ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি

- আপডেট সময় : ০২:০৫:৫৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ৯ জুলাই ২০২৫
- / ৬১২ বার পড়া হয়েছে

দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির কয়লার উপর নির্ভর করে খনির পাশেই ৫২৫ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হলেও এই তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারনেই ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে দেশের একমাত্র কয়লা উৎপাদনকারী এই খনিটি। উৎপাদন খরচের চেয়েও কয়লার দাম কমানোর প্রবণতা, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কাছে বিক্রিত কয়লার প্রায় সাড়ে ৮’শ কোটি টাকা বকেয়া এবং খনির ইয়ার্ডে বিপুল পরিমান কয়লা মজুদের কারনে কয়লা রাখার জায়গা সংকটসহ বিভিন্ন কারনে এক সময়ের লাভজনক এই কয়লা খনিটি বন্ধের উপক্রম হয়েছে।
দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে বানিজ্যিকভাবে কয়লা উত্তোলন শুরু হয় ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে। এই কয়লা খনির কয়লার উপর নির্ভর করেই এক বছর পর ২০০৬ সালে খনির পাশেই গড়ে উঠে বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র। সেই সময় সরকারীভাবে সিদ্ধান্ত হয়, খনির উৎপাদিত কয়লার ৬৫ শতাংশ বিক্রি করা হবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের অধীন বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে এবং বাকী ৩৫ শতাংশ কয়লা বিক্রি করা হবে বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে। উত্তোলন শুরুর সময় থেকেই সরকারের একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিনত হয় দেশের একমাত্র এই কয়লা খনিটি। এরপর ২০১৮ সালে খনির উৎপাদিত শতভাগ কয়লা বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিক্রির সিদ্ধান্ত হওয়ার পর কয়লার ন্যায্য দাম নির্ধারণে প্রতিবন্ধকতা, বিক্রিত কয়লার টাকা অনিয়মিত পরিশোধ ও শত শত কোটি টাকা বকেয়া থাকার কারনে রূগ্ন হতে শুরু সরকারের লাভজনক এই খনিটি। সবশেষ গত বছরের শেষের দিকে কয়লার ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ মন্ত্রানালয়ের সচিবকে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করায় বিক্রেতাই ক্রেতা সেজে যাওয়ায় কয়লার ন্যায্য দাম নিয়ে শুরু হয়েছে আরও জটিলতা। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের সচিব ফারজানা মমতাজকে গত ২০২৪ সালের ৪ নভেম্বর বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া হয়। এরপর উৎপাদন খরচ বিবেচনা না করেই কয়লার দাম কমানোর প্রবণতা।
বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানী লিমিটেড (বিসিএমসিএল) কর্তৃপক্ষ বলছে, কয়লা বিক্রির আয় থেকে বড়পুকুরিয়া খনি কর্তৃপক্ষ কয়লা উত্তোলন, ঠিকাদারের বিল, খনি পরিচালনা ছাড়াও সরকারের রাজস্ব জোগান দেয়। তবে হঠাৎ করে আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম কমানোর অজুহাতে বড়পুকুরিয়া খনির কয়লার দাম কমানোর প্রবণতা খনিটিকে লোকসানের দিকে নিয়ে যাবে।
খনি কর্তৃপক্ষ বলছে, ২০২২ সালের দিকে যখন বড়পুকুরিয়ার কয়লার সমান মানের কয়লার আন্তর্জাতিক বাজারে এফওবি (ফ্রেইড অন বোর্ড) মূল্য প্রতি টন ১৯৬ ডলার থেকে ৪৩০ ডলার পর্যন্ত উঠেছিল, তখনও খনি থেকে প্রতি টন ১৭৬ ডলারেই কিনেছে পিডিবি। এখন হঠাৎ করে ১৭৬ ডলার থেকে কয়লার দাম ১৩০ ডলার বা আরও নিচে নামিয়ে আনতে চায়। বড়পুকুরিয়া কর্তৃপক্ষ বলছে, খনির কয়লার দাম কমিয়ে দেওয়া হলে ভবিষ্যতে কয়লা উত্তোলনসহ খনি পরিচালনা ও খনির উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। নতুন করে জমি অধিগ্রহণসহ পরিকল্পনাসমূহ বাস্তবায়ন হবে না। বড়পুকুরিয়া লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।
জানা গেছে, চলতি বছর ১৯ জানুয়ারি কয়লার বিলম্ব মাশুল এবং কয়লার মূল্য পুনঃনির্ধারণ সংক্রান্ত একটি পর্যালোচনা সভা হয়। সেখান থেকেই মূলত বড়পুকুরিয়ার কয়লার দাম কমানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ লক্ষ্যে সামগ্রিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সুপারিশ করতে গত ৭ এপ্রিল কমিটি গঠন করে দিয়েছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। পেট্রোবাংলার পরিচালককে (অপারেশন/মাইন্স) আহ্বায়ক করে গঠিত ৯ সদস্যর ওই কমিটি কাজ করছে।
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রতি টন কয়লা ১৩০ ডলার করে বিক্রি হতো। কিন্তু ২০২২ সাল থেকে প্রতি টন কয়লা ১৭৬ ডলার নির্ধারণ করা হয়। ২০২২ সালে বিপিডিবি ও বিসিএমসিএলের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী বিসিএমসিএলের কয়লার দাম ২০২৩ সালের ৫ জানুয়ারি ১৭৬ ডলার নির্ধারণ করা হয়। পিছনের তারিখ অর্থাৎ ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে সেটা কার্যকর করে মন্ত্রণালয়। তবে পিডিবি ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত নিয়মিত বিল পরিশোধ করলেও ৪৬ ডলার বাড়তি দামে পরিশোধের বিলম্ব মাশুল মওকুফ করে নিয়েছে। সূত্রে জানা যায়, ইতোমধ্যে বৈঠকে বড়পুকুরিয়ার পাওনা বিলম্ব মাশুল বাবদ ১২২ কোটি ৮৩ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা অবলোপন করেছে জ্বালানি বিভাগ। আরও প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ২৪ কিস্তিতে পরিশোধের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
খনি কর্তৃপক্ষ বলছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে এবং উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি দীর্ঘ ২০ বছর ধরে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। বিদেশি ঠিকাদারের মাধ্যমে কয়লা উত্তোলন করে বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা সরবরাহ করা হয়। পিডিবি খনি থেকে কয়লা কেনার অন্যতম বড় ক্রেতা। কয়লা উত্তোলনসহ বিভিন্ন পর্যায়ে অপারেশনাল খরচ বাদ দিয়ে বিক্রি করে প্রতি টন কয়লায় যে প্রফিট থাকে, সেটা দিয়েই খনি উন্নয়ন ও সামগ্রিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।
খনির একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, পিডিবি কয়লার মূল্য আরও কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে। তবে বাস্তবতা হলো দাম আগে থেকেই গ্রহণযোগ্য ন্যূনতম সীমায় আছে। দাম কমিয়ে দিলে খনিটি লাভজনক অবস্থান থেকে লোকসানে চলে যাবে। এতে খনির কার্যক্রম ব্যাহত হবে। বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকও বলেছেন, দাম কমানো হলে মাইনিং কোম্পানিটি লোকসানে পড়বে।
বিসিএমসিএল ২০১৮ সালের আগে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সরবরাহ করা কয়লার বিক্রয় মূল্যের সঙ্গে অন্যান্য ক্রেতার কাছে সরবরাহ করা কয়লার বিক্রয় মূল্য তুলে ধরে। সেখানে দেখা যায়, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ছাড়া বাইরের ক্রেতাদের কাছে কয়লার বিক্রয় মূল্য বেশি। এ প্রেক্ষিতে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে উত্তোলিত কয়লার প্রকৃত খরচের সঙ্গে বিক্রয় মূল্য নির্ধারণে সভায় উপস্থিত সবাই একমত প্রকাশ করেন। বিসিএমসিএল উল্লেখ করে, খনি থেকে কয়লা উত্তোলন শেষে মাইন ক্লোজ করে দিলে মাইন ক্লোজার প্ল্যান অনুযায়ী আরও অতিরিক্ত ব্যয় যোগ হবে। প্রকৃত উৎপাদন খরচ ও বিক্রয় মূল্যের সঙ্গে এখনও পর্যন্ত যার সামঞ্জস্য করা হয়নি। এ ছাড়াও ২০২৩ সালের ৫ জানুয়ারি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ৩০০ একর জমি অধিগ্রহণের ব্যয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সরবরাহ করা কয়লার বিক্রয় মূল্যের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে টনপ্রতি প্রকৃত উৎপাদন ব্যয় ১৩৯.৭৮ ডলার হলেও ২০২৪-২০২৫, ২০২৫-২০২৬, ২০২৬-২০২৭, ২০২৭-২০২৮ এর অর্থবছরের টনপ্রতি উৎপাদন ব্যয় যথাক্রমে ১৫৬.৯৪, ১৬৫.৮১, ১৬২.১৩, ১৬৯,৭৮ ডলার প্রাক্কলন করা হয়েছে যার গড় মূল্য ১৬৩.৪৪ মার্কিন ডলার।
এই ব্যয়ের সঙ্গে জমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ ব্যয় বাবদ টনপ্রতি ১৩.৪২ ডলার, অনুসন্ধান ব্যয় বাবদ উৎপাদন ব্যয়ের ৭.৫ শতাংশ, ১২.২৬ ডলার এবং ১৫ শতাংশ হারে মুনাফা বাবদ ২৪.৫২ ডলার যোগ করে প্রতি টন কয়লার বিক্রয় মূল্য দাঁড়াবে ২১৩.৬২ ডলার। এসব খরচের সঙ্গে আরও মাইন ক্লোজার কস্ট যুক্ত হবে।
সূত্রে জানা যায়, বিসিএমসিএল আমদানিকৃত কয়লা ও দেশীয় কয়লার মূল্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করে। সেখানে দেখা যায়, আমদানিকৃত কয়লার ক্যালোরিফিক ভ্যালু ৪৫০০-৫০০০ কিলো ক্যালোরি/কেজি যার ময়েশ্চার ২৮-৩৫ শতাংশ। অপরদিকে বড়পুকুরিয়ার উত্তোলিত কয়লার ক্যালোরিফিক ভ্যালু ৬১৩৭ কিলো ক্যালোরি/কেজি যার ময়েশ্চার ৩.৩৯ শাতংশ। অর্থাৎ সবক্ষেত্রেই বড়পুকুরিয়ার কয়লার গুণগত মান বেশি।
এদিকে বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৩টি ইউনিটে মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৫২৫ মেগাওয়াট হলেও কখনই পুরোপুরি উৎপাদন করতে পারেনি এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। ফলে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির উৎপাদিত কয়লাও সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছে না বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এতে খনির ইয়ার্ডে বর্তমানে জমা পড়ে আছে সাড়ে ৪ লাখ টন কয়লা।
২০০৫ সাল থেকে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির সেন্ট্রাল পার্টের কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে। বর্তমানে চতুর্থ চুক্তির আওতায় ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে শুরু করে ২০২৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ৪৫ লাখ মেট্রিক টন কয়লা উত্তোলন করা হবে। গত জানুয়ারি পর্যন্ত বর্তমান চুক্তিতে এ যাবৎ ২৪ দশমিক ৭৩ লাখ মেট্রিক টন কয়লা উত্তোলিত হয়েছে। চতুর্থ চুক্তিতে বছরে আরও বেশি কয়লা উত্তোলন করা হবে।
বিসিএমসিএলের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২৭ সালের পর বর্তমান চুক্তি শেষে অতিরিক্ত প্রায় ২৭ লাখ মেট্রিক টন কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব হবে। যা ২০৩০ সাল পর্যন্ত উত্তোলন করা যাবে। তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৩টি ইউনিট অর্থাৎ মোট ৫২৫ মেগাওয়াট চালু থাকলে বার্ষিক প্রায় ১৫ লাখ টন কয়লার প্রয়োজন হয়। কিন্তু বাস্তবিকভাবে সবসময় ২টি ইউনিট চালু থাকায় বছরে প্রয়োজন হয় প্রায় ৭-৮ লাখ টন। কোনো ইউনিট বন্ধ থাকলে অতিরিক্ত কয়লা কোল ইয়ার্ডে জমা হতে থাকে। এ ছাড়া দেশে বছরে প্রায় ৬৫ লাখ মেট্রিক টন কয়লা ইটভাটায় ব্যবহার হয়ে থাকে। অর্থাৎ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাদেও কয়লার অত্যধিক চাহিদা রয়েছে দেশীয় বাজারে। তবে ২০১৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নিষেধাজ্ঞা থাকায় বর্তমানে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাইরে অন্য ক্রেতাদের কাছে কয়লা বিক্রয় বন্ধ রয়েছে।
বিসিএমসিএল সূত্রে জানা যায়, ২০০১ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত ১ কোটি ১৩ লাখ মেট্রিক টন কয়লা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সরবরাহ করা হয়েছে, বাকি ৩২ লাখ মেট্রিক টন কয়লা অন্য ক্রেতাদের (ইটভাটা, চা শিল্প, গ্লাস শিল্প, প্রাণ গ্রুপ) কাছে সরবরাহ করা হয়েছে। তখন উভয় দামের সাথে সামঞ্চস্য করে খনিটি কিছুটা হলেও লাভজনক ছিলো। কিন্তু বাইরে বন্ধ থাকায় সেই পথটিও বন্ধ হয়ে গেছে।
উল্লেখ্য, বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছে বর্তমানে কয়লা খনির বকেয়া রয়েছে প্রায় সাড়ে ৮’ শ কোটি টাকা।