ঢাকা ০৩:৩৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫, ২৪ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

মুছে ফেলা হয়েছে চব্বিশের গণআন্দোলনের দেয়াল গ্রাফিতি

অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট সময় : ১২:৫৪:৩০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ জুলাই ২০২৫
  • / ৩৫৬ বার পড়া হয়েছে
৭১ নিউজ বিডির সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

দেয়ালে দেয়ালে মুক্তির বারতা। স্বৈরাচার পতনের লেখনীতে অগ্নিশিখা। চব্বিশের গণআন্দোলনে যেন বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল দেয়ালের গ্রাফিতি। তবে বছর ঘুরতেই প্রতিবাদের অনেক চিহ্ন বদলে গেছে। কোথাও কোথাও মুছে ফেলা হয়েছে গ্রাফিতি। জুলাইয়ের স্পন্দন আর চেতনার গ্রাফিতি বদলে না ফেলার আহ্বান সবার কণ্ঠে।

‘এবার পথে নামো, হাতের মুঠো খুলে প্রতিরোধ হোক শুধু, মানুষের দেখানো বিক্ষোভে’; ‘স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল আসছে’; ‘প্লিজ কেউ কাউকে ছেড়ে যায়েন না’— এসবই জুলাইয়ের দগদগে স্মৃতি। সঙ্গে ছিল ভয়ের সংস্কৃতিকে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়ার প্রত্যয়; দ্রোহ আর প্রতিবাদের বারুদ বিস্ফোরণ; বুলেটের সামনে বুক পেতে দেয়া আর বুলেটবিদ্ধ ঝাঁঝড়া দেহ।

আধিপত্যবাদের নিকষ থাবা থেকে মুক্ত হবার আকাঙ্ক্ষায় জেগেছিল ছাত্র-জনতা। সেই দ্রোহকে বুকে ধারণ করেছিল শহরের দেয়ালও। শেওলা জমা দেয়ালে ঠাঁই পায় প্রতিবাদী লেখনী। শ্রাবণ বিদ্রোহের পটভূমিতে প্রাচীরও যেন হয়ে ওঠে প্রতিবাদের ক্যানভাস। তুলির আঁচড়ে প্রতিবাদী গ্রাফিতি ছড়ায় রক্তিম আভা।

বুলেটের বিপরীতে তারুণ্যের অনুপ্রেরণা ছিল রংতুলি। দেয়ালে দেয়ালে মুক্তির বারতা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তরুণরা। ভয়কে জয় করে তাদের আঁকা গ্রাফিতি অগ্নিশিখা হয়ে জ্বলেছিল গণমানুষের মনে।

গ্রাফিতি আর্টিস্ট ফাইজা ফায়রুজ বলেন, ‘মিছিলের সাথে সাথে ঘুরে গ্রাফিতি আঁকতাম। কারণ যদি একা পায় পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে। গ্রাফিতির যদি কোনো ক্ষমতাই না থাকতো, যদি এটা আসলে কোনো স্টেটমেন্ট না হতো, তাহলে কিন্তু এটা মুছে ফেলার জন্য বা এটা না হতে দেয়ার জন্য এত বড় আয়োজন কখনোই করা হতো না।’

অপর এক গ্রাফিতি আর্টিস্ট রাইয়ান আজমাইন বলেন, ‘রিস্কি কিছু করছে বা হাসিনার বিরুদ্ধে যাচ্ছে কোনো গ্রাফিতি, তখনই তাকে পুলিশ পিকআপে করে তুলে নিয়ে গেছে। এমন অনেক ঘটনাই আমরা পড়েছি। যেমন আমার ঢাকায় গ্রাফিতি করতে ভয় লাগতো যে এই মনে হয় আমাকে তুলে নিয়ে যাবে।’

শিক্ষার্থীরা জানান, মানুষের মনের তীব্র যে আকাঙ্ক্ষাটা তারা সেটা রংতুলির মাধ্যমে তুলে ধরতে পারছে। এটাই একটা বিপ্লব। এই ভাষাটা এমন ছিলো যে, একজন রিকশাচালক হয়তো পড়ছে একটা গালি এটা সেও অনুধাবন করতে পারছে যে সেও এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত।

‘কথা ক, স্বৈরাচার’, ‘স্বৈরাচারের পতন চাই’, ‘হামার ব্যাটাক মারুলু ক্যানে’, ‘বিকল্প কে?-তুমি, আমি, আমরা’— এসব গ্রাফিতি দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ আর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জাগিয়ে তুলেছিল। কিন্তু ২৪-এর জুলাই আন্দোলনের বছর ঘুরতেই মুছে দেয়া হয়েছে অনেক গ্রাফিতি। পোস্টার আর বিজ্ঞাপনের চাপে অনেকটাই দৃষ্টির আড়ালে।

আপত্তিকর শব্দের ধোঁয়া তুলে কোথাও কোথাও মুছে ফেলা হয়েছে গ্রাফিতি। বদলে গেছে উত্তাল জুলাইয়ের ক্রোধের ভাষাও। তবে কি আন্দোলনের স্মারক হিসেবে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে গ্রাফিতি?

গ্রাফিতি আর্টিস্ট রাইয়ান আজমাইন বলেন, ‘ছোট একটা জায়গায় হয়তো হাসিনাকে গালি দিয়ে কিছু লিখা হয়েছে, এখন এই গালিটা মিশিয়ে আমি হয়তো ফুল লতা পাতা টাইপের কিছু একটা করে দিতেই পারি।’

ফাইজা ফায়রুজ বলেন, ‘পরবর্তী একটা আন্দোলন বা অভ্যুত্থান যেটা মানুষ বলছে সেটা হলে তার চিহ্ন আসলে কত দ্রুত মুছে ফেলা যাবে। কিংবা সেসব স্মৃতিচিহ্নকে নিয়ে কে তার স্বার্থ আদায়ের খেলাতে নামবে এটা আসলে খুব শঙ্কাজনক।’

শিক্ষার্থীরা জানান, দেয়াল লিখনগুলো যেভাবে আলোড়িত করে, এখন মুছে ফেলার পর সেট করছে না। ৫ আগস্টের পরে কিছু মানুষ, কিছু সংগঠন তাদের নিজ উদ্যোগে দেয়াল চিত্রগুলোকে মুছে দিয়েছে। সেখানে অনেক নান্দনিক চিত্র নিয়ে আসা হয়েছে যেমন ফুল, ফল, লতা, পাখি ইত্যাদি। কিন্তু এগুলো আসলে জুলাইয়ের কোনো গ্রাফিতি না।

অতীতের রাজনৈতিক বন্দনা আর তোষামোদের স্লোগান মুছে নতুন যে বার্তা স্থান পেয়েছে দেয়ালে, তা বদলে না ফেলার আহ্বান সবার কণ্ঠে। দেয়ালের এই গ্রাফিতিই অনাগত দিনগুলোতে স্বৈরাচার পতনের রক্তিম দিনের স্মৃতিকে জ্বলজ্বলে করে রাখবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতিআরা নাসরিন বলেন, ‘আমার ধারণা যে ওই যে আমাদের খুব একটা সুশীল ধরনের যে মনোভাব এবং সাধারণ মানুষের মনের ভেতর থেকে যে অনুভূতির প্রকাশ; এটা বোধহয় তারা নিতে পারছিলো না। অভ্যুত্থানেরই তো চিহ্ন, অভ্যুত্থানের চিহ্ন তো আমাদের ধরে রাখার কথা, সেটা কাজ করেনি। তার চেয়েও বেশি কাজ করেছে যে, আমাদের খুব পরিচ্ছন্ন কিছু দেখাতে হবে। এই যে আমরা ইতিহাসকে অস্বীকার করি, এর কিন্তু নানারকম ফলাফল আমরা দেখতে পাই। ইতিহাসটা যেভাবে এসেছে সেভাবে না রেখে, একটা কিছু অন্যরকম চেহারায় আমরা দেখাতে চাই।’

তার ভাষ্য, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টিশীল স্বাতন্ত্র্যকে ধারণ করে সচিত্র দলিল হিসেবে থাকবে শহরের দেয়ালগুলো। বিদ্রোহে-বিপ্লবে জোগাবে অনুপ্রেরণা।

নিউজটি শেয়ার করুন

মুছে ফেলা হয়েছে চব্বিশের গণআন্দোলনের দেয়াল গ্রাফিতি

আপডেট সময় : ১২:৫৪:৩০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ জুলাই ২০২৫

দেয়ালে দেয়ালে মুক্তির বারতা। স্বৈরাচার পতনের লেখনীতে অগ্নিশিখা। চব্বিশের গণআন্দোলনে যেন বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল দেয়ালের গ্রাফিতি। তবে বছর ঘুরতেই প্রতিবাদের অনেক চিহ্ন বদলে গেছে। কোথাও কোথাও মুছে ফেলা হয়েছে গ্রাফিতি। জুলাইয়ের স্পন্দন আর চেতনার গ্রাফিতি বদলে না ফেলার আহ্বান সবার কণ্ঠে।

‘এবার পথে নামো, হাতের মুঠো খুলে প্রতিরোধ হোক শুধু, মানুষের দেখানো বিক্ষোভে’; ‘স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল আসছে’; ‘প্লিজ কেউ কাউকে ছেড়ে যায়েন না’— এসবই জুলাইয়ের দগদগে স্মৃতি। সঙ্গে ছিল ভয়ের সংস্কৃতিকে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়ার প্রত্যয়; দ্রোহ আর প্রতিবাদের বারুদ বিস্ফোরণ; বুলেটের সামনে বুক পেতে দেয়া আর বুলেটবিদ্ধ ঝাঁঝড়া দেহ।

আধিপত্যবাদের নিকষ থাবা থেকে মুক্ত হবার আকাঙ্ক্ষায় জেগেছিল ছাত্র-জনতা। সেই দ্রোহকে বুকে ধারণ করেছিল শহরের দেয়ালও। শেওলা জমা দেয়ালে ঠাঁই পায় প্রতিবাদী লেখনী। শ্রাবণ বিদ্রোহের পটভূমিতে প্রাচীরও যেন হয়ে ওঠে প্রতিবাদের ক্যানভাস। তুলির আঁচড়ে প্রতিবাদী গ্রাফিতি ছড়ায় রক্তিম আভা।

বুলেটের বিপরীতে তারুণ্যের অনুপ্রেরণা ছিল রংতুলি। দেয়ালে দেয়ালে মুক্তির বারতা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তরুণরা। ভয়কে জয় করে তাদের আঁকা গ্রাফিতি অগ্নিশিখা হয়ে জ্বলেছিল গণমানুষের মনে।

গ্রাফিতি আর্টিস্ট ফাইজা ফায়রুজ বলেন, ‘মিছিলের সাথে সাথে ঘুরে গ্রাফিতি আঁকতাম। কারণ যদি একা পায় পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে। গ্রাফিতির যদি কোনো ক্ষমতাই না থাকতো, যদি এটা আসলে কোনো স্টেটমেন্ট না হতো, তাহলে কিন্তু এটা মুছে ফেলার জন্য বা এটা না হতে দেয়ার জন্য এত বড় আয়োজন কখনোই করা হতো না।’

অপর এক গ্রাফিতি আর্টিস্ট রাইয়ান আজমাইন বলেন, ‘রিস্কি কিছু করছে বা হাসিনার বিরুদ্ধে যাচ্ছে কোনো গ্রাফিতি, তখনই তাকে পুলিশ পিকআপে করে তুলে নিয়ে গেছে। এমন অনেক ঘটনাই আমরা পড়েছি। যেমন আমার ঢাকায় গ্রাফিতি করতে ভয় লাগতো যে এই মনে হয় আমাকে তুলে নিয়ে যাবে।’

শিক্ষার্থীরা জানান, মানুষের মনের তীব্র যে আকাঙ্ক্ষাটা তারা সেটা রংতুলির মাধ্যমে তুলে ধরতে পারছে। এটাই একটা বিপ্লব। এই ভাষাটা এমন ছিলো যে, একজন রিকশাচালক হয়তো পড়ছে একটা গালি এটা সেও অনুধাবন করতে পারছে যে সেও এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত।

‘কথা ক, স্বৈরাচার’, ‘স্বৈরাচারের পতন চাই’, ‘হামার ব্যাটাক মারুলু ক্যানে’, ‘বিকল্প কে?-তুমি, আমি, আমরা’— এসব গ্রাফিতি দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ আর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জাগিয়ে তুলেছিল। কিন্তু ২৪-এর জুলাই আন্দোলনের বছর ঘুরতেই মুছে দেয়া হয়েছে অনেক গ্রাফিতি। পোস্টার আর বিজ্ঞাপনের চাপে অনেকটাই দৃষ্টির আড়ালে।

আপত্তিকর শব্দের ধোঁয়া তুলে কোথাও কোথাও মুছে ফেলা হয়েছে গ্রাফিতি। বদলে গেছে উত্তাল জুলাইয়ের ক্রোধের ভাষাও। তবে কি আন্দোলনের স্মারক হিসেবে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে গ্রাফিতি?

গ্রাফিতি আর্টিস্ট রাইয়ান আজমাইন বলেন, ‘ছোট একটা জায়গায় হয়তো হাসিনাকে গালি দিয়ে কিছু লিখা হয়েছে, এখন এই গালিটা মিশিয়ে আমি হয়তো ফুল লতা পাতা টাইপের কিছু একটা করে দিতেই পারি।’

ফাইজা ফায়রুজ বলেন, ‘পরবর্তী একটা আন্দোলন বা অভ্যুত্থান যেটা মানুষ বলছে সেটা হলে তার চিহ্ন আসলে কত দ্রুত মুছে ফেলা যাবে। কিংবা সেসব স্মৃতিচিহ্নকে নিয়ে কে তার স্বার্থ আদায়ের খেলাতে নামবে এটা আসলে খুব শঙ্কাজনক।’

শিক্ষার্থীরা জানান, দেয়াল লিখনগুলো যেভাবে আলোড়িত করে, এখন মুছে ফেলার পর সেট করছে না। ৫ আগস্টের পরে কিছু মানুষ, কিছু সংগঠন তাদের নিজ উদ্যোগে দেয়াল চিত্রগুলোকে মুছে দিয়েছে। সেখানে অনেক নান্দনিক চিত্র নিয়ে আসা হয়েছে যেমন ফুল, ফল, লতা, পাখি ইত্যাদি। কিন্তু এগুলো আসলে জুলাইয়ের কোনো গ্রাফিতি না।

অতীতের রাজনৈতিক বন্দনা আর তোষামোদের স্লোগান মুছে নতুন যে বার্তা স্থান পেয়েছে দেয়ালে, তা বদলে না ফেলার আহ্বান সবার কণ্ঠে। দেয়ালের এই গ্রাফিতিই অনাগত দিনগুলোতে স্বৈরাচার পতনের রক্তিম দিনের স্মৃতিকে জ্বলজ্বলে করে রাখবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতিআরা নাসরিন বলেন, ‘আমার ধারণা যে ওই যে আমাদের খুব একটা সুশীল ধরনের যে মনোভাব এবং সাধারণ মানুষের মনের ভেতর থেকে যে অনুভূতির প্রকাশ; এটা বোধহয় তারা নিতে পারছিলো না। অভ্যুত্থানেরই তো চিহ্ন, অভ্যুত্থানের চিহ্ন তো আমাদের ধরে রাখার কথা, সেটা কাজ করেনি। তার চেয়েও বেশি কাজ করেছে যে, আমাদের খুব পরিচ্ছন্ন কিছু দেখাতে হবে। এই যে আমরা ইতিহাসকে অস্বীকার করি, এর কিন্তু নানারকম ফলাফল আমরা দেখতে পাই। ইতিহাসটা যেভাবে এসেছে সেভাবে না রেখে, একটা কিছু অন্যরকম চেহারায় আমরা দেখাতে চাই।’

তার ভাষ্য, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টিশীল স্বাতন্ত্র্যকে ধারণ করে সচিত্র দলিল হিসেবে থাকবে শহরের দেয়ালগুলো। বিদ্রোহে-বিপ্লবে জোগাবে অনুপ্রেরণা।