বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ
- আপডেট সময় : ০১:৩২:৩১ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩ জুন ২০২৪
- / ৩৮৬ বার পড়া হয়েছে
সরকারি হিসেবেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি টানা ২২ মাস গড়ে ৯ শতাংশের উপরে। ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, গেলো বছর যখন বাজেট পেশ হয় তখনকার তুলনায় এখন ১০টি জরুরি খাদ্যপণ্যের দাম ৫০ শতাংশ বেড়েছে।
এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই এবারের বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। নতুন করে মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে, বাজেটে ‘সামাজিক সুরক্ষা খাতে’ বরাদ্দ বাড়ানোর পরামর্শ তাদের।
মূল্যস্ফীতির তুলনায় মজুরি বৃদ্ধির হার কম। ২০২৩ সালের মে থেকে ২০২৪ এর এপ্রিলে মূল্যস্ফীতির হার যখন থেকেছে ৯.৪১ থেকে ৯.৯৪ শতাংশের ঘরে, তখন মজুরি বৃদ্ধির হার ৭.৩২ থেকে ৭.৮৫ শতাংশে থেকেছে। এটি সরকারেই হিসেব। এমন প্রেক্ষিতে, শুধু দিনমজুর নয় দুর্দশায় আছে দেশের সিংহভাগ মানুষ।
মূল্যস্ফীতি নিয়ে কোন সুখবর নেই। আয় বৈষম্যও দিন দিন বাড়ছে। গড় হারে বাড়েনি মজুরি। আসছে বাজেটে মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে ব্যর্থ হলে জটিল হতে পারে পুরো অর্থ-সামাজিক কাঠামো। তাই সামাজিক খাতে গুরুত্ব দেয়ায় তাগিদ অর্থনীতিবিদদের।
আমদানি নির্ভর খাদ্যপণ্য ছাড়াও দেশীয় উৎপাদিত খাদ্যেরও দাম হয়েছে চওড়া। মজুরি মূল্যের সেখানে খুব বেশি উন্নতি না হলেও পল্ট্রি পণ্যের দাম বাড়ায় প্রভাব পড়েছে মুরগি ও মাছের বাজারে। সেখানেও দাম পোষাতে না পেরে অনেকে ব্যবসা বন্ধ করেছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) গবেষণায় উল্লেখ করে, ডিসেম্বরে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি সামগ্রিক ছিল ১২ শতাংশ । তবে ১৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতির চাপে ছিল দরিদ্র জনগোষ্ঠী।
বরাবরের মতো এবারও চলতি অর্থবছরের চেয়ে টাকার অঙ্ক আরও বাড়িয়ে আগামী ৬ জুন (২০২৪-২০২৫) অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ ও রাজস্ব আদায়ের বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। যা হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ আকারের বাজেট।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আব্দুর রাজ্জাক বলছেন, এবার বাজেটের সাধারণ মানুষের দিকে নজর রাখতেই হবে। কারণ ইতিমধ্যেই মূল্যস্ফীতির জালে আটকে গেছেন তারা। মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করতে হবে।
অন্যদিকে পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজের মতে, কর হার বাড়ালেই কর আদায় বাড়বে এর কোন যৌক্তিকরা নেই। বরং যারা কর দেয় না তাদের করজালে আনতে হবে।
এদিকে বৈশ্বিক সংকটের কথা বিবেচনায় নিয়ে নতুন অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ছয় শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণসহ রিজার্ভ ও রাজস্ব আয় বাড়ানোর বিষয় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। মূল্য কমিয়ে নিত্যপণ্যের বাজারে স্বস্তি দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে।
একই সঙ্গে সরকারি রাজস্ব আয়ের পরিকল্পনা সাড়ে পাঁচ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি ধরে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট সাজানো হচ্ছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে সরকার রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্য ঠিক করতে যাচ্ছে তাতে চলতি অর্থবছরের তুলনায় অনেক বেশি টাকা জোগাড় করতে হবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)।
বিআইডিএস’র গবেষণা পরিচালক ড. এম এম জুলফিকার আলী বলেন, ‘আমাদের রিয়েল ইনকাম কমে যাচ্ছে। দুই বছর আগে একজন কৃষকের যে মজুরি ছিল তা দিয়ে যে কয় কেজি চাল কিনতে পারতো তা এখন পারছে না।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যাণ ব্যুরোর তথ্য বলছে, বছরের শেষ প্রান্তীকে এপ্রিলে সামগ্রিক গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৭৪ শতাংশ। যেখানে খাদ্যপণ্যে ১০.২২ শতাংশ। খাদ্য নয় এমন পণ্যে মূল্যস্ফীতি ৯.৩৪ শতাংশ। তবে সার্বিক মূল্যস্ফীতির ভগ্নাংশে বেশি চাপে ছিলেন পল্লী এলাকার মানুষ। শহর থেকে ০.৪৬ শতাংশ বেশি ছিলে গড় মূল্যস্ফীতি। ০.৬ শতাংশ বেশি খাদ্যপণ্যে। এবং ভোগ্যপণ্য ছাড়া অন্যান্য পণ্যেও পল্লী অঞ্চলের মানুষকে ০.৫০ শতাংশ বেশি খরচ করতে হয়েছে।
অর্থনীতিবীদ এম এম আকাশ বলেন, ‘বাংলাদেশে এই মূল্যস্ফীতির কারণে ৪ কোটি লোকের খাদ্য নিরাপত্তা ক্ষুন্ন হতে যাচ্ছে। আমরা এইটাকে বাজার ভিত্তিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কোনোভাবেই নিশ্চিত করতে পারছি না। এইটার একমাত্র উপায় সরকার যদি বাজারে মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের চার অর্থ বছরের হিসেব বলছে ২০২০-২১ ও ২১-২২ অর্থ বছরে ০.৫৯ শতাংশ মূল্যস্ফীতি থাকলেও এক লাফে ২০২২-২৩ সালে প্রায় তিন শতাংশ বাড়ে যা ২০২৪ অর্থ বছরে এসে যোগ হয় আরও এক শতাংশ। বিআইডিএস এর গবেষণা বলছে, যে হারে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে সে হারে বাড়েনি মজুরি। তাই আসছে বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমানোর সাথে মজুরি বৃদ্ধির তাল ঠিক না রাখলে সার্বিক অর্থনীতি জটিল হয়ে উঠবে।
সিপিডি বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘মূল চালিকাটা হতে হবে প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান দিয়ে নিম্ন আয়ের মানুষের আয়ের ব্যবস্থা করা। তারপরেও কেউ যদি থেকে যায় শারীরিকভাবে অক্ষম, সামাজিকভাবে বিছিন্ন এই সমস্ত মানুষের জন্য সামাজিক সুরক্ষা দরকার।’
আর্থসামাজিক বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, আসছে বাজেটে সামাজিক সুরক্ষাকে গুরুত্বে দিতে হবে। গুরুত্ব দিতে হবে কৃষি উৎপাদন ও প্রান্তিক বিনিয়োগ ও সামষ্ঠিক অর্থনীতিতে। এছাড়া জরুরী এই সময়ে ‘এডহক’ ভিত্তিতে বেষ্টিক অর্থনীতির নীতি তৈরি করতেও গতানুগতিক ধারায় না গিয়ে পরিসংখ্যান ও গবেষণার তথ্য উপাত্ত ও খাত সংশ্লিষ্টদের প্রধান্য দিয়ে অংশগ্রহণমূলক নীতি নিতে হবে।