বছরজুড়ে বাজারে উত্তাপ ছড়িয়েছে দ্রব্যমূল্যের দাম
- আপডেট সময় : ০৫:৫৭:৩২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩
- / ৪২৫ বার পড়া হয়েছে
বিদায়ী বছরে থেকে প্রায় পুরো সময়েই বাজারে উত্তাপ ছড়িয়েছে দ্রব্যমূল্যের দাম। হঠাৎ করেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, মাছ, মাংস, ডিম ও শাক-সবজির দাম বেড়ে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। একপর্যায়ে ডিম, আলু ও পেঁয়াজের দামও নির্ধারণ করে দিতে হয়েছে সরকারকে। এরপরও বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। একমাত্র দাওয়াই হিসেবে সামনে এসেছে আমদানি। আমদানির পর দাম কিছুটা কমলেও স্বস্তি মেলেনি সাধারণ মানুষের। তবে বর্তমানে শীতকালীন সবজি বাজারে আসায় এবং ঘোষণা দিয়ে গরুর মাংসের কেজিপ্রতি দাম ২০০ টাকা কমানোয় কিছুটা স্বস্তি মিলেছে সাধারণ মানুষের।
চলতি বছর অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক আলোচনায় ছিল ডিম। আগস্টের মাঝামাঝি ডিমের দাম ছিল সর্বোচ্চ। এ সময় প্রতি ডজন ডিম বাজারে বিক্রি হয়েছে ১৪৫ থেকে ১৮০ টাকায়। অর্থাৎ, একটি ডিম কিনতে ভোক্তার খরচ হয়েছে প্রায় ১৫ টাকা।
ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে গত সেপ্টেম্বরে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রতি পিস ডিমের দাম ১২ টাকা নির্ধারণ করে দেয় সরকার। তবে অভিযোগ রয়েছে, বাজারে এই দাম কার্যকর করতে পারেনি সরকার। নিরুপায় হয়ে ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। বাজার নিয়ন্ত্রণে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে তিন ধাপে ১৫টি প্রতিষ্ঠানকে ১৫ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ডিম আমদানির খবরে বাজারে দাম কিছু্টা কমে। তবে অনুমোদনের প্রায় দুই মাস পরও নানা জটিলতায় ডিম আমদানি করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে বাজারে আবারও দাম বাড়ে।
অবশেষে নভেম্বরের শুরুতে অনুমোদনের প্রায় দুই মাস পর ভারত থেকে ৬২ হাজার ডিমের প্রথম চালান দেশে আসে। সরকার বাজারে প্রতি পিস ডিমের দাম ১২ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও ভারত থেকে আসা প্রতি পিস ডিম আমদানিতে আমদানিকারকের খরচ হয় ৭ টাকা ৯ পয়সা। এরপর ডিমের দাম কমতে শুরু করে। সবশেষ বাজারে প্রতি ডজন ডিম পাওয়া যাচ্ছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায়।
দাম বৃদ্ধির জন্য আলোচনায় ছিল আলুও। দেশি আলুর দাম ৮০ টাকা ছাড়িয়ে গেলে টনক নড়ে সবার। শেষে আলুর দামও নির্ধারণ করে দেয় সরকার। খুচরায় ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা, আর হিমাগারে ২৬ থেকে ২৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
এই দাম কার্যকরে মাঠে নামতে হয় আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টদের। তবে এই দামও কার্যকর করা যায়নি। নিরুপায় হয়ে অক্টোবরের শেষে ডিমের মতো আলুও আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। তবে আলু আমদানি শুরু হলেও এখনো বাজারে এর প্রভাব পড়েনি। এখনো প্রতি কেজি আলু কিনতে গুনতে হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা।
বাজারে উত্তাপ ছড়িয়েছে পেঁয়াজও। দেশি পেঁয়াজের দাম বাড়তে থাকায় সরকার চলতি বছরের জুনে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেয়। তবে আগস্টে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করায় দেশটি থেকে পেঁয়াজ আমদানি কমে যায়। ভারতীয় পেঁয়াজই কিনতে হয়েছে শত টাকায়। আমদানিকারকেরা বিকল্প উৎস থেকে পেঁয়াজ আমদানির আগ্রহ দেখালে সরকার বাজার স্থিতিশীল রাখতে ভারত ছাড়া আরও ৯ দেশ থেকে আমদানির অনুমতি দেয়। এই প্রথম ঢেউয়ের পর শীতের শুরুতেই পেঁয়াজের বাজারে আবার আগুন লাগে। গত ১০ ডিসেম্বর পেঁয়াজের কেজি ২০০ টাকা ছাড়িয়ে যায় মাত্র একদিনের ব্যবধানে।
পরে আবারও আমদানি করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার পথে হাঁটে প্রশাসন। পাশাপাশি ভোক্তা অধিকার, বাজার মনিটরিং কমিটিসহ সংশ্লিষ্ট নানা বিভাগের তরফ থেকে বাজার নিয়ন্ত্রণে অভিযানে নামতে হয়। এতে কাজ হয়। দেখা যায় ম্যাজিস্ট্রেটকে দেখেই কেজিতে পেঁয়াজের দাম ৮০ টাকা পর্যন্ত নেমে গেছে। বর্তমানে প্রতি কেজি বিদেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ টাকায়। আর দেশি পেঁয়াজ ১১৫ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বছরের শেষদিকে এসে সবজির বাজারও আলোচনায় চলে আসে। দেখা গেছে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে কোনো সবজিই ৮০–১০০ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না। এই অস্থিতিশীলতা বেশ কিছুদিন বহাল ছিল। পরে শীতকালীন সবজি বাজারে আসায় বাজারে কিছুটা স্বস্তি ফেরে।
বছরের শুরুতে মাংসের দামে ছিল অস্থিতিশীলতা। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির মাংসের দাম আড়াই শ টাকা পর্যন্ত ওঠে। আর গরুর মাংসের দাম ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা পর্যন্ত ওঠে। তবে বছর শেষে মাংসের বাজারে স্তস্তি ফিরেছে। বাজারে বর্তমানে ব্রয়লার মুরগির মাংস প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকায়।
আর গরুর মাংসের কেজি ঘোষণা দিয়ে ২০০ টাকা কমানোর পর বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকা। তবে কোথাও কোথাও আবার ৫৫০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে।
এ ছাড়া তেল-চিনির দাম বাড়ার পর সেই অবস্থায়ই আছে। খোলা তেল বিক্রি বন্ধের পর ভোগান্তিতে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। বোতলজাত প্রতি লিটার তেল কিনতে হচ্ছে ২০০ টাকায়। আর চিনির দাম প্রতি কেজি ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা।
দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়লেও এর কোনো সুবিধা পান না প্রান্তিক চাষীরা। পুরো মুনাফাই লুফে নেন মধ্যস্বত্বভোগী ও মজুতদারেরা।
এদিকে বছরজুড়ে দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি নিয়ে তোপের মুখে ছিলেন সরকারের মন্ত্রী ও দায়িত্বশীলরা। এ নিয়ে সংসদেও তুমুল সমালোচনার স্বীকার হন মন্ত্রীরা। বাজার সিন্ডিকেটের কাছে নিজের অসহায়ত্বের কথা অকপটে স্বীকার করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। গত জুনে সংসদে বাজেট অধিবেশনে সমালোচনার মুখে তিনি বলেন, ‘বড় গ্রুপগুলোকে জেল-জরিমানা করা যায়। কিন্তু তাতে হঠাৎ যে সংকট তৈরি হবে, তা সইতে কষ্ট হবে। মন্ত্রণালয় আলোচনার মাধ্যমে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে।’
সংসদে ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেওয়ার অভিযোগও ওঠে বাণিজ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। তবে তিনি এই অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী চাইলে তিনি পদত্যাগ করবেন।’ এরপর অবশ্য তিনি বেশ কয়েকবার বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন, বাজার সিন্ডিকেট ভাঙার চেষ্টা চলছে।
সিন্ডিকেট নিয়ে গত অক্টোবরে সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘কোল্ড স্টোরেজ মালিকেরা সিন্ডিকেট করে আলুর দাম বাড়াচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। কিন্তু পরিস্থিতি এমন যে কোল্ড স্টোরেজ মালিকেরা আলু বের করেন না, তারা আলু লুকিয়ে রাখেন।’
সব মিলিয়ে বছরজুড়েই নিত্যপণ্যের বাজারদর ছিল আলোচনায়। এর সাথে সঙ্গতি রেখেই বারবার উচ্চারিত হয়েছে ‘সিন্ডিকেট’ শব্দটি। বাণিজ্যমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রীসহ সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের মুখে বারবারই এসেছে এই শব্দ। এসেছে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের প্রতিশ্রুতিও। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। বছরের শেষভাগে পেঁয়াজের ডবল সেঞ্চুরি বলে দেয়, কথিত ‘সিন্ডিকেট’ একনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে। প্রতিবারই এই সিন্ডিকেট সামাল দিতে জেরবার সরকার সংশ্লিষ্ট পণ্য আমদানির মাধ্যমেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এটি স্থায়ী কোনো সমাধান আনেনি। সামনের বছর কী হবে তা–ই এখন দেখার বিষয়।