সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে রাজনীতিতে বিভক্তি, গণমানুষের মতামত কোথায়?

- আপডেট সময় : ১০:০৪:১৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ৯ জুন ২০২৫
- / ৩৬৮ বার পড়া হয়েছে

দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চায় সবাই, তবে নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে একমত নয় পক্ষগুলো। বৈষম্যবিরোধীদের অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার কথা তুলে ধরে একদল চায় এখনই সংস্কার, আরেক দল চায় সংবিধান মেনে নির্বাচিত সংসদ করবে সংস্কার। যার যার মতাদর্শ অনুসারে রাজনৈতিক দলগুলোর এ অবস্থান দলের স্বার্থে না জাতীয় স্বার্থে সে বিতর্কও উঠেছে।
প্রশ্ন উঠেছে তাহলে গণমানুষের মতামত কোথায়। ঐকমত্যে পৌঁছাতে গণভোট কতটা যৌক্তিক বিষয় হতে পারে ? ঐকমত্য কমিশন বলছে গণভোট না গণপরিষদ, সংস্কার হবে কি- হবে না, সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে, বল এখনও রাজনৈতিক দলগুলোরই কোর্টে।
৩০০ আসনবিশিষ্ট এক কক্ষের এই সংসদকে দ্বিকক্ষে রূপান্তরের প্রস্তাব এজন্য করা হচ্ছে যে, আশা করা হচ্ছে আইনসভায় পরস্পর নির্ভরশীল দুইটি ভাগ থাকলে ক্ষমতায় গিয়ে একটি দল বা ব্যক্তির স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত নেবার পথ বন্ধ হবে।
এক্ষেত্রে বর্তমান কাঠামোর ৩০০ আসনের সংসদ হবে নিম্নকক্ষ, যেখানে প্রচলিত নির্বাচন পদ্ধতির মাধ্যমে প্রতিটি সংসদীয় আসন থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পাওয়া প্রার্থী নির্বাচিত হবেন। তবে উচ্চ কক্ষ হবে ১০০ আসনের, যারা ঐ একই সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে দল কর্তৃক মনোনীত হবেন।
এর ব্যাখ্যায়, সংস্কার কমিশনের সদস্যরা বলছেন, এক্ষেত্রে নিম্নকক্ষে কোনো আসন না পেয়েও ঐ জাতীয় নির্বাচনে মোট ভোটের ১ শতাংশ পেলেও উচ্চকক্ষে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হতে পারে যে কোন দলের।
অধিকতর গণতান্ত্রিক বিবেচনা করে উচ্চকক্ষ গঠনের এই প্রস্তাবকে সমর্থন দিয়েছে বেশিরভাগ দল। কিন্তু উচ্চ কক্ষে সংসদ সদস্য নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিয়ে আপত্তি আছে বিএনপির। তারা উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি চায় না বরং বর্তমানের সংরক্ষিত নারী আসনের মত করে নিম্নকক্ষে প্রাপ্ত সিটের অনুপাতে উচ্চকক্ষের প্রতিনিধিত্ব ঠিক করতে চায়। যদিও বহু আগে থেকেই দলটিকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের কথা বলতে দেখা গেছে এবং এটা তাদের ঘোষিত ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবেরও একটি।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদারের কাছে জানতে চাওয়া হয়, বিএনপি যে রকম উচ্চকক্ষ চায়, সেটা সবার মানতে সমস্যা কোথায়?
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘নিম্নকক্ষের আসন সংখ্যার ভিত্তিতে যদি উচ্চকক্ষ গঠিত হয় তাহলে যেই দল ক্ষমতায় আছে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আরো নিরঙ্কুশ হবে। শক্তিশালী হবে এবং নিম্নকক্ষে অনেক ক্ষেত্রে জনস্বার্থ বিরোধী আইন কানুন সিদ্ধান্ত হয় সেগুলো আরো সহজে করতে পারবে।’
বস্তুত ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর যে ধারাবাহিক ক্লান্তিহীন বৈঠক চলছে তাতে আপাতত দৃষ্টিতে বেশিরভাগ সংস্কারে দলগুলোতে ইতিবাচক দেখা গেলেও মৌলিক বিষয়গুলোতে মত পার্থক্য আছে। অনেক প্রস্তাবে। যেমন প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ও এক ব্যক্তির একসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, দলীয় শীর্ষ পদে থাকা নিয়ে। বেশিরভাগ দল দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী নয় প্রস্তাবের পক্ষে থাকলেও বিএনপি এমন একটি প্রস্তাব করছে যার ফলে দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ থাকবে। একইভাবে এক ব্যক্তির সরকারের প্রধান ও দলীয় প্রধান থাকা না থাকার বিষয়কে একজন রাজনৈতিকের অধিকার হিসেবে দেখছে বিএনপি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এইটা পার্টির একটা স্বাধীনতা। পার্টি কাকে প্রধানমন্ত্রী বানাবেন। দেশনেত্রী খালেদা জিয়া ২০০১ সালে মেজরিটি আসন পেয়েছিলেন সংবিধান সংশোধনীর জন্য। আমরা তা সংশোধন করেছিও দুই একটা বিধান। কিন্তু তিনি তো কেয়ারটেকার সরকার বিলুপ্ত করেননি। কিছু কিছু বিষয় আলোচনা হওয়ার পরে আমরা একমত হয়েছি। কিছু কিছু বিষয় আংশিকভাবে একমত হয়েছি। এখন সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাব দিয়েছে সবকিছু একমত হলে তো বাকশাল হয়ে যাবে।’
যদিও বিএনপির এমন অবস্থাতে ভিন্ন মত আছে জামাত ও এনসিপির।
জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘বাকশাল আর কারো মতামতকে ধার ধারেনি। আর কারো মতামতকে গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু ঐকমত্য কমিশন চেয়েছে সকল রাজনৈতিক দল জনগণের স্বার্থে এক জায়গায় এসে একভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে তাদের মতামত ব্যক্ত করুক।’
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ‘যৌক্তিক কোনো বিষয়ে আমার দলীয় ইন্টারেস্টের কারণে যদি বা ব্যক্তি ইন্টারেস্টের কারণে হবোই না। সেখানে যদি আমি আগেই মাইন সেট করে থাকি হবোই না তাহলে আরেকটা ভাষা আবিষ্কার করতে হবে সেখানে বাকশাল হবে কি হবে না। তাহলে এইটাও গ্রহণযোগ্য হইতে পারে না।’
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সেগুলোর ক্ষেত্রে সংসদ সেগুলোর ব্যাপারে পরিবর্তন করতে পারবে না কিংবা সেগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিতে পারবে না। সেগুলোর জন্য গণপরিষদ লাগবে। তাই বল এখন রাজনৈতিক দলের কোর্টে। তার যদি চায় তাহলে সংস্কার হবে।’
কিন্তু আরেক বাস্তবতা হলো সংস্কারের অনেক মৌলিক বিষয়ে যতটা না মতপার্থক্য আছে তার থেকে বেশি দূরে আসে প্রস্তাব বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে। এছাড়া সংবিধানের পুনর্লিখন নিয়ে দলগুলোর মত ভিন্ন ভিন্ন।
জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘পুনর্লিখন মানে মৌলিকভাবে একটা পরিবর্তন লেখা। সেটাকে পাকাপোক্ত করার দিকে অগ্রসর হওয়া। অনিশ্চিত সংবিধান বাংলাদেশে থাকুক। নতুন যে বাংলাদেশ কাঠামো হবে সেটা গণপরিষদের মধ্য দিয়ে হোক।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘গণপরিষদ হচ্ছে নতুন সংবিধান গ্রহণ করার ক্ষেত্রে। আমাদের তো একটা সংবিধান রয়েছে। আমরা মনে করি এই সংবিধানের গণতান্ত্রিক সংস্কার দরকার সেটাই আমরা করবো। সেটার জন্য গণপরিষদ করার তো প্রয়োজন।’
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ‘র্যান্ডম আপনি আলোচনায় অংশগ্রহণ করতেছেন। আবার মডিফাই করার মতামত দিচ্ছেন। সংবিধানে সাপোর্ট করে না এমন একটি সরকারের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন আপনি। তার একটি ধারাবাহিকতায় হচ্ছে একটি গণভোট।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘গণভোট তো সাধারণ বিষয় না। এখানে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হলে অনেকগুলো বিষয় থাকবে। শুধু একটা দুইটা বিষয়ে উপর গণভোট হওয়া সহজ।’
২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘দিন বদলের সনদ’ শ্লোগান দিয়ে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলো আওয়ামী লীগ। কিন্তু দেশকে গণতান্ত্রিক উত্তরণের দিকে বদলে দেবার বদলে দলটি কী করে স্বৈরতন্ত্রের দিকে ধাবিত হয়েছিলো এবং তার জেরে গণঅভ্যুত্থানের মুখে কীভাবে দলটির পতন হয়েছে সেটা এখন বেশ চর্চিত বিষয়।
এছাড়া তিন জোটের রূপরেখা কিংবা ১/১১ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সংস্কার প্রস্তাবগুলোও রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় এসে সেভাবে যে গুরুত্ব দেয় নি, সেই অভিজ্ঞতাও আছে এদেশের মানুষের।