১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট: জাবিতে গুলি-মরদেহের ইতিহাস

- আপডেট সময় : ০৩:০৭:৩৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ৯ জুলাই ২০২৫
- / ৩৫৫ বার পড়া হয়েছে

শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে সর্বপ্রথম ছাত্রলীগমুক্ত ক্যাম্পাস জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি)। তবে এ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিতে ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার ওপর অনবরত গুলি চালায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ১৮ জুলাই গুলিবিদ্ধ ইয়ামিনকে পুলিশের এপিসি থেকে টেনে হিঁচড়ে নামানোর দৃশ্য দেখে কেঁদেছিল দেশবাসী। আশুলিয়ার মরদেহ পোড়ানোর ঘটনা ইতিহাসে বিরল। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে দেশ স্বৈরাচারমুক্ত হলেও গণঅভ্যুত্থানের পর এখন অনৈক্যের সুর দেখছেন জুলাই যোদ্ধারা।
গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ইয়ামিনের বাবা বলেন, ‘পুলিশ একটা দেখছে যে এপিসিতে নাকি পেছনে কেউ উঠছে। ইয়ামিন গিয়ে নাকি ঠাকনা বন্ধ করতে যাচ্ছে, তখন গাড়ি থেকে পুলিশ নেমে এসে শটগান দিয়ে তার বুকে গুলি করে। এটা পরিকল্পনা যে তাকে বাঁচতে দেবে না। তখন ওরা (পুলিশ) ওখান থেকে না নামিয়ে কয়েকবার করে রাউন্ড দিতে থাকে ওপরে রেখেই। এক ধরনের ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে। যখন দেখছে ছাত্ররা কিছুটা পিছিয়ে গেছে, তখন ওকে ওভাবে ওখানে ফেলে দেয়। পারতপক্ষে ওই ভিডিওটা ইচ্ছাকৃতভাবে রিপিট করতে চাই না। প্রত্যেকের চোখে পানি চলে আসে।’
ওরা ভেবেছিল, ইয়ামিনকে গুলি করলে দমে যাবে আন্দোলন। কিন্তু ইয়ামিনের সাথে পুলিশের এমন বর্বরতা দেখে ক্ষোভে জ্বলে ওঠে ছাত্র-জনতা। রাজপথে নামে লাখো ইয়ামিন। শুধু সাভারেই ১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত শহীদ হন প্রায় ৫০ জন।
জুলাই আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আরেক বেদনার উপাখ্যান হয়ে আছে সাভারের শ্রাবণ গাজী।
সাভার ডেইরিতে শ্রাবণের শহীদের কবরের পাশেই কথা হচ্ছিলো তার মায়ের সঙ্গে। বলছিলেন, মালয়েশিয়ার সফটওয়ার প্রকৌশল পড়া শ্রাবণের বার্ষিক ছুটি পড়েছিল উত্তাল জুলাইয়ের ঠিক মাঝামাঝিতেই। বিদেশে পড়াশোনা করা ওই যুবক ঘরেই থাকতে পারতেন, কিন্তু রক্তিম জুলাইয়ের আহ্বান তা হতে দেয় নি। পুরো জুলাই জুড়ে তো ছিলেনই, শামিল হয়েছিলেন অভ্যুত্থান দিনের শহীদি মিছিলে।
শহীদ শ্রাবণের মা বলেন, ‘এত সুখের সংসার আমার একটা গুলির আঘাতে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। আমরা এখন ঘরের মধ্যে ভালোমতো থাকতে পারি না। যেদিকে তাকাই সেদিকেই তো বসে থাকতো।’
মূলত ৫ আগস্ট চরম ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি হয় ঢাকার এই প্রবেশ পথে। পুলিশের ব্যারিকেড ও মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে কয়েকশ’ মানুষ জড়ো হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে, যা একটা সময় রূপ নেয় জনস্রোতে। শপথ নিয়ে ঢাকা অভিমুখে দ্রোহের যাত্রা শুরু হয় বেলা ১১টার পর। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অংশ নেয় অসংখ্য গার্মেন্টস শ্রমিক। বিপরীতে অস্ত্র-গোলাবারুদ নিয়ে গণমানুষকে রুখে দিতে মরিয়া স্বৈরাচারের সহযোগীরা।
জাবি শিক্ষার্থী সোহাগী সামিয়া বলেন, ‘প্রতিটি এলাকায় মানুষ অপেক্ষা করছে কখন জাহাঙ্গীরনগরের মিছিল আমাদের সামনে দিয়ে যাবে তখন সেখানে যুক্ত হবো। এক পর্যায়ে আমরা পাকিজা পর্যন্ত যাওয়ার পর অনর্বরত গুলিবর্ষণ শুরু হয়। আমার ঠিক এক হাত সামনে একটা ছেলের ঘাড়ে গুলি লাগে, সে ওখানে পড়ে যায়। আমার হাতে স্লোগানের মাইক। কিছু মানুষ একদম আমার গা ঘেঁষেই শ্রাবণ গাজীকে কোলে করে নিয়ে যাচ্ছে।’
জাবি পরিবেশ বিজ্ঞানের অধ্যাপক মো. জামাল উদ্দিন রুনু বলেন, ‘প্রায় নয় থেকে দশজন শিক্ষক হাত তুলে পুলিশদের নিবৃত করার চেষ্টা করে কিন্তু পুলিশরা সেই মিছিলে নির্বিচারে টিয়ার গ্যাস, গুলিসহ অনেক ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে।’
সেদিনই সাভারের আশুলিয়ায় ঘটে যায় হৃদয় বিদারক আরেক ঘটনা। পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারানো পাঁচজনের মরদেহ এবং গুরুতর একজনকে ভ্যানে তুলে পুড়িয়ে ফেলা হয় পেট্রোল ঢেলে। বর্বরোচিত ঘটনার সাক্ষী হয় বিশ্ব।
সাভার অঞ্চলে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল এর ২০ দিন আগে। ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্বঘোষিত মশাল মিছিলে হামলা করে ছাত্রলীগ। হামলার মুখে শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন। পরে সেখানেও হামলা চালায় ছাত্রলীগ ও বহিরাগত অস্ত্রধারীরা। পরদিন শিক্ষার্থীরা একজোট হয়ে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করে ছাত্রলীগকে। ছাত্রলীগমুক্ত ক্যাম্পাস হিসেবে প্রথম নাম লেখায় জাহাঙ্গীরনগর।
জাবি শিক্ষার্থী মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘যখন নারীদের ওপর আঘাত হানতে তারা দ্বিধাবোধ করে না তখন ক্যাম্পাসের সব শিক্ষার্থী ফুঁসে ওঠে।’
শিক্ষার্থী আব্দুর রশিদ জিতু বলেন, ‘সে সময় প্রশাসন তো হামলার উপযুক্ত জবাব তো দেননি। বরং আশেপাশের সন্ত্রাসীদের ভাড়া করে এনে এবং পুলিশ প্রশাসন এনে ছাত্রলীগ সহকারে আমাদের ওপর একটা নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়।’
সম্প্রতি ১৫ জুলাইকে ‘কালরাত’ হিসেবে ঘোষণা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে গণঅভ্যুত্থানের একবছর পর নতুন বাংলাদেশ গড়ার কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন কতটা পূরণ হলো? প্রশ্ন ছিল তাদের কাছে।
শহীদ ইয়ামিনের বাবা বলেন, ‘বলা হয়েছিল, আমরা ভারতের আধিপত্য মানি না, আমরা স্বৈরাচারের কোনো কথায় আমরা থেমে থাকবো না। এ জায়গায় আমরা সবাই একমত ছিলাম। কিন্তু এখন এই নির্বাচনের নামে এক ধরনের ম্যাকানিজম হচ্ছে যে কীভাবে স্বৈরাচার আবার ফিরে আসতে পারে।’
আব্দুর রশিদ জিতু বলেন, ‘আমাদের ক্যাম্পাসের কর্তৃত্বমূলক যে জায়গাগুলো আছে সেখানে কিন্তু জাতীয়তাবাদী শিক্ষক সমিতির যারা ছিলেন এবং বিএনপপন্থী যারা ছিলেন তারাই কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে অবস্থান নিয়েছেন।’
অধ্যাপক মো. জামাল উদ্দিন রুনু বলেন, ‘যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন আমরা মাঠে গড়িয়েছিলাম ২৪ এর জুলাইতে। আজ এসে কিন্তু আমরা হতাশ, আমরা দেখতে পাচ্ছি অনৈক্যের সুর।’
তারা বলছেন, জুলাইয়ের মতো জনতার ঐক্য ধরে রাখতে পারলে সুন্দর বাংলাদেশ পাবে নতুন প্রজন্ম।