জুলাই কেবল আবেগে ভাসার মাস নয়, এটি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ের ডাক ছিল বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
মঙ্গলবার (১ জুলাই) ‘জুলাই অভ্যুত্থান’ স্মরণে মাসব্যাপী কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ মন্তব্য করেন।
‘জুলাই ছিলো মর্মবাণী, ফ্যাসিবাদী বিলাপ ছিন্ন করে নতুন বাংলাদেশ গড়ার। এই আন্দোলন ছিল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ের ডাক। এখন আমাদের কাজ, যেন আবার গণঅভ্যুত্থানের জন্য অপেক্ষা করতে না হয়। স্বৈরাচারী শাসনের নতুন কোনো চক্রান্ত মাথাচাড়া দেওয়ার আগেই তা রুখে দিতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই কর্মসূচির মূল লক্ষ্য জনগণকে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা, রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার দাবি তোলা এবং কাঙ্ক্ষিত সংস্কারের সুযোগ যাতে হারিয়ে না যায়, তা নিশ্চিত করা। যে লক্ষ্যে ছাত্রজনতা শহীদ হয়েছেন, সে লক্ষ্য বাস্তবায়নে আমাদের আবার শপথ নিতে হবে। প্রতিবছর যেন জুলাই উদযাপন করা হয়, যাতে স্বৈরাচার কোনোভাবে মাথাচাড়া দিতে না পারে।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ২০২৪ সালের এই দিনে আমাদের শিক্ষার্থীরা যে উদ্দেশ্য আন্দোলনে নেমেছিল, সেই উদ্দেশ্য তারা অর্জন করেছে। এর মাধ্যমে আমরা একটি নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। তিনি বলেন, জুলাই আন্দোলনের মর্মবাণী ছিল ফ্যাসিবাদ বিলোপ করে নতুন বাংলাদেশ গঠন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা প্রতি বছর এই সময়কালটা উদযাপন করব যাতে পরবর্তীতে ১৬ বছর আমাদের অপেক্ষা করতে না হয় আবার এই অভ্যুত্থান করার জন্য। আমরা প্রতি বছর এটা করব যাতে কোনো স্বৈরাচারের কোনো চিহ্ন দেখা গেলে সেটা তাৎক্ষণিকভাবে আমরা বিনাশ করতে পারি সেটার জন্য এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বৈরাচারের প্রথম পাতা মেলার আগেই যেন আমরা তাকে ধরে ফেলতে পারি। ১৬ বছর যেন আমাদের অপেক্ষা করতে না হয়। আজকের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে আমি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি সেই সব তরুণ-তরুণী, নারী-পুরুষ, শিশু- বৃদ্ধ, কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক, রিকশাচালকদের—যারা রাস্তায় নেমে গণতন্ত্রের পতাকা উঁচিয়ে ধরেছিলেন; সাহস, ত্যাগ আর দৃঢ়তার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। আমরা আজ মাসব্যাপী যে কর্মসূচির সূচনা করছি, তা শুধুই স্মরণ নয়, বরং একটি নতুন শপথ। গত বছরের জুলাইয়ে এ দেশের সকল শ্রেণি-পেশা-বয়সের মানুষের মধ্যে যে ঐক্য তৈরি হয়েছিল আমরা চাই এই জুলাইয়ে সেই ঐক্য আবার সুসংহত হোক। আমাদের এই কর্মসূচির মূল লক্ষ্য— জনগণকে গণতান্ত্রিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা, রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার দাবি জানানো এবং রক্তের বিনিময়ে পাওয়া সংস্কারের এই সুযোগকে হারিয়ে না ফেলা।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের সামনের পথ অনেক কঠিন, কিন্তু মস্ত বড় সম্ভাবনাও আছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, জনগণ যখন জেগে ওঠে, তখন কোনো শক্তিই তাদের রুখে দিতে পারে না। সেই বিশ্বাস নিয়েই আমি আপনাদের আহ্বান জানাই— আসুন, এই জুলাই মাসকে পরিণত করি গণজাগরণের মাসে; ঐক্যের মাসে।’
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে মাসব্যাপী কর্মসূচির সূচনা করা হয়। একইসঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয় ‘জুলাই ক্যালেন্ডার’। এ ছাড়া, নিহত শহীদদের স্মরণে দেশের সব ধর্মীয় উপাসনালয়ে (মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা) বিশেষ দোয়া ও প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়।
একই দিনে জুলাই খুনিদের বিচারের দাবিতে শুরু হয়েছে গণস্বাক্ষর অভিযান, যা আগামী ১ আগস্ট পর্যন্ত চলবে। একই সাথে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে শহীদদের স্মরণে একটি শিক্ষাবৃত্তি কার্যক্রম চালু করা হয়েছে।
অনুষ্ঠানসূচি অনুযায়ী, জুলাই মাসজুড়ে আরও কয়েকটি তারিখে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হবে; যার মধ্যে রয়েছে ৫ জুলাই, ৭ জুলাই এবং ১৪ জুলাই। উদযাপনের চূড়ান্ত দিন ৫ আগস্টকে ('৩৬ জুলাই' নামে চিহ্নিত) কেন্দ্র করে থাকবে বিশেষ আয়োজন। সেদিন স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা নিবেদন, শহীদ পরিবারের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ, বিজয় মিছিল, এয়ার শো, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ভিডিও-ডকুমেন্টারি প্রদর্শনী এবং ড্রোন শো অনুষ্ঠিত হবে।
২০২৪ সালের জুলাই মাসজুড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে ছাত্র-জনতা এক বিশাল আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। এই আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ নেয় ৫ আগস্টে, যখন শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। এই ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানই বর্তমানে 'জুলাই বিপ্লব' বা 'জুলাই গণঅভ্যুত্থান' নামে পরিচিত।