কোটা সংস্কার আন্দোলনে দেশজুড়ে ছাত্র-জনতার উপর নির্যাতন চালায় আওয়ামী লীগ, তার অঙ্গসংগঠন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এর মধ্যে যে কয়টি ঘটনা আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় তার মধ্যে অন্যতম ছিল রাজধানীর ধানমন্ডিতে ফারহান ফাইয়াজের গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর ঘটনা। এরপর থেকেই ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর আর সায়েন্সল্যাব হয়ে ওঠে আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এছাড়াও এই ধানমন্ডিতেই আওয়ামী লীগের পার্টি অফিস, ৩২ নম্বর আর সুধাসদন। ৫ আগস্ট বিজয়ের পরও এই স্থানগুলো থেকে পুলিশ অনেককেই গ্রেপ্তার করে।
২০২৪ সাল, জুলাইয়ের ২ তারিখ, শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে মিছিল সমাবেশ শুরু করে। আর এই কর্মসূচির শুরুটা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহবাগ থেকে।
ধীরে ধীরে এই আন্দোলনের পরিসর বাড়তে থাকে পুরো দেশজুড়ে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে এই কোটা আন্দোলন ছাত্র-জনতার আন্দোলনের রূপ নেয়। আর তখন থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে অবস্থান নেয়া শুরু করে ছাত্র-জনতা। আর এই আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা রাজধানীর সাইন্সল্যাব, ধানমন্ডি ও মোহাম্মদপুর।
১৮ জুলাই, দেশব্যাপী প্রতিরোধ, সহিংসতা আর সংঘর্ষ। এর মাঝেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাজধানীর সাইন্সল্যাব, ধানমন্ডি ২৭ আর মোহাম্মদপুরে অবস্থান নেয়। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট ছিল সাইন্সল্যাব তিন রাস্তার মোড়। একদিকে ধানমন্ডি ৩/এ আওয়ামী লীগের পার্টি অফিস, অন্যদিকে সেসময়কার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসা। পুলিশ, র্যাব, আনসার আর ছাত্রলীগ একের পর এক হামলা চালায় ছাত্র জনতার উপর। আর এই হামলায় সাইন্সল্যাব পপুলার হাসপাতালের সামনে গুলিবিদ্ধ হন সামিন আলম অনু। সাথে সাথেই তাকে নিয়ে যাওয়া হয় রাজধানীর পপুলার মেডিকেল হাসপাতালে। ভর্তি, চিকিৎসা আর নতুন বাংলাদেশের শুরু হলেও, বুকের মধ্যে গুলি নিয়ে এখনও জীবন পাড় করছেন তিনি।
সামিন আলম অনু বলেন, ‘যদি ওইটার বিস্তারিত জানাতে হয়, তাহলে বলতে হবে যে ইংলিশ মুভির যে অ্যাকশন সিনেমার সেট সেটাও মনে হয় এরকম রিয়েল হয় না। ইংলিশ মুভির সেটের থেকেও ভয়াবহ অবস্থা। চারদিকে ধোঁয়া, গুলি। গুলি আমার ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল, ডাক্তার আমাকে জিজ্ঞেস করছে যে আমি নিশ্বাস নিতে পারছি কি না। উনি ভেবেছিল যে, গুলি আমার ফুসফুসের ভেতরে ঢুকে গেছে। দেখলো যে নিশ্বাস স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছি। উনি দেখলো যে পেছনে গুলি বের হয়ে গেছে কি না। তারপর এক্স রে করে বললো যে আপনি মরবেন না।’
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করার ঘোষণা আসার পর থেকেই ধানমন্ডি, জিগাতলা, সাইন্সল্যাবে ছাত্র-জনতার উপর হামলার পরিসরও বাড়তে থাকে। জুলাইয়ের শেষ দিক আর আগষ্টের শুরু থেকেই ধানমন্ডি ৩/এ পার্টি অফিস, ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বাসার সামনে অবস্থান নেয় আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতা কর্মীরা। ছাত্র-জনতা পেলেই চেক করা হয় আইডি কার্ড, পাওয়া না গেলে মারধর করা হয় তাদের উপর।
আন্দোলনকারীদের মধ্যে একজন বলেন, ‘একটা বড় ঝুঁকি নিয়েই ধানমন্ডি পার্টি অফিস হয়ে গিয়েছিলাম। কারণ যদি তারা আমাকে দেখতো আমাকে হয়তো ধরে ফেলতে পারতো।’
অন্য একজন বলেন, ‘আমার সামনে একজনের কপাল দিয়ে গুলি ঢুকলো মাথা ভেদ করে বের হয়ে গেলো। চোখের সামনে দেখে ভাবলাম যে, এটা আমি হতে পারতাম। আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখছে। কিন্তু যে কারণে এই আন্দোলন হয়েছে, তার কোনো প্রতিফলন এখনও সমাজে প্রতিফলিত হয়নি।’
আন্দোলনের মাঝেই সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ আসে রাজধানীর ২৭ নম্বরে ফাইয়াজ ফারহানের মৃত্যুর খবর। পরিবারের শত মানা করার পরও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যায় ফারহান ও তার সহপাঠীরা। স্কুল ও কলেজ ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ হওয়ার কারণে আন্দোলনের বেশিরভাগ সময়ই তিনি অবস্থান করতেন ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে। কথা হয় ফাইয়াজের বাবার সাথে। জানান, গুলিবিদ্ধ্ব ফাইয়াজকে যখন লালমাটিয়া সিটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন আইসিইউতে নেয়া হলেও ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করে। ফাইয়াজের চিকিৎসার সকল কাগজপত্রগুলোও নিয়ে নেয় ছাত্রলীগের কর্মীরা, যেন প্রমাণ হিসাবে কিছুই না থাকে।
শহীদ ফারহান ফাইয়াজের বাবা শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি গিয়ে আমার ছেলেকে আইসিইউতে দেখলাম। কিন্তু ও আসলে অন দ্য স্পটেই ডেড বলা যায়। খুবই দুঃখজনক। ডাক্তাররাও তাই বললো, যারা ছিল আওয়ামী লীগ বাহিনীর তারা সমস্ত নথিপত্র নষ্ট করে দিয়েছিল। যে লক্ষ্যে আমার ছেলে জীবন দিয়েছিল, সে লক্ষ্য তো আসলে আজকে দেখছি তার ধারেকাছেও আমরা যেতে পারিনি। এটা আমাদের সবচেয়ে বড় কষ্ট।’
১ জুলাই থেকে ৩৬ জুলাই। বাংলা ব্লকেড, কমপ্লিট শাটডাউন, নয় দফা, দেশজুড়ে কারফিউ আর সেনা মোতায়েন, এরপরেই লং মার্চ আর আওয়ামী লীগ সরকারের পতন। নতুন বাংলাদেশে, নতুন সরকার গঠন। আর্থ সামাজিক আর রাজনৈতিক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। এক বছর পর সেই আকাঙ্ক্ষার স্বাদ কতটুকু পেলো সাধারণ জনগণ?
শিক্ষার্থীদের মধ্যে একজন বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার শুধু যারা রাজনৈতিক স্টেক হোল্ডার এদের সঙ্গেই সবরকম মতানৈক্য, সবরকম ঐক্য করার চেষ্টা করে যাচ্ছে এবং মতামত নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানটা সাধারণ মানুষের ছিল, সাধারণ জনগণের ছিল, কজন সাধারণ শিক্ষার্থীর ছিল, তাদের থেকে কোনো মতামত নেয়া হচ্ছে না।’
অন্য একজন বলেন, ‘জুলাই স্পিরিটের পর আমাদের দেশের অবস্থা যে অবস্থানে দেখার কথা ছিল, আসলে আমাদের দেশের অবস্থা সে অবস্থানে নেই। বলতে গেলে আগে যেমন ছিল তেমনই আছে। শুধু আমাদের শাসনকালটা পরিবর্তন হয়েছে।’
২০১৮ সালের প্রথম দফার কোটা সংস্কার আন্দোলন শেষ হয় ২০২৪ সালের পাঁচ আগষ্ট। এরই মাঝে ঝড়ে যায় শতাধিক প্রাণ আর আহত হয় কয়েক হাজার মানুষ।