০৯:৩৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

২০২৩ : বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনা চ্যালেঞ্জ

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন। কৃষি বাজার উন্মুক্তকরণ, দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়ণ, কুটির শিল্পের উন্নতি, ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ, বৈদেশিক বিনিয়োগ, দক্ষ জনশক্তি, দেশে দেশে অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরিতে অর্থায়নের মাধ্যমে কয়েক দশক ধরে টেকসই সমৃদ্ধি ধরে রেখেছে চীন। যেকোনো বিবেচনাতেই বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি চীন, যা আমেরিকাসহ গোটা পশ্চিমকে অস্বস্তিতে রেখেছে। পশ্চিমাদের সামনে চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি বহুদিন ধরেই এক বড় চ্যালেঞ্জ, যার জয়–পরাজয় বৈশ্বিক নেতৃত্বেও বড় ওলট–পালট করে দিতে পারে।

চীন বর্তমানে পৃথিবীর এক নম্বর রপ্তানিকারক দেশ; আমদানিতে দ্বিতীয়। ২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক ধাক্কা কাটিয়ে নতুন করে পথ চলতে শুরু করলেও করোনা ধাক্কায় হিমশিম খেতে হয়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির এ দেশকে। তারপরও বিশ্ববাজারে চীনের রয়েছে অনেকটা একচেটিয়া প্রভাব। বিশ্ববাণিজ্যের সিংহভাগ চীনের দখলে। ফলে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ অর্থনৈতিক বাজার দখলে চীনা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। আবার কোভিডকালে চীনা অর্থনীতিতে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তার প্রভাব বিশ্বের ওপর পড়ছে। ফলে চীনের উত্থান ও পতন—দুইই গোটা বিশ্বের দুর্ভাবনার কারণ।

গত শতকের আশির দশকে চীন গ্রামীণ অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতিতে প্রবেশ করে। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের এক হিসাবে দেখা যায়, ১৯৭৮ সালে চীনের মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১ হাজার কোটি মার্কিন ডলার, যা ছিল বিশ্ববাণিজ্যের ১ শতাংশেরও কম। আর দুই দশকেরও কম সময় পর এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৪ ট্রিলিয়ন (লাখ কোটি) ডলারে। পণ্য রপ্তানির বিচারে চীন পরিণত হয় বিশ্বের বৃহত্তম দেশে।গত ৩০ বছর ধরে গড়ে ১০ শতাংশ মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যা আর কোনো দেশের পক্ষেই সম্ভব হয়নি।

এরপর সবচেয়ে বড় ধাক্কা এসেছে ২০০৮-০৯ সালের দিকে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে। বৈশ্বিক মন্দার পর চীনা অর্থনীতি বেড়েছে মাত্র চারগুণ। এর বিপরীতে ঋণ বেড়েছে ৯ গুণ। প্রবৃদ্ধি উচ্চ রাখতে গিয়ে ২০১০-এর দশকে দেশটিতে অবকাঠামো ও সম্পত্তির ওপর বিনিয়োগ দুগুণ কমে গেছে। ফলে নির্মাণ ও শিল্পখাতে কর্মসংস্থান স্থবির হয়ে পড়ে। বেড়েছে বেকারত্ব। অনেক তরুণ স্নাতক পাস করে বসে আছে। কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারছে না।

এর সঙ্গে ২০২০ সালে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’র মতো শীরে সংক্রান্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় করোনা মহামারি। স্বাভাবিকভাবেই সেই মহামারি অর্থনৈতিক সংকটকে আরও বাড়িয়ে দেয়। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, এ বছর অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা কঠিন হবে।

চীনের এ পরিস্থিতিতে কাঁচা ঘায়ে নুন দিতে বাদ দেননি পশ্চিমারা। অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীনকে নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তবে এ সমালোচনা আমলে নিতে নারাজ চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।

কথা হলো—গোটা বিশ্বের অর্থনীতিবিদেরা চীন নিয়ে কেন চিন্তিত? এ বিষয়ে আটলান্টিক কাউন্সিলের সিনিয়র ফেলো জোসেফ ওয়েবস্টার দ্য ডিপ্লোমেটে লিখেছেন, চীনের অর্থনৈতিক সংকট গোটা বিশ্বেই মন্দার ঝুঁকি তৈরি করছে। বিশেষত রপ্তানি বাজারে বড় ধরনের সংকট তৈরি করছে। চীনা পণ্যের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলো রয়েছে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে।

দ্য ডিপ্লোমেটে লেখা নিবন্ধে জোসেফ পরিষ্কার বলেছেন, চীনের অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব সব ক্ষেত্রেই এখন দৃষ্টিগ্রাহ্য। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও এর বড় প্রভাব পড়বে। বিশেষত রাশিয়াকে চীন এখনো যে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে, তাতে বদল আসতে পারে। চীন হয়তো মস্কোকে ইউক্রেন ইস্যুতে আলোচনায় বসতে চাপ দিতে পারে। শুধু তাই নয়, পররাষ্ট্রনীতিতেও আরও নরম হতে পারে বেইজিং। তেমনটি হলে বহু দেশের বহু নীতিতেই বদল আসতে বাধ্য। এদিকে তাইওয়ানে চীনের চাপ আরও বাড়তে পারে।

একই সঙ্গে অর্থনীতিবিদেরা এও বলছেন, চীনের অর্থনীতি ধীরগতিতে চললে এবং পুনরুদ্ধার কর্মসূচি সফল না হলে মাঝারি ধরনের মন্দার মুখোমুখি হতে পারে আমেরিকা। ফলে বিশ্বের বড় দুই অর্থনীতিতে হওয়া ধকল বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিশ্বজুড়ে যেসব পণ্য বিক্রি হয়, তার একটা বড় অংশ আসে চীন থেকে। যদি চীনের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় মূল্য-সংকোচন দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে সেটা অন্যান্য দেশের জন্য সুফল এবং কুফল—দুটিই বয়ে আনতে পারে। তখন অন্যান্য দেশ তুলনামূলক কম দামে চীনের পণ্য কিনতে পারবে, যেটা সেসব দেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে। আর খারাপ দিক হতে পারে, সেসব দেশের উৎপাদকদের এটা হুমকিতে ফেলবে।

বিভিন্ন দেশের বাজারে কম দামে চীনা পণ্য বিক্রি বেড়ে গেলে স্থানীয় উৎপাদক থেকে ব্যবসায়ী—সবার জন্যই তা বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ কমবে, যার সরাসরি প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থানের ওপর। সেক্ষেত্রে বেকারত্ব বেড়ে যেতে পারে। আবার চীনের বাজারে চাহিদা কমলে বিশ্বের রপ্তানি খাতেও এর আঘাত এসে পড়বে।

অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বেইজিং কৌশলগত পরিকল্পনা নিয়েছে। পরিমাণগত বৃদ্ধির চেয়ে গুণগত বৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে চীন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স, সেমিকন্ডাক্টর, ইত্যাদি বিষয়ে প্রভাবশালী হওয়ার জন্য একটি কৌশলী পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে দেশটি। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ও ফাইভ–জি প্রযুক্তির বাজার দখলের প্রতিযোগিতায় নেমেছে তারা। এ ছাড়া তারা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সব প্রস্তুতিই শেষ করেছে। ফলে সিলিকন ভ্যালির মাথাব্যাথ্যা বাড়বে বৈ কমবে না।

চীনের মোট সম্পদের এক–তৃতীয়াংশ ছিল আবাসন খাতে। গত দুই দশক ধরে চীনের এ খাত ফুলে-ফেঁপে উঠছে, বিশেষ করে বেসরকারিকরণের ফলে। কিন্তু ২০২০ সালে এই খাতে সংকট দেখা দেয়। কোভিড মহামারি, তার সঙ্গে চীনের কমতে থাকা জনসংখ্যা- এর কোনোটিই এই খাতের জন্য সুসংবাদ ছিল না। চীনের সরকার তখন এই সংকট থেকে পুরো অর্থনীতিতে বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছিল, যেমনটি ঘটেছিল ২০০৮ সালে আমেরিকায়।আবাসন, ব্যক্তিগত গাড়ি ইত্যাদির মতো স্থাবর সম্পত্তিতে অত্যধিক ঋণপ্রবাহের কারণেই ২০০৮–এর মন্দা শুরু হয়েছিল। ঠিক সেই সময় চীন এ খাতেই বিনিয়োগ উন্মুক্ত করে বাজারে অর্থপ্রবাহ ঠিক করেছিল, যা এখন তাদের জন্য বুমেরাং হয়েছে।

এখন চীনে নতুন বাড়ি-ঘরের চাহিদায় ধস নেমেছে, আর এর ফলে বাড়ি-ঘরের দামও সাংঘাতিকভাবে পড়ে গেছে। এর মানে হচ্ছে, চীনে যারা বাড়ির মালিক, তারা আগের চেয়ে গরিব হয়ে পড়েছে। এখন এই খাত বড় সংকটে। আবাসন শিল্পের এই সংকট কাটতে বহু বছর সময় লাগবে। ফলে বিশ্বব্যাপী অবকাঠামো খাতে চীনের যে বিনিয়োগ রয়েছে সেগুলোতে আসতে পারে বড় রকমের ধাক্কা। যার সঙ্গে জড়িয়ে পড়বে কূটনৈতিক সম্পর্কও।

সম্প্রতি ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের অর্থনীতির আকার ২০৩১ সালের মধ্যে আমেরিকাকে অতিক্রম করবে। এর মধ্য দিয়ে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার ক্ষমতা কাঠামোতেও পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। ইউরোপ-আমেরিকা প্রভাবিত বর্তমান বিশ্বকাঠামোর প্রতি চীন ইতোমধ্যে অনেক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। চীন অবশ্য এর জন্য আমেরিকাকেই দোষারোপ করছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের সঙ্গে যে বাণিজ্যিক সংঘর্ষের সূত্রপাত করেছিলেন, তা বাইডেন প্রশাসনও বহাল রেখেছে। এর লক্ষ্য যে চীনের উত্থান ঠেকানো, তা সহজেই বোধগম্য। কিন্তু চীনের উত্থান যে পশ্চিমা ও সেই সঙ্গে চীনের প্রতিবেশী দেশগুলোতে ভীতির সঞ্চার করেছে, তাও অস্বীকার করা যাবে না।

চীন হয়তো বিশ্ব অর্থনীতির এক বিরাট চালিকাশক্তি। আর এর পেছনে রয়েছে দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্টের নেওয়া কিছু অর্থনৈতিক নীতি। শি তাঁর ওই নীতিতে স্পষ্টভাবে চাইছিলেন—চীনা অর্থনীতি আরও গতিশীল, প্রাণবন্ত, শক্তিশালী এবং উদ্ভাবনী হোক। তবে দীর্ঘ যাত্রার পর ওই নীতিগুলো ইদানীং প্রায়ই বিপরীত প্রভাব ফেলছে।

চীনের নয়া অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণের সময়েই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ভবিষ্যদ্বাণী ছিল—চীন আগামী পাঁচ বছরে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সবচেয়ে বড় চালক হতে যাচ্ছে। চীন একাই বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির প্রায় ২২ দশমিক ৬ শতাংশ অবদান রাখবে, যেখানে আমেরিকা রাখবে মাত্র ১১ দশমিক ৩ শতাংশ।

বর্তমানে চীনের প্রতিরক্ষা বাজেট ১৭৭ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার খরচ করে, যা প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেটের তুলনায় অন্তত তিনগুণ বেশি। এই হারে বাড়তে থাকলে চীনের প্রতিরক্ষা বাজেট ২০০ বিলিয়নে গিয়ে ঠেকবে, যা হবে মার্কিন প্রতিরক্ষা বাজেটের কাছাকাছি। এর ফলে বিশ্ব নেতৃত্বের হাতবদল বা নতুন করে মেরুকরণ শুরু হতে পারে। পাল্টে যেতে পারে ভূ-রাজনৈতিক চিত্রপট।

শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে: আইন উপদেষ্টা

২০২৩ : বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনা চ্যালেঞ্জ

আপডেট : ১০:০২:২৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৩

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন। কৃষি বাজার উন্মুক্তকরণ, দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়ণ, কুটির শিল্পের উন্নতি, ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ, বৈদেশিক বিনিয়োগ, দক্ষ জনশক্তি, দেশে দেশে অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরিতে অর্থায়নের মাধ্যমে কয়েক দশক ধরে টেকসই সমৃদ্ধি ধরে রেখেছে চীন। যেকোনো বিবেচনাতেই বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি চীন, যা আমেরিকাসহ গোটা পশ্চিমকে অস্বস্তিতে রেখেছে। পশ্চিমাদের সামনে চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি বহুদিন ধরেই এক বড় চ্যালেঞ্জ, যার জয়–পরাজয় বৈশ্বিক নেতৃত্বেও বড় ওলট–পালট করে দিতে পারে।

চীন বর্তমানে পৃথিবীর এক নম্বর রপ্তানিকারক দেশ; আমদানিতে দ্বিতীয়। ২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক ধাক্কা কাটিয়ে নতুন করে পথ চলতে শুরু করলেও করোনা ধাক্কায় হিমশিম খেতে হয়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির এ দেশকে। তারপরও বিশ্ববাজারে চীনের রয়েছে অনেকটা একচেটিয়া প্রভাব। বিশ্ববাণিজ্যের সিংহভাগ চীনের দখলে। ফলে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ অর্থনৈতিক বাজার দখলে চীনা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। আবার কোভিডকালে চীনা অর্থনীতিতে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তার প্রভাব বিশ্বের ওপর পড়ছে। ফলে চীনের উত্থান ও পতন—দুইই গোটা বিশ্বের দুর্ভাবনার কারণ।

গত শতকের আশির দশকে চীন গ্রামীণ অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতিতে প্রবেশ করে। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের এক হিসাবে দেখা যায়, ১৯৭৮ সালে চীনের মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১ হাজার কোটি মার্কিন ডলার, যা ছিল বিশ্ববাণিজ্যের ১ শতাংশেরও কম। আর দুই দশকেরও কম সময় পর এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৪ ট্রিলিয়ন (লাখ কোটি) ডলারে। পণ্য রপ্তানির বিচারে চীন পরিণত হয় বিশ্বের বৃহত্তম দেশে।গত ৩০ বছর ধরে গড়ে ১০ শতাংশ মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যা আর কোনো দেশের পক্ষেই সম্ভব হয়নি।

এরপর সবচেয়ে বড় ধাক্কা এসেছে ২০০৮-০৯ সালের দিকে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে। বৈশ্বিক মন্দার পর চীনা অর্থনীতি বেড়েছে মাত্র চারগুণ। এর বিপরীতে ঋণ বেড়েছে ৯ গুণ। প্রবৃদ্ধি উচ্চ রাখতে গিয়ে ২০১০-এর দশকে দেশটিতে অবকাঠামো ও সম্পত্তির ওপর বিনিয়োগ দুগুণ কমে গেছে। ফলে নির্মাণ ও শিল্পখাতে কর্মসংস্থান স্থবির হয়ে পড়ে। বেড়েছে বেকারত্ব। অনেক তরুণ স্নাতক পাস করে বসে আছে। কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারছে না।

এর সঙ্গে ২০২০ সালে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’র মতো শীরে সংক্রান্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় করোনা মহামারি। স্বাভাবিকভাবেই সেই মহামারি অর্থনৈতিক সংকটকে আরও বাড়িয়ে দেয়। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, এ বছর অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা কঠিন হবে।

চীনের এ পরিস্থিতিতে কাঁচা ঘায়ে নুন দিতে বাদ দেননি পশ্চিমারা। অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীনকে নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তবে এ সমালোচনা আমলে নিতে নারাজ চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।

কথা হলো—গোটা বিশ্বের অর্থনীতিবিদেরা চীন নিয়ে কেন চিন্তিত? এ বিষয়ে আটলান্টিক কাউন্সিলের সিনিয়র ফেলো জোসেফ ওয়েবস্টার দ্য ডিপ্লোমেটে লিখেছেন, চীনের অর্থনৈতিক সংকট গোটা বিশ্বেই মন্দার ঝুঁকি তৈরি করছে। বিশেষত রপ্তানি বাজারে বড় ধরনের সংকট তৈরি করছে। চীনা পণ্যের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলো রয়েছে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে।

দ্য ডিপ্লোমেটে লেখা নিবন্ধে জোসেফ পরিষ্কার বলেছেন, চীনের অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব সব ক্ষেত্রেই এখন দৃষ্টিগ্রাহ্য। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও এর বড় প্রভাব পড়বে। বিশেষত রাশিয়াকে চীন এখনো যে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে, তাতে বদল আসতে পারে। চীন হয়তো মস্কোকে ইউক্রেন ইস্যুতে আলোচনায় বসতে চাপ দিতে পারে। শুধু তাই নয়, পররাষ্ট্রনীতিতেও আরও নরম হতে পারে বেইজিং। তেমনটি হলে বহু দেশের বহু নীতিতেই বদল আসতে বাধ্য। এদিকে তাইওয়ানে চীনের চাপ আরও বাড়তে পারে।

একই সঙ্গে অর্থনীতিবিদেরা এও বলছেন, চীনের অর্থনীতি ধীরগতিতে চললে এবং পুনরুদ্ধার কর্মসূচি সফল না হলে মাঝারি ধরনের মন্দার মুখোমুখি হতে পারে আমেরিকা। ফলে বিশ্বের বড় দুই অর্থনীতিতে হওয়া ধকল বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিশ্বজুড়ে যেসব পণ্য বিক্রি হয়, তার একটা বড় অংশ আসে চীন থেকে। যদি চীনের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় মূল্য-সংকোচন দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে সেটা অন্যান্য দেশের জন্য সুফল এবং কুফল—দুটিই বয়ে আনতে পারে। তখন অন্যান্য দেশ তুলনামূলক কম দামে চীনের পণ্য কিনতে পারবে, যেটা সেসব দেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে। আর খারাপ দিক হতে পারে, সেসব দেশের উৎপাদকদের এটা হুমকিতে ফেলবে।

বিভিন্ন দেশের বাজারে কম দামে চীনা পণ্য বিক্রি বেড়ে গেলে স্থানীয় উৎপাদক থেকে ব্যবসায়ী—সবার জন্যই তা বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ কমবে, যার সরাসরি প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থানের ওপর। সেক্ষেত্রে বেকারত্ব বেড়ে যেতে পারে। আবার চীনের বাজারে চাহিদা কমলে বিশ্বের রপ্তানি খাতেও এর আঘাত এসে পড়বে।

অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বেইজিং কৌশলগত পরিকল্পনা নিয়েছে। পরিমাণগত বৃদ্ধির চেয়ে গুণগত বৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে চীন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স, সেমিকন্ডাক্টর, ইত্যাদি বিষয়ে প্রভাবশালী হওয়ার জন্য একটি কৌশলী পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে দেশটি। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ও ফাইভ–জি প্রযুক্তির বাজার দখলের প্রতিযোগিতায় নেমেছে তারা। এ ছাড়া তারা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সব প্রস্তুতিই শেষ করেছে। ফলে সিলিকন ভ্যালির মাথাব্যাথ্যা বাড়বে বৈ কমবে না।

চীনের মোট সম্পদের এক–তৃতীয়াংশ ছিল আবাসন খাতে। গত দুই দশক ধরে চীনের এ খাত ফুলে-ফেঁপে উঠছে, বিশেষ করে বেসরকারিকরণের ফলে। কিন্তু ২০২০ সালে এই খাতে সংকট দেখা দেয়। কোভিড মহামারি, তার সঙ্গে চীনের কমতে থাকা জনসংখ্যা- এর কোনোটিই এই খাতের জন্য সুসংবাদ ছিল না। চীনের সরকার তখন এই সংকট থেকে পুরো অর্থনীতিতে বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছিল, যেমনটি ঘটেছিল ২০০৮ সালে আমেরিকায়।আবাসন, ব্যক্তিগত গাড়ি ইত্যাদির মতো স্থাবর সম্পত্তিতে অত্যধিক ঋণপ্রবাহের কারণেই ২০০৮–এর মন্দা শুরু হয়েছিল। ঠিক সেই সময় চীন এ খাতেই বিনিয়োগ উন্মুক্ত করে বাজারে অর্থপ্রবাহ ঠিক করেছিল, যা এখন তাদের জন্য বুমেরাং হয়েছে।

এখন চীনে নতুন বাড়ি-ঘরের চাহিদায় ধস নেমেছে, আর এর ফলে বাড়ি-ঘরের দামও সাংঘাতিকভাবে পড়ে গেছে। এর মানে হচ্ছে, চীনে যারা বাড়ির মালিক, তারা আগের চেয়ে গরিব হয়ে পড়েছে। এখন এই খাত বড় সংকটে। আবাসন শিল্পের এই সংকট কাটতে বহু বছর সময় লাগবে। ফলে বিশ্বব্যাপী অবকাঠামো খাতে চীনের যে বিনিয়োগ রয়েছে সেগুলোতে আসতে পারে বড় রকমের ধাক্কা। যার সঙ্গে জড়িয়ে পড়বে কূটনৈতিক সম্পর্কও।

সম্প্রতি ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের অর্থনীতির আকার ২০৩১ সালের মধ্যে আমেরিকাকে অতিক্রম করবে। এর মধ্য দিয়ে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার ক্ষমতা কাঠামোতেও পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। ইউরোপ-আমেরিকা প্রভাবিত বর্তমান বিশ্বকাঠামোর প্রতি চীন ইতোমধ্যে অনেক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। চীন অবশ্য এর জন্য আমেরিকাকেই দোষারোপ করছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের সঙ্গে যে বাণিজ্যিক সংঘর্ষের সূত্রপাত করেছিলেন, তা বাইডেন প্রশাসনও বহাল রেখেছে। এর লক্ষ্য যে চীনের উত্থান ঠেকানো, তা সহজেই বোধগম্য। কিন্তু চীনের উত্থান যে পশ্চিমা ও সেই সঙ্গে চীনের প্রতিবেশী দেশগুলোতে ভীতির সঞ্চার করেছে, তাও অস্বীকার করা যাবে না।

চীন হয়তো বিশ্ব অর্থনীতির এক বিরাট চালিকাশক্তি। আর এর পেছনে রয়েছে দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্টের নেওয়া কিছু অর্থনৈতিক নীতি। শি তাঁর ওই নীতিতে স্পষ্টভাবে চাইছিলেন—চীনা অর্থনীতি আরও গতিশীল, প্রাণবন্ত, শক্তিশালী এবং উদ্ভাবনী হোক। তবে দীর্ঘ যাত্রার পর ওই নীতিগুলো ইদানীং প্রায়ই বিপরীত প্রভাব ফেলছে।

চীনের নয়া অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণের সময়েই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ভবিষ্যদ্বাণী ছিল—চীন আগামী পাঁচ বছরে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সবচেয়ে বড় চালক হতে যাচ্ছে। চীন একাই বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির প্রায় ২২ দশমিক ৬ শতাংশ অবদান রাখবে, যেখানে আমেরিকা রাখবে মাত্র ১১ দশমিক ৩ শতাংশ।

বর্তমানে চীনের প্রতিরক্ষা বাজেট ১৭৭ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার খরচ করে, যা প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেটের তুলনায় অন্তত তিনগুণ বেশি। এই হারে বাড়তে থাকলে চীনের প্রতিরক্ষা বাজেট ২০০ বিলিয়নে গিয়ে ঠেকবে, যা হবে মার্কিন প্রতিরক্ষা বাজেটের কাছাকাছি। এর ফলে বিশ্ব নেতৃত্বের হাতবদল বা নতুন করে মেরুকরণ শুরু হতে পারে। পাল্টে যেতে পারে ভূ-রাজনৈতিক চিত্রপট।