বন্যা নিয়ন্ত্রণে বিপুল অর্থ ব্যয়ের পরেও স্বস্তি মিলছে না কেন?
- আপডেট সময় : ০৩:১৬:০৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২১ জুন ২০২৪
- / ৩৭৬ বার পড়া হয়েছে
সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে বন্যা নিয়ন্ত্রণে। তারপরও মিলছে না স্বস্তি। এমনকি ওলট-পালট করে দেয় রাষ্ট্রের অর্থনীতির হিসেব নিকেষকেও। পাল্টে দেয় জলবিদ্যার কৃষি, পুরকৌশল ও জনস্বাস্থ্যের সকল উপাত্তকে। সময় যত যাচ্ছে ততই বাড়ছে বাংলাদেশে বন্যার প্রকোপ। সমানুপাতিক হারে বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ। কেন এমন পরিণতি? এর সমাধানই বা কি?
সিলেট অঞ্চলে বন্যার আগ্রাসন কতটা ভয়াবহ। এই চিত্র কখনও স্থির চিত্র নয়। সময়ের সঙ্গে এর ধরণ পাল্টায়। পাল্টায় গতিপ্রকৃতিও। বন্যা কবলিত অঞ্চলে জল-জীবনের ভাষা বড়ই বেদনার। সীমাহীন দুর্ভোগের। এই দুর্ভোগ দূরে ঠেলে খানিকটা স্বস্তি কখনই ধরা দেয় না। ঢলের জলে নিঃস্ব হতে হয় ধনী-গরিব সবাইকে। আত্মসমর্পণ করতে হয় প্রকৃতির এই খেয়ালীপনার কাছে।
কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়ন। পুবগাঁওয় গ্রামের কামাল হোসেন। দেড় বছরের কন্যা সন্তান আনিশাকে কোলে নিয়ে বন্যায় ভেসে যাওয়া বাড়ির পাশেই ডিঙি নৌকায় ২দিন পার করেছেন। আর তার ঘরনী সামলাচ্ছেন পানিতে টইটম্বুর হওয়া ঘরের আসবাবপত্র। ২০২২ এ একই দশা হয়েছিলো তাদের। আগের বছরের ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার আগেই এবারের ধাক্কায় আবারও সর্বহারাদের তালিকায় নাম লেখাতে হয় তাকে।
তিনি বলেন, ‘ঘরবাড়ি ভেঙ্গে গিয়েছে। গবাদিপশু ছিল তাও ভেসে গিয়েছে।’
কামাল হোসেনের মতো সিলেট অঞ্চলের বন্যা পীড়িত জেলাগুলোর হাজারো মানুষের গল্পের ধরণ একই রকম। বিশেষ করে সুনামগঞ্জে। কেউ হারিয়েছে সম্পদ কেউ বা তার শেষ সম্বল পালিত পশু। বন্যা হলে যে দুর্ভোগ বা দুর্যোগ দেখা দেয় তা কেবল ভুক্তভোগীরাই অনুভব করতে পারেন। চলমান বন্যায় এখনো খাদ্য, বাসস্থান ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে মানুষ। এই অবস্থা নিত্য বছরের।
ভুক্তভোগীদের একজন বলেন, ‘ঘরের ভিতরে বর্তমানে হাটুর উপরে পানি। হঠাৎ করেই বন্যা চলে আসে। আমাদের খাবারের খুব সমস্যা হচ্ছে।’
এই অঞ্চলের মানুষকে বন্যা থেকে রেহাই দিতে ২০২২ সালের বন্যার পর ১২৯ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এর আগে ২০১৩ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে সিলেট সিটি করপোরেশন । বিশাল পরিমাণ টাকা ব্যয়ের পরেও নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন ও বন্যার অবসান ঘটানো যায়নি। ফলশ্রুতিতে পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে শুধু নদী খনন বা তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করে বন্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না। দরকার সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ।
সিলেট পাউবো নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, ‘শুধু পানি উন্নয়ন বোর্ড না, এখানে সিটি করপোরেশন, সড়ক বিভাগ, ইউনিয়ন পরিষদসহ জনগণ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’
প্রাকৃতিক দুর্যোগের বাছে মানুষের শক্তি সীমাবদ্ধ হলেও এই বিজ্ঞানের যুগে কেবল প্রকৃতির উপর ভরসা করে বসে থাকা কোন ভাবেই কাম্য নয়। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো বিজ্ঞান ও বুদ্ধির প্রয়োগে বন্যাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশেও তা সম্ভব বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
সিলেট শাবিপ্রবি’র সিইই বিভাগের অধ্যাপক ড. মুশতাক আহমদ বলেন, ‘প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। যেখানে সেন্সরই বলে দিবে পানি কতটুকু বৃদ্ধি পেয়েছে, কোন পয়েন্টে পানি আছে। যেখানে একটা কন্ট্রোল সেল আমাদের থাকবে সেখানে পৌঁছে যাবে তথ্য।’
সিলেট অঞ্চলে এবার দ্বিতীয় দফার বন্যায় ইতোমধ্যে প্রায় ২০ লাখের মতো মানুষ পানি বন্দি হয়েছেন। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনো সঠিক ভাবে তুলে ধরতে পারেনি সরকারি কোন দপ্তর ।
সিলেটের বন্যা ছাড়িয়ে এরই মধ্যে নদ-নদীর দুই কূল উপচে নিম্নাঞ্চল ডুবছে উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামেরও। বন্যার চোখ রাঙানি নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে সেখানকার জনপদকে।
বন্যা সমতলে অবস্থিত কুড়িগ্রাম জেলা। যার ফলে এই জেলায় বন্যা কোন আকস্মিক ঘটনা নয়। প্রতি বছর কমবেশি এখানে বন্যা হয়ে থাকে। এখানে যে বন্যা হয়ে থাকে তার মধ্যে রয়েছে কখনও আকস্মিক বন্যা হয় কখনও বিলম্বিত বন্যা হয়। কখনও আবার এই বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়। আবার কখনও এটি স্বল্প মেয়াদী হয়ে থাকে। এবারও বন্যার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে।
প্রতি বছর বর্ষা এলেই এখানকার মানুষের কাছে নদী ভাঙ্গন ও বন্যা তাদেরকে গম্ভীর ও বিষন্ন করে তুলে । ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমার ও জিঞ্জিরাম-এই ৫ আন্তঃসীমান্ত নদীসহ ১৬টি নদী কুড়িগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় বৃষ্টি আর উজানের ঢলে বছরে একাধিকবার বন্যা আঘাত হানে। এবারও নদ-নদীতে পানি বাড়া অব্যাহত থাকায় বন্যার আশংকায় জেলার অধিকাংশ মানুষ।
সাম্প্রতিক কয়েক বছরে অন্তত ৩০টি বন্যা হয়েছে জেলাটিতে। সেইসাথে নদী ভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়েছেন ১২ হাজারেরও বেশি পরিবার। অথচ বন্যা প্রতিরোধ ও ভাঙন রোধে হাজার কোটি টাকা খরচ হলেও ফলাফল নেই বললেই চলে ।
রিভারাইন পিপলের সিনেটর এসএম আব্রাহাম লিংকন বলেন, ‘সরকার যে বরাদ্দ দেয় বন্যা রক্ষায়। তা বন্যা আসার আগেই বাঁধ নির্মাণ, নদী শাসনসহ বন্যা রক্ষায় যা করতে হবে তা বাস্তবায়ন করা।’
বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে বিগত ১০ বছরে স্থায়ী ও অস্থায়ী প্রতিরক্ষা কাজে কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। বর্তমানে ২ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ব্রহ্মপুত্র, ধরলা ও দুধকুমারের ডান ও বাম তীরে প্রায় ৫৭ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে স্থায়ী প্রতিরক্ষা কাজসহ আরও কয়েকটি প্রকল্প চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিবুল হাসান বলেন, ‘নদী ভাঙ্গন থেকে বাঁচতে ব্লক ব্যবহার করে নদী শাসনের কাজ চলমান রয়েছে।’
কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ বলেন, ‘স্থায়ী প্রতিরক্ষা বাঁধ ও ড্রেজিংয়ের কাজ শুরু হয়েছে।’
কুড়িগ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে চলা তিস্তার তীরে অন্য দুই জেলা নীলফামারি আর রংপুরও সমান ক্ষতিগ্রস্থ হয় বন্যার করাল থাবায়।
ভারতের সিকিম থেকে নেমে আসা তিস্তা বাংলাদেশের নীলফামারী রংপুর কুড়িগ্রাম ছুঁয়েছে। সারা বছর এর থেকে উপকার পায় লাখো মানুষ কিন্তু বন্যা এলে দুর্ভোগের শেষ থাকেনা। বন্যা নিয়ন্ত্রণে রংপুর বিভাগে ১৩ টি প্রকল্পে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প চলছে। কিন্তু এর থেকে কতটুকু উপকার পাচ্ছে নদী তীরবর্তী মানুষ। তিস্তাপারের মানুষেরা বলছেন মোটেও উপকার পাচ্ছেন না তারা। এর জন্য এখনকার কর্মকর্তাদের দায়ী করছেন।
রংপুর আর নীলফামারীর জন্য তিস্তা বেদনাবিদুর কোন এক মহাকাব্য। প্রতবছর উজান থেকে নেমে আসা পানির ঢলের সাথে হাজার হাজার টন যে পলি বয়ে নিয়ে আসে, তাতে তিস্তার পেট একেবারেই পরিপূর্ণ হয়ে যায়। নষ্ট হয় জমি, বাড়িঘর এমন কি কখনো কখনো বিলীন হয় জমিজমা।
আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায় বছরে বছর। বন্যার ক্ষতি নিয়ন্ত্রণ করতে পানি উন্নয়ন বোর্ড রংপুর বিভাগে ১৩ টি প্রকল্পে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার কাজ করছে। এরমধ্যে নদী তীর সংরক্ষণ ১৩৪ কিলোমিটার, নদী খাল খনন ১৬০০ কিলোমিটার, বাঁধ মেরামত বা নতুন বাঁধ তৈরি ২৪৭ কিমি। তবে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে বন্যার সমস্যা অনেকটাই লাঘব হবে মনে করছেন কর্মকর্তারা।
রংপুর পাউবো সার্কেল ১ তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আহসান হাবীব বলেন, ‘যেই জায়গাগুলোতে পানি ঢুকলে একটা বড় অংশের মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হবে সেখানে কাজ করা হচ্ছে। সেই জায়গাগুলোতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
অঞ্চলভিত্তিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারের খরচের তালিকা বিশাল পর্যায়ের হলেও তার সুফল পাচ্ছে কি ভুক্তভোগীরা
পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত দেশে ৯৫৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সংস্থাটি। এছাড়া বর্তমানে দেশে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১০০টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। নদীর তীর সংরক্ষণ, সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদী ড্রেজিং, ভূমি পুনরুদ্ধারসহ বিভিন্ন উন্নয়নে এসব প্রকল্প নেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবে এতগুলো প্রকল্প নেয়ার পরেও দেশে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি নেই। বরং প্রতি বছরই এই দুর্যোগের কবলে পড়ে দেশবাসী।
স্বাধীনতার আগ থেকেই কার্যক্রম শুরু হয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের। বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নিষ্কাশন ও সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে কৃষি ও মৎস্য সম্পদের উৎপাদন বাড়াতে কাজ শুরু করে সংস্থাটি। ৬৫ বছরের দীর্ঘ ইতিহাসে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এখন পর্যন্ত ৯৫৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। যা প্রকল্পের প্রস্তাবিত মোট ব্যয় ছিলো ১৮ হাজার ২০৯ কোটি টাকা। বর্তমানেও ১০০টি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। তবে সামনে বন্যা নিয়ন্ত্রণে মহাপরিকল্পনার কথা জানান কর্মকর্তারা।
ঢাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান বলেন, ‘প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমে নদীতে প্রচুর পরিমাণে পলি আসে। যা মেইনটেইন করা জন্য ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।’
বছর বছর নতুন নতুন পরিকল্পনা, মহাপরিকল্পনা সবই যেন তুচ্ছ এই বন্যার কাছে। এক বছরের বন্যার ক্ষয়ক্ষতি ছাড়িয়ে যায় পরের বছর মিলে নতুন আশ্বাস তারপর আবার সেই বন্যা, সেই দুর্ভোগ, সেই ক্ষতি।
প্রায় প্রতি বছরই দেশে বন্যা হয়। এসব বন্যায় যোগাযোগ, কৃষি, শিক্ষা, পর্যটন ও মৎস্য খাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই যেমন গত বছর বান্দরবানে ভয়াবহ বন্যায় ৭০০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে সরকারিভাবে জানানো হয়েছে। তবে এসব ক্ষয়ক্ষতির যুক্ত থাকে না প্রান্তিক পর্যায়ের হিসাব। যা যুক্ত হলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছাড়িয়ে যাবে কয়েক হাজার কোটি টাকা।
প্রতিবছর দেশে নদনদী খনন ও বাধ নির্মানের নামে ব্যাপক অর্থ ব্যায় হলেও দৃশমান ফলাফল না আসায় সরকারের টেকসই বন্যা ব্যবস্থাপনার আরো অধিক মনোযোগি হওয়ার প্রয়োজন মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের।