বিশ্ব র্যাংকিংয়ে ১ হাজারেও নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়!
- আপডেট সময় : ০৪:৫৩:২৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩
- / ৫৭৭ বার পড়া হয়েছে
স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েবমেট্রিক্স বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকা প্রকাশ করেছে। তালিকায় প্রথম ১ হাজারের মধ্যেও নেই বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়! প্রশ্ন উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান নিয়ে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, বিশ্ব র্যাংকিংয়ের নানা সূচকের মান পূরণ করতে না পারায় পিছিয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এক্ষেত্রে উন্নতির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওয়েবসাইট প্রতিনিয়ত আপডেট রাখাসহ সূচকের মান উন্নয়নে কাজ করার পরামর্শ তাদের।
সম্প্রতি ওয়েবমেট্রিক্স বিশ্বের ২০০ এর অধিক দেশের ৩১ হাজার উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে ‘বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিং ২০২৩’ প্রকাশ করে। প্রকাশিত তালিকায় সেরা ১ হাজারে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা হয়নি। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে তালিকায় ১০৫১তম অবস্থানে থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম, ১১৯২তম অবস্থানে থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দ্বিতীয় এবং ১৪২১তম অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় তৃতীয় হয়েছে। এছাড়া শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ১৪৭৬তম অবস্থানে থেকে চতুর্থ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ১৬৯৬তম অবস্থানে থেকে পঞ্চম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৮তম অবস্থানে থেকে ষষ্ঠ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৮তম অবস্থানে থেকে সপ্তম, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ২০৭৬তম অবস্থানে থেকে অষ্টম, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ২৩১৮তম অবস্থানে থেকে নবম আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ২৩৫৪তম অবস্থানে থেকে দশম হয়েছে।
এবারের তালিকায় বিশ্বসেরা ১০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৯টি আর যুক্তরাজ্যের ১টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে এক নম্বরে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাভার্ড ইউনিভার্সিটি, দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি, তৃতীয় ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি), চতুর্থ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, পঞ্চম ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি অব ব্রাকেলি, ষষ্ঠ ইউনিভার্সিটি অবি মিশিগান, সপ্তম কর্নেল ইউনিভার্সিটি, ৮ম ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন, নবম কলোম্বিয়া ইউনিভার্সিটি নিউইয়র্ক এবং দশম অবস্থানে রয়েছে ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভেনিয়া।
এদিকে এবারের ওয়েবমেট্রিক্স র্যাংকিংয়ে শীর্ষ ১০০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় প্রতিবেশি দেশ ভারতের ১৬টি ও পাকিস্তানের দুটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
ওয়েবমেট্রিক্স ওয়েবসাইটের র্যাংকিংয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক অবস্থা, গ্রাজুয়েটদের চাকরির বাজারে সুনাম, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী সংখ্যা, গবেষণা, শিক্ষক গবেষণা-উদ্ধৃতি, আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্ক, কর্মসংস্থান প্রভৃতি সূচকের জন্য নম্বর বরাদ্দ থাকে। তারপর সব সূচকের যোগফল করে গড় করে স্কোর করা হয়। আর তার ভিত্তিতে র্যাংকিং করা হয়। এক্ষেত্রে ওয়েবসাইটের কনটেন্ট ৫০ শতাংশ, টপ সাইটেড গবেষকদের ১০ শতাংশ এবং টপ সাইটেড প্রবন্ধ ৪০ শতাংশ বিবেচনায় নিয়ে র্যাংকিং তৈরি করে ওয়েবমেট্রিক্স।বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এসব সূচকে পিছিয়ে যায় বলে র্যাংকিংয়েও পিছিয়ে যায় বলছেন শিক্ষাবিদরা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল জব্বার খাঁন বিবার্তাকে বলেন, বিশ্ব র্যাংকিং যারা করেন তাদের কিছু সূচক থাকে। আর সেই সূচক মানদণ্ড পূরণ করতে পারলে র্যাংকিংয়ে আগানো সম্ভব। তবে এর মধ্যে এমন কিছু সূচক রয়েছে যেগুলো বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য খুবই জটিল। যেমন, একটা সূচক রয়েছে যেখানে শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাত দেখা হয়। আমাদের দেশে তো শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাত হার অনেক বেশি। বুয়েটের অনুপাত ৬০:১। কিন্তু যেই বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিংয়ে ভালো করছে তাদের অনুপাত হয়তো ৬:১। এখন এটা চাইলে তো আমি পরিবর্তন করতে পারবো না। এটা ঠিক করতে একদিকে শিক্ষক বাড়ানো যেতে পারে, অন্যদিকে শিক্ষার্থী সংখ্যা কমানো যেতে পারে। আর এই কাজ করার জন্য জাতীয় পলিসি দরকার। এছাড়া কিছু র্যাংকিংয়ের এমনও সূচক থাকে, যেখানে বলা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থী কিংবা অ্যালামনাই নোবেল প্রাইজ পেয়েছে কি-না? এই ধরণের সূচকগুলোতে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিশ্ব র্যাংকিং এগিয়ে আনার উপায় সম্পর্কে জানতে চাইলে বুয়েটের উপ-উপাচার্য বলেন, বিশ্ব র্যাংকিংয়ের সূচকগুলো দেখে সেই মোতাবেক কাজ করতে হবে। আর এ কাজগুলোকে অবশ্যই নিজেদের ওয়েবসাইটে আপডেট রাখতে হবে। কেননা, ওয়েবসাইট হচ্ছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়, কিশোরগঞ্জের উপাচার্য অধ্যাপক ড. জেড এম পারভেজ সাজ্জাদ বিবার্তাকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিংয়ের জন্য মূলত যে প্যারামিটারগুলো ব্যবহার করা হয়- সেগুলো হলো, গ্রাজুয়েটদের মান, কর্মক্ষেত্রে গ্রাজুয়েটদের পজিশন, বিদেশি ছাত্র-শিক্ষকদের অনুপাত, গবেষণা ও প্যাটেন্টের সংখ্যা ইত্যাদি।
তিনি বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো র্যাংকিংয়ে পিছিয়ে পড়ার কারণ হলো- উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমরা গবেষণা অবকাঠামো তৈরি করতে পারছি না। শিক্ষকরাও উন্নত বিশ্বের নামিদামি কনফারেন্সে/সেমিনারে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পাচ্ছেন না- যেটির মাধ্যমে তার আইডিয়াকে উপস্থাপন করতে পারবেন। একই সাথে সারাবিশ্বে কী ধরনের গবেষণা চলছে, সে সম্পর্কেও বিস্তারিত ধারণা পেতে পারেন।
তিনি আরো বলেন, আমাদের গবেষণাগার তৈরি এবং কনফারেন্সে অংশগ্রহণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আর্থিক বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল। বর্হিবিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির টিউশন ফি যেমন অনেক, তেমনি ইন্ডাস্ট্রিগুলোর সাথে তাদের কলাবরেশন আছে। সেই জন্য তাদের পক্ষে এটা খুব সহজেই করা সম্ভব হয়। কিন্তু আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উন্নতমানের গবেষণাগার তৈরির জন্য যদি প্রথমে পাঁচ থেকে দশ বছর সরকার অর্থায়ন করে, তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমর্থ হবে ইন্ডাস্ট্রির সাথে কলাবরেশন করে গবেষণা কর্ম চালিয়ে যাওয়ার।
অধ্যাপক ড. পারভেজ সাজ্জাদ বলেন, অধিকন্তু দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেতন কাঠামো এবং পরিবেশ, বিদেশি ছাত্র-শিক্ষকদের জন্য এখনো যথেষ্ট অনুকূল নয়। যা বিশ্ব র্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে। তবে এই সকল সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমাদের দেশের গ্রাজুয়েটদের মান ভালো, তারা সারা বিশ্বের বিভিন্ন নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ভালো মানের গবেষক হিসেবেও কাজ করছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান বিবার্তাকে বলেন, যে গবেষণার জন্য র্যাংকিং হয়, সেই গবেষণাগুলো আমাদের কম হচ্ছে। আর এ ক্ষেত্রে বরাদ্দও কম দেয়া হচ্ছে। তবে ইদানিং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক জায়গায় গবেষণার বরাদ্দ বেড়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক পাবলিকেশন্সেও আমাদের গবেষণা ধীরে ধীরে বাড়ছে।
তিনি বলেন, আরেকটা সমস্যা হচ্ছে, আমাদের ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত খুব বেশি। বিদেশে কোনো শিক্ষকের অধীনে ১১ থেকে ১২ জন শিক্ষার্থী থাকলেও আমাদের এখানে শিক্ষক প্রতি ৫০ থেকে ৬০ জন । তারপরে আবার বিশ্ববিদ্যালয় কতোটা সাবলম্বী সেটাও দেখা হয় র্যাংকিংয়ে। এক্ষেত্রে তো আমরা শূন্য প্রায়। কারণ হলো, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বাবলম্বী নয়।
তিনি আরো বলেন, আমাদের গবেষণা যেগুলো হচ্ছে, সেগুলোও অনেক সময় অনলাইনে আপডেট থাকছে না। ফলে যারা র্যাংকিং করেন তাদেরও দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া ল্যাবরেটরিরও কিছু সমস্যা আছে। কাজেই র্যাংকিং বাড়ানোর জন্য এটাকেও আপডেট করতে হবে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, আমরা বিদেশি শিক্ষার্থী ক্যাটাগরিতে অনেক পিছিয়ে আছি। ফলে আমাদের র্যাংকিং শূন্য আসছে। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য একটা কোটা রাখা যেতে পারে। যেমন, ধরুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮০টা বিভাগ থাকলে প্রত্যেক বিভাগে যদি ২টা কোটা থাকে, তাহলে ১৬০ জন বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারবে।
ড. মীজানুর রহমান বলেন, আরেকটা জিনিস আমাদের দেখতে হবে, শিক্ষার্থী প্রতি আমাদের বাজেট কত? শিক্ষার্থী প্রতি বাজেটে তো আমরা বিশ্বে ৫ হাজারের মধ্যে পড়ি না। তাহলে কিভাবে আমরা র্যাংকিংয়ে ১০০ এর মধ্যে আসবো? তারপরেও হাল ছাড়া যাবে না। আমাদের সংকটগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধানে কাজ করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বিবার্তাকে বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে পিছিয়ে যাওয়ার কারণ হচ্ছে, যেই সব সূচকের ভিত্তিতে এই র্যাংকিং করা হয়, সেগুলোতে আমরা পিছিয়ে আছি। এক্ষেত্রে অনেক সময় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটগুলোও আপডেট থাকে না। ফলে যারা র্যাংকিংয়ের তথ্য নেয়, তারা ওয়েবসাইটে তথ্য না পেয়ে মার্ক দেয় না। এটার সমাধানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওয়েবসাইট আপডেট করার পাশাপাশি র্যাংকিংয়ে আসার ক্রাইটেরিয়াগুলো ভালো করে দেখতে হবে। এরপর নিজেদের দুর্বল জায়গাগুলো খুঁজে অতিদ্রুত সমাধান করতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদেশি শিক্ষার্থী কম। এটাও আমাদের র্যাংকিংয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাছাড়াও আমাদের গবেষণায় বরাদ্দও কম থাকে। ফলে গবেষণাও কম হচ্ছে। কাজেই এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দিতে হবে।
বিশিষ্ট এই শিক্ষাবিদ বলেন, আমাদের দেশের উচ্চ শিক্ষিতদের অনেকে পাস করে কর্মসংস্থানে ঢুকতে না পেরে বেকার হচ্ছে। আর এ বিষয়টি বিশ্বব্যাপীও আলোচিত হচ্ছে। ফলে র্যাংকিংয়ে এর প্রভাব পড়ছে।
র্যাংকিংয়ে ভালো করার উপায় কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে গণমাধ্যমেরও যোগসূত্র থাকতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খারাপ কাজ করলে যেভাবে সমালোচনা করা হয়, একইসাথে ভালো গবেষণাসহ কোনো স্বীকৃতিমূলক কাজ করলে সেটাও প্রচার করতে হবে। তাহলে বিশ্ব আমাদের এ অর্জনগুলো সম্পর্কে জানতে পারবে। আমাদের শিক্ষার কারিকুলাম যুগোপযোগী করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটগুলো আপডেট করতে হবে। এছাড়া র্যাংকিং মানদণ্ডের সূচকগুলো দেখতে হবে এবং সেটা অনুযায়ী কাজ করতে হবে।