস্থা কমতে পারে। আয়কর স্লাবে কর হারের পরিবর্তন অধিকাংশ করদাতাদের উপর আরও অভিঘাত ফেলবে। কর ফাঁকি ও জালিয়াতি রোধ এবং করজাল সম্প্রসারণ না করে ভ্যাট বৃদ্ধির মাধ্যমে বরাবরের মত করের বোঝা সাধারণ জনগণের কাঁধে চাপানো হয়েছে। পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। জীবনযাত্রার মান কমছে।

অপ্রয়োজনীয়, দুর্নীতিগ্রস্ত ও অদক্ষ উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বন্ধ বা সংস্কারের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। এসব প্রকল্পের অর্থনৈতিক ফলাফল পর্যালোচনা করা জরুরি। প্রয়োজনে রিভিউ বা রিনেগোসিয়েট করা যেতে পারে। এতে ব্যয় কমিয়ে জনকল্যাণে বরাদ্দ বাড়ানো সম্ভব হবে।

বিএনপির ১৮০ দিনের পরিকল্পনা

অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা, মানুষের আস্থা অর্জন এবং ভবিষ্যতের জন্য দৃঢ় ভিত্তি গড়তে প্রয়োজন স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও উদ্ভাবনী অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। গতানুগতিকতা ছেড়ে সাহসী ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে। তাহলেই জাতির জন্য আশা, আস্থা ও পুনর্গঠনের দিগন্ত উন্মোচন হবে।

বিশ্বের অনেক দেশে রাজনৈতিক দল নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম ১০০ দিনে কী কী কাজ করবে, তার পরিকল্পনা প্রকাশ করে থাকে। জনগণের ক্ষমতায়নের দল হিসেবে বিএনপি বাংলাদেশে এমন একটি বাস্তবসম্মত সংস্কৃতি প্রবর্তন করতে চায়।

জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠনের পর প্রথম ১৮০ দিনের মধ্যে আমাদের লক্ষ্য ও পরিকল্পনা নির্বাচনের আগেই নির্ধারণ করা হবে।

এই ৬ মাসের পরিকল্পনার ভিত্তিতে একটি অ্যাকশন-ওরিয়েন্টেড রোডম্যাপ প্রণয়ন করা হবে। বিভিন্ন সেক্টরে বিএনপি কী-কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, আমরা সেগুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরব। এখানে সার-সংক্ষেপ দেওয়া হল—

শিক্ষা ব্যবস্থা: প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের অর্থনৈতিক সুবিধা ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করা এবং তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আওতায় আনা হবে।

দেশের ও প্রবাসী শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হবে। মূল লক্ষ্য হবে – প্রাথমিক পর্যায় থেকে বহু ভাষা, ক্রীড়া, কৃষ্টি এবং ব্যক্তিগত ও পেশাগত উন্নয়নসহ বাস্তবানুগ বিষয়সমূহ শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা।

সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্লাম্বিং, ইলেকট্রিশিয়ান, মেকানিক্স, ডেন্টাল হাইজেনিস্ট, মেডিক্যাল টেকনিশিয়ান ইত্যাদির স্বল্পমেয়াদি ‘ট্রেড কোর্স’ চালু করা হবে।

শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাস্তবমুখী করতে এপ্রেন্টিসশিপ, ইন্টার্নশিপ এবং ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। প্রাথমিকভাবে বিভাগীয় শহরগুলোতে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে স্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক স্থাপন করে এই কার্যক্রম শুরু করা হবে। ফলে শিক্ষার্থীগণ হাতে কলমে শিক্ষা লাভ করবে এবং কর্মজীবনে ব্যপক হারে প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি করবে।

জেলা পর্যায়ে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনোভেটিভ বিজনেস আইডিয়া বাণিজ্যিকিকরণ করতে প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়ায় সিড ফান্ডিং বা ইনোভেশন গ্র্যান্ট প্রদান করা হবে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো, ক্যাম্পাস থেকে ব্যবসায়িক উদ্যোক্তা তৈরি করা। তারা নতুন এবং সৃজনশীল ব্যবসায়িক ধারণা বাস্তবায়ন করে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারবেন।

স্বাস্থ্য সেবা: রোগ প্রতিরোধকে প্রাধান্য দিয়ে টিকাদান, স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং সচেতনতা তৈরির একাধিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, স্যানিটেশন এবং পুষ্টির উপর জনগণের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করা হবে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য স্পেশালাইজড ট্রেনিং স্কিম শুরু করা হবে। তারা রোগের দ্রুত শনাক্তকরণ এবং প্রতিরোধে দক্ষ হয়ে উঠবেন। নিরাপদ পানি সরবরাহের জন্য আধুনিক পরিশোধন ব্যবস্থা ও বৃষ্টির পানি সংগ্রহের জন্য পর্যায়ক্রমে দেশব্যাপী রিসার্ভার তৈরি করা হবে। জনগণ নিরাপদ পানি পাবে।

নারীর ক্ষমতায়ন: প্রায় প্রান্তিক চার কোটি পরিবারের মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে ৫০ লাখ দরিদ্র গ্রামীণ পরিবারের জন্য ‘ফ্যামিলি কার্ড’ চালু করা হবে। এই কার্ড মূলত পরিবারের নারী প্রধানের নামে ইস্যু করা হবে। তাদের প্রতিমাসে রাষ্ট্রীয়ভাবে আর্থিক সহায়তা অথবা প্রয়োজনীয় খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হবে। এর মাধ্যমে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হবে এবং পরিবারগুলো ধীরে ধীরে স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে। নারীদের নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে। বিচারিক প্রক্রিয়ায় ধর্ষক-নিপীড়কদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। নারীদের জন্য ইউনিয়ন পর্যায়ে ডেডিকেটেড সাপোর্ট সেল প্রতিষ্ঠা করা হবে। সেখানে যেকোনো লাঞ্চিত নারীর জন্য প্রয়োজন মোতাবেক নারী ডাক্তার, আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী সর্বাঙ্গীন সহায়তা নিশ্চিত করবে। নারীদের স্বনির্ভরতা বাড়াতে ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্পে যোগ্যতার ভিত্তিতে স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা হবে। তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং ডেভেলপমেন্ট ও মার্কেটিং সাপোর্ট প্রদান করা হবে।

শহীদদের স্বীকৃতি: জুলাই গঅভ্যূত্থানে এবং ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে সব শহীদের তালিকা প্রস্তুত করে নিজ-নিজ এলাকায় তাদের নামে সরকারি স্থাপনার নামকরণ করা হবে। শহীদ পরিবারগুলোসমূহকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করা হবে। গণঅভ্যুত্থানে ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে যেসব গণতন্ত্রকামী ব্যক্তি পঙ্গু হয়েছেন, চোখ হারিয়েছেন তাদেরও স্বীকৃতি ও চাকরির সহায়তা প্রদান করা হবে।

কৃষি খাত ও গ্রামীণ উন্নয়ন: কৃষকের নামে জমির পরিমাণ ও খতিয়ানসহ প্রয়োজনীয় তথ্যসংবলিত ‘ফার্মার্স কার্ড’ চালু করা হবে। বর্গাচাষি ও ক্ষুদ্র কৃষকের জন্য কমপক্ষে একটি মৌসুমি ফসলের জন্য সম্পূর্ণ উৎপাদন খরচ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বহন করা হবে। এর ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং কৃষিজমি অনাবাদি থাকবে না। ভূমিহীনদের জন্যও কর্মসংস্থান তৈরি হবে। কৃষকের কাছ থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে রাষ্ট্র ন্যায্যমূল্যের ভিত্তিতে সরাসরি উৎপাদিত পণ্য ক্রয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করবে এবং দেশব্যাপী কোল্ড স্টোরেজ তৈরির কাজ শুরু হবে। কৃষিজাত পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ, মানোন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি করে কৃষি খাতকে রপ্তানিমুখীন গড়ে তোলা হবে। এলাকাভিত্তিক ডাটাবেস তৈরির করা হবে। কৃষকের জমির ও উৎপাদিত ফসলের পরিমানের তথ্য-উপাত্ত নির্ণয় করে টার্গেটেড পলিসি সাপোর্ট দেওয়া হবে। বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য চাঁদাবাজি, মধ্যস্বত্বভোগী ও ফ্যাসিবাদের রেখে যাওয়া সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। দেশব্যাপী খাল খননের কার্যক্রম ব্যাপকভাবে শুরু করা হবে। বন্যা ও খরা থেকে কৃষকদের সুরক্ষিত রাখার কর্মসূচি নেওয়া হবে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানো হবে। ডিজিটাল প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতি সচল, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের প্রসার, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি এবং নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ও জনশক্তি রপ্তানির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে।

শিল্প খাত: শিল্প খাতের বিকাশে বিনিয়োগ বান্ধব নীতি গ্রহণ করে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা হবে। যেসব বিনিয়োগে বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, সেই ধরনের প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। বিনিয়োগ সহজ করতে, কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন থেকে শুরু করে ব্যাংকিং সাপোর্ট নিশ্চিতের লক্ষ্যে ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ বাস্তবায়ন করা হবে। নতুন শিল্প সৃষ্টির জন্য কৃষি, মৎস্য ও অন্যান্য উৎপাদনমুখী খাতকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। পাটকল, বস্ত্রকল, চিনিকলসহ আওয়ামী দুঃশাসনে বন্ধ হয়ে যাওয়া মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পসমূহের তালিকা প্রস্তুত করে সেগুলো পুনরায় চালুর দৃশ্যমান উদ্যোগ নেওয়া হবে।

তথ্যপ্রযুক্তি খাত: ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উন্নয়নের জন্য দেশব্যাপী প্রোডাকশন ফেসিলিটি, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং ট্রেনিং প্রোগ্রাম হাতে নেয়া হবে। তারা আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে সরবরাহকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে পণ্য বিশ্বব্যাপী বিক্রি করতে সক্ষম হবেন। বাংলাদেশে ফেসবুক, গুগল, ইউটিউব, ইত্যাদি সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মের অফিস খোলার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। ফ্রিল্যান্সার তরুণ-যুবকদের সুবিধার্থে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাংলাদেশে পেপাল এবং অন্যান্য পেমেন্ট মেথডসহ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম শুরু করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। ফ্রিল্যান্সিং, আউটসোর্সিং এবং ডাটা প্রসেসিংকে উৎসাহিত করার জন্য জেলা পর্যায়ে যোগ্যতাভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন কার্যক্রম নেয়া হবে।

প্রবাসী কল্যাণ: প্রবাসী শ্রমিকদের জীবন, মর্যাদা ও কর্মের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। বিমানবন্দরসহ সব ক্ষেত্রে হয়রানিমুক্ত সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা হবে। প্রবাসী বাংলাদেশীদের বিনিয়োগে উৎসাহ, সুযোগ ও প্রণোদনা দেওয়া হবে। সেই লক্ষ্যে বিদেশের বাংলাদেশী দূতাবাসগুলোকে গতিশীল করা হবে। প্রবাসীদের জন্য বিশেষ ‘ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ফেয়ার’ আয়োজনের মাধ্যমে প্রবাসীদের কাছে বিনিয়োগ নীতিমালা, বিশেষ সুবিধাসমূহ ও ইকোনমিক ক্লাইমেট তুলে ধরা হবে। যেসব দেশে বাংলাদেশ থেকে নিয়মিত জনশক্তি রপ্তানি হয় সেসব দেশের কর্মসংস্থান চাহিদা বিশ্লেষণ করে স্কিল এবং ক্যাপাবিলিটির প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে ভোকেশনাল ও টেকনিক্যাল শিক্ষাকার্যক্রম চালু করে দক্ষ জনশক্তি বিদেশে রপ্তানির জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।

নগর ব্যবস্থাপনা: নারীদের সার্বক্ষণিক নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করতে প্রাথমিকভাবে ঢাকার বিভিন্ন রুটে ‘শুধুমাত্র নারী যাত্রী’ বাস চালু করা হবে। পরীক্ষামূলকভাবে সেখানে ড্রাইভার ও সহকারী হিসেবেও নারীরা থাকবেন। ট্রাফিক সমস্যার সমাধানে দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিক কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। ট্রাফিক লাইটে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহারের পাশাপাশি ট্রাফিক আইনের কঠোর প্রয়োগ, জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি, লেইন-ভিত্তিক যানবাহন প্ল্যান ইত্যাদি উদ্ভাবনী সমাধান বাস্তবায়ন করা হবে। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা বৃদ্ধি করে নগরীতে ট্রাফিকজ্যাম কমানো হবে।

পরিবেশ ব্যবস্থাপনা: ৫ বছরে ২৫ থেকে ৩০ কোটি বৃক্ষ রোপনের কর্মসূচি ইতোমধ্যে ঘোষিত হয়েছে। তৃনমূল থেকে শুরু করে রাজধানী পর্যন্ত ব্যাপকভাবে বৃক্ষ রোপন কর্মসূচি ও বৃক্ষমেলা আয়োজন করা হবে। দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন এবং মহানগরের প্রতিটি থানায় উন্মুক্ত মাঠের সংখ্যা বাড়িয়ে স্থানীয় পর্যায়ে প্রাকৃতিক পরিবেশের সুরক্ষা ও উন্নতি নিশ্চিত করতে গাছপালা রোপণ, সবুজ বেষ্টনী তৈরি এবং পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একটি ‘গ্রিন এন্ড ক্লিন’ বাংলাদেশ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হবে। পলিথিন নিষিদ্ধ করে পাটজাত ব্যাগকে উৎসাহিত করা হবে। সকল ‘ইকো-ফ্রেন্ডলি’ ও ‘সাস্টেইনেবল প্রোডাক্ট’কে উৎসাহিত করা হবে।

আইন-শৃঙ্খলা: ধর্ষণ, ছিনতাই, রাহাজানি, চুরিসহ সব নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের মাধ্যমে কঠোর অবস্থান নেওয়া হবে। যেকোনো মূল্যে বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান ঘটিয়ে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হবে। মাঠপর্যায়ে পুলিশের মনোবল বৃদ্ধির জন্য ট্রেনিং, কনসালটেশন, মোটিভেশন এবং মনিটরিংসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে পুলিশ সদস্যদের পেশাদারিত্ব, দক্ষতা এবং সেবামূলক মনোভাব বৃদ্ধি করা হবে। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।

কর্মসংস্থানমুখী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার
বিএনপির প্রধান অঙ্গীকার, কর্মসংস্থান সৃষ্টি। সরকার গঠন করলে এক কোটি মানুষের জন্য নতুন কর্মের সংস্থান করবে।

বিএনপির অতীতে সাফল্যের উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব থাকাকালীন উন্নয়ন নীতির একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল, শ্রমঘন শিল্প স্থাপন করা। পাশাপাশি উদ্বৃত্ত শ্রমকে বিদেশে রপ্তানির উদ্যোগ নেওয়া। এতে করে নতুন নতুন মানুষের কর্মের সংস্থান হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, জনমানুষ এক শ্রমবাজার থেকে আরেক শ্রমবাজারে প্রবেশও করেছে। যেমন পোশাকশিল্পের বিকাশের কারণে কৃষিনির্ভর গ্রামীণ শ্রমবাজার থেকে মানুষজন পোশাক কারখানার শহরের দিকে যেতে শুরু করে। সাধারণ মানুষের আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি শহুরে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ শুরু হয়। এর সরাসরি প্রভাব আমাদের অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিতে লক্ষ করা যায়।

সার্বিকভাবে ১৯৭৮ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ছিল ২ থেকে ৩ শতাংশ। ১৯৯১-১৯৯৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪-৫ শতাংশে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে ৬-৭ শতাংশ ছিল।

সার্বিক উন্নয়ন ও নতুন কর্মসংস্থানের জন্য বিএনপি এবার দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৮ শতাংশ। মূলত ১০টি খাতকে সার্বিক উন্নয়ন তথা কর্মসংস্থানের জন্য বিএনপি পরিকল্পনা তৈরি করেছে। এগুলো হচ্ছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ম্যানুফ্যাকচারিং, কৃষি, বিদেশে শ্রম রপ্তানি, আইসিটি ও ফ্রিল্যান্সিং, সেবা খাত, সবুজ জ্বালানি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং অন্যান্য।

বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিতকরণ
বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে বিএনপি সরকার বহুমুখী কৌশল গ্রহণ করবে। এই কৌশল কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে। বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করবে। উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করবে। নিম্নের ক্ষেত্রগুলোতে মনোনিবেশ প্রদান করবে।

নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামো সহজীকরণ ও আমলাতান্ত্রিক বাধা কমানো: ব্যবসায় নিবন্ধন, কর আনুগত্য এবং লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া সহজ করবে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কোম্পানি নিবন্ধন ও ট্রেড লাইসেন্সিং চালু করা হবে। এসব পদক্ষেপ উদ্যোক্তাদের সময় ও খরচ কমাবে। এটি ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ এবং নারী নেতৃত্বাধীন ব্যবসার জন্য বিশেষভাবে উপকারী।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ এবং স্টার্টআপগুলোর জন্য অর্থায়নের সুযোগ বৃদ্ধি: বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ সুবিধা প্রসারিত করা হবে। ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম চালু করা হবে। ঋণদাতাদের ঝুঁকি কমাবে। অতিরিক্ত জামানত ছাড়াই ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলোর ঋণ পাওয়া সহজ হবে। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল এবং ক্রাউডফান্ডিংয়ের মতো বিকল্প অর্থায়ন পদ্ধতিকে উৎসাহিত করা হবে। স্টার্টআপ এবং উচ্চ-প্রবৃদ্ধি সম্পন্ন ফার্মগুলোকে সাহায্য করবে।

অবকাঠামো ও শিল্প অঞ্চলে বিনিয়োগ: পরিবহন নেটওয়ার্ক এবং জ্বালানি সরবরাহসহ দক্ষ অবকাঠামো গড়ে তোলা শিল্প বিকাশের জন্য অত্যাবশ্যক। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) এবং শিল্প পার্ক স্থাপন ও সম্প্রসারণ করবে। ফলে বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে। উৎপাদনশীলতা বাড়বে। স্থানীয় শিল্পকে বৈশ্বিক মূল্য শৃঙ্খলায় সংযুক্ত হবে।

বহুমুখীকরণ, উৎপাদনশীলতা ও উদ্ভাবন: পোশাক শিল্প রপ্তানিতে প্রধান ভূমিকা রাখলেও রপ্তানি বৈচিত্র্য আনা প্রয়োজন। ওষুধ, তথ্যপ্রযুক্তি এবং কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে মনোযোগ দেওয়া হবে। এতে অর্থনৈতিক ঝুঁকি কমবে। উন্নত প্রযুক্তি গ্রহণে সহায়তা করা হবে। গবেষণা ও উন্নয়নকে উৎসাহিত করা হবে। উদ্ভাবন, উৎপাদনশীলতা এবং প্রতিযোগিতাসক্ষমতা বৃদ্ধিতে জোড় দেওয়া হবে।

আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা শক্তিশালীকরণ: আর্থিক খাতে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য সাহসী সংস্কার বাস্তবায়ন জরুরি। ব্যাংকিং খাতের সুশাসন উন্নত করা হবে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ানো হবে। অর্থায়নের জন্য পুঁজিবাজারের বিকশিত করা হবে।

ব্যাংকিং খাতকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের জন্য সহজীকরণ: ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য ঋণ প্রক্রিয়া সহজ করা জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম বাড়ানোর মাধ্যমে ছোট ব্যবসার জন্য জামানতের উপর নির্ভরতা কমানো হবে। নগদ প্রবাহভিত্তিক ঋণকে গুরুত্ব দিয়ে সম্পদভিত্তিক ঋণের পরিবর্তে ব্যবসার পারফরম্যান্স এবং ডিজিটাল লেনদেনের ইতিহাস দেখে ঋণ দেওয়া হবে। বিশেষ করে খুচরা ও পরিষেবা খাতে এটি কার্যকর হবে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ব্যাংকিংয়ের জন্য আলাদা বিভাগ খুলতে উৎসাহিত করা হবে। ক্ষুদ্র ব্যবসার হয়রানি বন্ধ করতে ঋণ শ্রেণিকরণ ও আদায় পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। একই সাথে ব্যাংকের স্বার্থও রক্ষা করতে হবে। গ্রামীণ উদ্যোক্তা এবং নারী পরিচালিত উদ্যোগগুলোতে পৌঁছাতে এজেন্ট ব্যাংকিং ও মোবাইল ব্যাংকিং সেবা বাড়ানো হবে। কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, হালকা প্রকৌশল, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং নারী উদ্যোক্তাদের মতো উৎপাদনশীল বেসরকারি খাতে বাধ্যতামূলক ঋণ কোটা চালু করা হবে।

পুঁজিবাজার উন্নতির জন্য পদক্ষেপ: তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে কঠোর স্বছতার নিয়ম এবং স্বাধীন নিরীক্ষা নিশ্চিত করা হবে। বিনিয়োগকারীর ভিত্তি সম্প্রসারণের জন্য বিনিয়োগ শিক্ষা প্রচার, লেনদেন খরচ কমানো এবং হিসাব খোলা সহজ করা হবে। ডিজিটাল ট্রেডিং প্ল্যাটফর্মগুলোকে আধুনিকীকরণ, অনলাইন আইপিও সাবস্ক্রিপশন ব্যবস্থাকে এর সঙ্গে যুক্ত করা এবং দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ফিনটেক প্রযুক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। কর্পোরেট বন্ডের জন্য একটি তারল্য বাজার তৈরি করতে পেনশন তহবিল, বিমা কোম্পানি এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা হবে।

আর্থিক পণ্যের বহুমুখীকরণ: আর্থিক পণ্যের বহুমুখীকরণে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এর মধ্যে রয়েছে; লিজ ও ফ্যাক্টরিংয়ের প্রসার ঘটানো, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ও অ্যাঞ্জেল বিনিয়োগের জন্য আইনি ও আর্থিক কাঠামো তৈরি, প্রাইভেট ইক্যুইটি তহবিল সহায়তা, ইসলামিক আর্থিক পণ্য যেমন মুদারাবা ও ইজারা বিকল্পগুলো বাড়ানো, সবুজ বন্ড এবং ব্লেন্ডেড ফাইন্যান্স উপকরণ চালু, মোবাইল অপারেটর এবং ফিনটেক প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে ডিজিটাল ঋণ প্রদান ইত্যাদি।

জ্বালানি ও বিদ্যুৎ কৌশল প্রণয়ন: প্রাকৃতিক গ্যাস, সৌর, জলবিদ্যুৎ ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে বাংলাদেশের আদর্শ মিশ্রণ নির্ধারণ ও সিস্টেম-ভিত্তিক পরিকল্পনা করতে একটি টাস্কফোর্স গঠন করবে। এই পরিকল্পনা কাঠামো হবে তথ্য-ভিত্তিক, আয়-ব্যয়-মডেলিং সমৃদ্ধ এবং জলবায়ু লক্ষ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। চুক্তি এবং ব্যয়-সুবিধা বিশ্লেষণ জনসাধারণের কাছে প্রকাশে সচেষ্ট থাকবে। এটি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনবে এবং সর্বসাধারণের কাছে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে। নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে ট্রান্সমিশন আধুনিকীকরণ ও ডিজিটাইজেশনে অধিক বরাদ্দ দেওয়া হবে। গ্রিড স্থিতিস্থাপকতা, স্মার্ট মিটারিং এবং আঞ্চলিক আন্তঃসংযোগকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। বাপেক্সকে শক্তিশালী করে গ্যাস, খনিজ অনুসন্ধানে গুরুত্ব দেয়া হবে। নবায়নযোগ্য ও সাশ্রয় প্রযুক্তিতে বিনিয়োগকারীদের জন্য কর প্রণোদনা দেওয়া হবে।

নীল অর্থনীতি: বঙ্গোপসাগরের বিশাল সামুদ্রিক সম্পদকে টেকসইভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং জলবায়ু সহনশীলতা অর্জনের লক্ষ্যে টেকসই সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা, সমুদ্রভিত্তিক শিল্প ও প্রযুক্তির উন্নয়ন, জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও সামুদ্রিক পরিবেশ সংরক্ষণ, উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন গবেষণা এবং উদ্ভাবন ও মানবসম্পদ উন্নয়নে জোর দেওয়া হবে।

প্রধান খাতসমূহ: মৎস্য ও সামুদ্রিক খাদ্য, নৌপরিবহন ও বন্দর, অফশোর গ্যাস ও খনিজ সম্পদ, নবায়নযোগ্য শক্তি (সমুদ্র-বায়ু ও জোয়ার শক্তি), সমুদ্র পর্যটন ও বিনোদন এবং সমুদ্র গবেষণা ও প্রযুক্তি। কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য সমন্বিত “ম্যারিটাইম জোন” ব্যবস্থাপনা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও আঞ্চলিক অংশীদারিত্ব এবং দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা এবং দক্ষতা উন্নয়ন ইত্যাদি উদ্যোগ নেওয়া হবে। সমুদ্র ও উপকূলীয় অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক লাভ নিশ্চিত করতে সামুদ্রিক সম্পদের বিজ্ঞানসম্মত জরিপ, মানচিত্রায়ন এবং সম্পদের প্রকৃত মজুত নির্ধারণ করা হবে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই পদ্ধতিতে সম্পদ আহরণ ও অর্থনৈতিক ব্যবহারের পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে।

সৃজনশীল শিল্প অর্থনীতি: বাংলাদেশের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আছে। বৃহৎ তরুণ জনগোষ্ঠী রয়েছে। ডিজিটাল অবকাঠামোও বাড়ছে। কিন্তু সৃজনশীল অর্থনীতি জিডিপিতে ০.৫ শতাংশেরও কম অবদান। উদীয়মান অর্থনীতিগুলোতে এই খাত ৩-৫ শতাংশ অবদান রাখে।

এই খাতের মধ্যে রয়েছে: চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন নির্মাণ, সঙ্গীত ও মঞ্চ শিল্পকলা, অ্যানিমেশন, ভিএফএক্স ও গেমিং, মেকআপ, পোশাক এবং নকশা, ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য বিষয়বস্তু তৈরি, সিজিআই এবং ক্রিয়েটিভ মিডিয়া সেবাদাতা সফটওয়্যার কোম্পানি, ইউটিউব, টিকটক এবং ইনফ্লুয়েন্সার অর্থনীতি ইত্যাদি।

বাণিজ্য সহজীকরণ ও শুল্ক পদ্ধতি উন্নয়ন: শুল্ক পদ্ধতি সহজ হলে এবং বাণিজ্য বাধা কমলে রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াবে। শুল্ক শ্রেণিবিন্যাস ডিজিটাইজ করা হবে। আমদানি প্রক্রিয়া, বিশেষ করে মূল কাঁচামালের জন্য ক্লিয়ারেন্স দ্রুততর করবে। ব্যবসায়ীদের খরচ কমাবে।

ডিজিটাল আর্থিক সেবার ব্যবহার বৃদ্ধি: ডিজিটাল আর্থিক সেবার প্রসার অর্থায়নের সুযোগ বাড়াবে। এটি বিশেষত সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চ লেনদেনসীমাসহ মার্চেন্ট ওয়ালেটের জন্য মোবাইল আর্থিক সেবা সক্রিয় করতে প্রোটোকল স্থাপন করা হবে। এটি পাইকারি লেনদেন সহজ করবে। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের জন্য ডিজিটাল পেমেন্টও সহজলভ্য করবে।

কর্পোরেট গভর্ন্যান্স ও সামাজিক দায়বদ্ধতা উন্নতকরণ: শক্তিশালী কর্পোরেট গভর্ন্যান্স ও কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা অনুশীলনে জোড় দেওয়া হবে। ফলে বেসরকারি খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়াবে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের কার্যক্রম টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করতে উৎসাহিত করা হবে। ফলে সমন্বিত প্রবৃদ্ধি এবং পরিবেশগত স্থিতিশীলতা এগুবে।

পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) শক্তিশালীকরণ: কার্যকর পিপিপি নীতি তৈরি ও বাস্তবায়ন জরুরি। অবকাঠামো ও সরকারি সেবায় বেসরকারি বিনিয়োগ জোগাড়ের উদ্যোগ নেয়া হবে। এই সহযোগিতামূলক পদ্ধতি সেবা প্রদান উন্নত করবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গতিশীল হবে।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও সবুজ প্রবৃদ্ধি: অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় জলবায়ু সহনশীলতা অন্তর্ভুক্ত করা টেকসই উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশ ক্লাইমেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট প্ল্যাটফর্ম (বিসিডিপি) এর মতো প্ল্যাটফর্ম স্থাপন করা হবে। জলবায়ু অভিযোজন ও প্রশমন প্রকল্পে বিনিয়োগ আকর্ষণের প্রচেষ্টা নেয়া হবে। সরকারি ও বেসরকারি খাত একত্রে কাজ করবে।

ঋণ ব্যবস্থাপনা ও রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি
রাজস্ব চাপ, মুদ্রানীতি কঠোরীকরণ এবং আর্থিক ভঙ্গুরতার কারণে সামস্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় উল্লেখযোগ্য ঝুঁকি বিদ্যমান। দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার স্বার্থে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাজস্ব কৌশল প্রণয়ন, কাঠামোগত সংস্কার এবং প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক, সমতা-ভিত্তিক টেকসই উন্নয়নের পথে গ্রহণ করা হবে। বিএনপি ঋণের বোঝা কমাতে ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ বৃদ্ধির কৌশলও নির্ধারণ করেছে। সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো—

ঋণ ব্যবস্থাপনা কৌশল: সরকারি ঋণের গঠনগত উন্নয়ন ও ঋণ সংগ্রহের ব্যয় হ্রাস বিষয়ক ‘মধ্যমেয়াদি ঋণ ব্যবস্থাপনা কৌশল (এমটিডিএস)’ প্রণয়ন করবে। সুদ পরিশোধের বোঝা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে রোলওভার ঝুঁকি কমাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণের ওপর নির্ভরতা হ্রাস করবে। রাজস্ব ও মুদ্রানীতির মধ্যে সমন্বয় বাড়িয়ে সরকারি ঋণ সংগ্রহকে অনুকূলিত করে ব্যক্তিখাতের ঋণ প্রবাহ সংকোচন বন্ধ করবে।

ব্যয় অগ্রাধিকরণ ও দক্ষতাবৃদ্ধির কৌশল: অভ্যন্তরীণ সুদ পরিশোধ ও পরিচালন ব্যয় নিয়ন্ত্রণে ঋণ ব্যবস্থাপনা ও ভর্তুকি যুক্তিসঙ্গতকরণ করা হবে। এক্ষেত্রে সরকারি ব্যয় পর্যালোচনা কাঠামো গঠন, নতুন প্রকল্পের জন্য কঠোর ব্যয়-লাভ বিশ্লেষণ নির্দেশিকা এবং কর্মক্ষমতা-ভিত্তিক বাজেটিং পদ্ধতি প্রণয়ন করা হবে।

স্বল্পমেয়াদী ঋণের উপর নির্ভরতা হ্রাস: স্বল্পমেয়াদি ঋণের ওপর নির্ভরতা হ্রাস করে সরকারের দায়ের পরিমাণ কমানো হবে। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারি খাতের ঋণগ্রহণের হার কমিয়ে ব্যক্তিখাতের ঋণ প্রবাহ বাড়িয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি সঞ্চার করা হবে।

ঋণ-উন্নয়ন-বিনিময় কৌশল: ঋণদাতা সংস্থাগুলোর সাথে আলোচনা করে বৈদেশিক ঋণকে স্থানীয় বিনিয়োগে রূপান্তর করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। রূপান্তরিত অর্থ জলবায়ু পরিবর্তন জনিত অভিযোজন বৃদ্ধি, শিক্ষা অবকাঠামো শক্তিশালীকরণ এবং স্বাস্থ্য কাঠামো তৈরির মত জনহিতকর কাজে ব্যবহার করা হবে। এতে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের ফলে সৃষ্ট বৈদেশিক সাহায্যের হ্রাসজনিত ফারাকও কমাবে। একদিকে বৈদেশিক ঋণের বোঝা কমবে, অন্যদিকে সম্পদ সরাসরি টেকসই ও সমতাভিত্তিক প্রবৃদ্ধি তৈরির চালিকাশক্তিতে নিয়োজিত হবে।

অবৈধ ঋণ পর্যালোচনা ও বাতিলকরণ প্রক্রিয়া: স্বৈরতান্ত্রিক শাসনকালে গৃহীত সব ঋণ পর্যালোচনা ও বাতিলকরণ প্রক্রিয়ার জন্য জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের অনুরোধ জানানো হবে।

রাজস্ব ব্যবস্থার যুগোপযোগীকরণ: এনবিআরকে একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হবে। নীতি প্রণয়নের কাজ করতে বর্তমানের শুল্ক ও বাণিজ্য কমিশনকে আওতাভুক্ত করে ‘বাংলাদেশ কর ও শুল্ক কমিশন’ নামে একটি পৃথক প্রতিষ্ঠান গড়া হবে।

কর কোড আধুনিকায়ন: প্রত্যক্ষ করকে অগ্রাধিকার দিয়ে ‘কর কোড’ আধুনিকায়ন করা হবে। সহজীকরণ এবং ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি উপজেলা পর্যায়ে অফিস স্থাপন করে করের আওতা বাড়ানো হবে।

প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি ব্যবস্থা: প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি ব্যবস্থা তথা বিদ্যুৎ বিল, ব্যাংক লেনদেন, ভূমি রেকর্ড ইত্যাদি একীভূত করে কর সনাক্তকরণ ড্যাশবোর্ড চালু, বন্ডেড গুদামের জন্য ব্লকচেইন-ভিত্তিক ট্র্যাকিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত ঝুঁকি মূল্যায়ন জালিয়াতি রোধে সহায়ক হবে।

সবুজ কর কাঠামো: উচ্চ কার্বন নিঃসরণকারী শিল্পের উপর কার্বন কর আরোপ করা হবে। উক্ত রাজস্ব জলবায়ু অভিযোজন তহবিলে যাবে।

কার্যকর ট্রান্সফার প্রাইসিং আইন: বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মাস্টার ও স্থানীয় নথি জমা এবং দেশওয়ারি রিপোর্টিং বাধ্যতামূলক করা হবে। মুনাফা স্থানান্তরের ওপর কঠোর জরিমানা আরোপ করা হবে।

বাজেট প্রক্রিয়ার সংস্কার
বাজেট অনুমোদনের জন্য প্রচলিত সাংবিধানিক পদ্ধতি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে। জবাবদিহিতা এবং বাংলাদেশে সংসদীয় তদারকি শক্তিশালী করার জন্য মৌলিক সাংবিধানিক ও পদ্ধতিগত সংস্কারও করা হবে। সংসদীয় কমিটিকে শক্তিশালী করা, স্বচ্ছতা এবং জনসাধারণের অংশগ্রহণ, নির্বাচনপূর্ব কেয়ারটেকার সরকারের জন্য পরিষ্কার নির্দেশিকাসহ বিস্তৃত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হবে।