ঢাকা ১২:২৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

আর যেন পথ না হারায় বাংলাদেশ

সুতপা বেদজ্ঞ
  • আপডেট সময় : ১২:৫৭:৫৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৮ অগাস্ট ২০২৪
  • / ৪২৭ বার পড়া হয়েছে
৭১ নিউজ বিডির সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

বাংলাদেশে ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলন টানা প্রায় ৩৬ দিনে গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়ে নয় দফা এবং অবশেষে একদফা দাবিতে এসে শেষ হয়েছে। গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র দিয়ে দেশ ত্যাগ করেন। সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে ভাষণে, একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কথা বলেছেন এবং সে উদ্দেশ্যে তাঁরা কাজ করছেন বলে জানিয়েছিলেন। স্বল্প সময়ের মধ্যে এই সরকারে কারা থাকছেন তাদের নাম জানানো হবে বলেও তিনি জানিয়েছিলেন। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা সেনা শাসিত বা সেনা সমর্থিত সরকার মানবে না। তারা একটি জাতীয় সরকারের প্রস্তাবিত রূপরেখা দেওয়ার জন্য ২৪ ঘণ্টা সময় নিয়েছিল। কিন্তু দেশের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিবেচনায় ইতিমধ্যে তারা প্রধান উপদেষ্টার নাম ঘোষণা করেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আইন‑শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সক্রিয় করতে রাষ্ট্রপতির সাহায্য চেয়েছে।

শেখ হাসিনা সরকারকে যে কায়দায় বিদায় নিতে হয়েছে, তা কোনো সরকারের জন্য কাম্য নয়। কিন্তু যেভাবেই হোক বাংলাদেশে এই ব্যাপারটিই বারবার ঘটছে। নির্বাচনের মাধ্যমে একবার কেউ ক্ষমতায় বসলে আর তাকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নামানো যাচ্ছে না। বছরের পর বছর বিনা ভোটে ক্ষমতায় থাকার ফলে সরকারপ্রধান হয়ে ওঠেন স্বৈরাচারী একনায়ক। এই অবস্থা জন্ম দেয় গণতন্ত্রহীনতার। সৃষ্টি হয় চাটুকার, দালাল, দুর্নীতিবাজ, খুনী, মাস্তান, ভূমিদস্যুদের। সরকার হয়ে পড়ে জনবিচ্ছিন্ন। রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে দলীয় পেটোয়াবাহিনীর মতো ব্যবহার করা হয়। সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া হয় ভয়ের সংস্কৃতি।

আমাদের দেশে আরেকটি প্রবণতা খুব লক্ষ্যণীয়। যারা সরকার গঠন করে, তারা বিরোধী রাজনৈতিক দলকে মাঠ ছাড়া করতে চায়। নানা ধরনের দমন-পীড়নের ঘটনা ঘটায়। কেবলমাত্র ক্ষমতার প্রশ্নকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরের মধ্যে শত্রুতামূলক সম্পর্ক তৈরি হয়। এর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয় সমাজের মধ্যে। যখন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মেয়াদ পূর্ণ করে ক্ষমতা হস্তান্তর না হয়ে আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যদিয়ে ক্ষমতার পরিবর্তন হয়, সে সময়টায় দেশের মানুষ বিশেষ করে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীসমূহ এবং সংখ্যালঘু শ্রেণির ওপর আক্রমণ হয়ে থাকে। একশ্রেণির সুবিধাবাদী গোষ্ঠী লুটপাটের সাথেও যুক্ত হয়।

এ দেশের মানুষ বিএনপি-জামাত, জাতীয় পার্টির শাসন দেখেছে। কীভাবে এ দেশে রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় সাম্প্রদায়িক ও দুর্নীতিপরায়ণ কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার বিকাশ ঘটেছে, তাও মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। স্বাধীনতার পর থেকে বামপন্থী দলগুলো কখনো স্বাধীন স্বতন্ত্র অবস্থানে দাঁড়াতে পারেনি। সমাজের মানুষের কাছে প্রভাবক শক্তি হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লুট হয়ে গেছে। বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন অধরা থেকে গেছে। এই সুযোগে সমাজে ও রাষ্ট্রে নৈতিকতা বিবর্জিত আত্মকেন্দ্রিক উচ্ছৃংখল একটি বিরাট শ্রেণি তৈরি হয়েছে।

আমরা লক্ষ্য করলাম শেখ হাসিনা পদত্যাগ করার খবর প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে উচ্ছৃংখল জনতা গণভবন, সংসদ ভবনে যেভাবে লুটপাট চালিয়েছে, বিভিন্ন শহরে ভাঙচুর করেছে, আগুন জ্বালিয়েছে, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনার ক্ষতি সাধন করেছে, এমনকি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বাড়িতে হামলা করেছে, তা ছিল ন্যাক্কারজনক। শুধু এখানেই শেষ হয়নি, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্থাপনা আক্রান্ত হয়েছে। একদিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরও একটা ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী বা ব্যক্তি যদি মনে করে ছাত্ররা তাদের জন্য বিজয় এনেছে, তবে তারা সম্ভবত ভুল করবে। ছাত্রদের বার্তা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট। হাসিনা শাসনের পতন হলেই বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে না।

এর জন্য ধারাবাহিকভাবে রাষ্ট্র সংস্কারের পথে যেতে হবে। দেশে এখন স্বার্থান্বেষী মহল বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, তার আলামত আমরা দেখেছি। যারা হাসিনা সরকারের সুবিধাভোগী ছিল, তারা যেকোনোভাবে এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করতে থাকবে, এ গণঅভ্যূত্থান ভুল ছিল। এ অবস্থা থেকে দ্রুত বের হয়ে আসা জরুরি। আমরা যদি তা করতে ব্যর্থ হই, তবে সমাজে এমনকি অন্যান্য রাষ্ট্রে ভুল বার্তা যাবে। ছাত্র-জনতার এত বড় আত্মত্যাগ বৃথা হয়ে যাবে। তাই তিপ্পান্ন বছর পরে এ দেশের মুক্তিকামী ছাত্র-জনতার যে বিজয়, তা ধরে রাখতে প্রতিমুহূর্তে সতর্ক থাকতে হবে।

এই আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তারা অন্তর্ভূর্ক্তিমূলক অন্তর্বর্তী সরকার কেমন হতে পারে, তা বলার সাথে সাথে এই সরকারের প্রধান কর্তব্যগুলো উত্থাপন করে একটি রূপরেখা দিয়েছে। যে ধরণের সরকারই গঠন করা হোক আগামী দিনে বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে এ সকল বিষয় বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।

এই আন্দোলনের একটি বড় প্রভাবক শক্তি ছিল, দেশ-বিদেশের প্রায় অর্ধশতাধিক সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করা ইনফলুয়েন্সারগণ। যে সময়ে ছাত্ররা ক্রমাগত রাজনীতি বিমুখ, সুস্থধারার রাজনীতি চর্চা দেশে নিঃশ্বেষ হয়ে গিয়েছিল, সে সময়ে এই সকল ইনফ্লুয়েন্সার ক্রমাগত রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারের চিত্র, কর্তৃত্ববাদের নগ্নরূপ হাজির করেছেন। বর্তমান প্রজন্মের লাখ লাখ তরুণ তাদের ফলোয়ার হয়েছে। তারা নিজেদের মন ও মনন গঠন করেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য। আগামীতে স্থিতিশীল, ন্যায্যতাভিত্তিক সমতার বাংলাদেশ গড়তে তাদের পরামর্শ নিশ্চিত পথ দেখাবে।

আমরা একটা স্পর্শকাতর সময় পার করছি। এ অবস্থায় কতগুলো প্রশ্ন আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করার সাথে সাথেই কেন নৈরাজ্য শুরু হলো? গণভবন, সংসদ ভবন কী কোনোভাবেই রক্ষা করা যেত না? যে সকল রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতিসাধন করা হয়েছে, সেগুলো কি কোনোভাবে এড়ানো যেত? গতকাল থেকে আমরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয় ভূমিকা লক্ষ্য করছি। অনেক ধরনের পথনির্দেশনা থাকার পরেও শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার প্রক্রিয়াটি স্বাভাবিক ছিল না। সরকারবিহীন অবস্থায় অনেকটা সময় চলে গেছে। জনজীবনকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা এখন জরুরি কর্তব্য হিসেবে আমাদের সামনে উপস্থিত। সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে তাঁর ওপর ভরসা রাখতে বলেছেন। আমরা তাঁর কথায় ভরসা রাখতে চাই এবং অবস্থার দ্রুত উন্নতি চাই।

শেষ ভালো যার সব ভালো তার। আমরা যেন ভুলে না যাই মুক্তিকামী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুথানে দাবি আদায় করতে গিয়ে রাজপথে আমাদের সন্তানদের জীবন দিতে হয়েছে। এত রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশটিতে আর যেন কোনো অগণতান্ত্রিক, জবাবদিহিহীন, সাম্প্রদায়িক ও স্বৈরতন্ত্রের জন্ম না হয়। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন সমতার বাংলাদেশে আমাদের সন্তানেরা নিরাপদে বসবাস করতে পারে, সেই হোক আগামীর প্রত্যয়। আর যেন পথ না হারায় বাংলাদেশ।

লেখক: লেখক ও অধিকার কর্মী

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

আর যেন পথ না হারায় বাংলাদেশ

আপডেট সময় : ১২:৫৭:৫৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৮ অগাস্ট ২০২৪

বাংলাদেশে ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলন টানা প্রায় ৩৬ দিনে গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়ে নয় দফা এবং অবশেষে একদফা দাবিতে এসে শেষ হয়েছে। গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র দিয়ে দেশ ত্যাগ করেন। সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে ভাষণে, একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কথা বলেছেন এবং সে উদ্দেশ্যে তাঁরা কাজ করছেন বলে জানিয়েছিলেন। স্বল্প সময়ের মধ্যে এই সরকারে কারা থাকছেন তাদের নাম জানানো হবে বলেও তিনি জানিয়েছিলেন। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা সেনা শাসিত বা সেনা সমর্থিত সরকার মানবে না। তারা একটি জাতীয় সরকারের প্রস্তাবিত রূপরেখা দেওয়ার জন্য ২৪ ঘণ্টা সময় নিয়েছিল। কিন্তু দেশের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিবেচনায় ইতিমধ্যে তারা প্রধান উপদেষ্টার নাম ঘোষণা করেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আইন‑শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সক্রিয় করতে রাষ্ট্রপতির সাহায্য চেয়েছে।

শেখ হাসিনা সরকারকে যে কায়দায় বিদায় নিতে হয়েছে, তা কোনো সরকারের জন্য কাম্য নয়। কিন্তু যেভাবেই হোক বাংলাদেশে এই ব্যাপারটিই বারবার ঘটছে। নির্বাচনের মাধ্যমে একবার কেউ ক্ষমতায় বসলে আর তাকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নামানো যাচ্ছে না। বছরের পর বছর বিনা ভোটে ক্ষমতায় থাকার ফলে সরকারপ্রধান হয়ে ওঠেন স্বৈরাচারী একনায়ক। এই অবস্থা জন্ম দেয় গণতন্ত্রহীনতার। সৃষ্টি হয় চাটুকার, দালাল, দুর্নীতিবাজ, খুনী, মাস্তান, ভূমিদস্যুদের। সরকার হয়ে পড়ে জনবিচ্ছিন্ন। রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে দলীয় পেটোয়াবাহিনীর মতো ব্যবহার করা হয়। সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া হয় ভয়ের সংস্কৃতি।

আমাদের দেশে আরেকটি প্রবণতা খুব লক্ষ্যণীয়। যারা সরকার গঠন করে, তারা বিরোধী রাজনৈতিক দলকে মাঠ ছাড়া করতে চায়। নানা ধরনের দমন-পীড়নের ঘটনা ঘটায়। কেবলমাত্র ক্ষমতার প্রশ্নকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরের মধ্যে শত্রুতামূলক সম্পর্ক তৈরি হয়। এর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয় সমাজের মধ্যে। যখন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মেয়াদ পূর্ণ করে ক্ষমতা হস্তান্তর না হয়ে আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যদিয়ে ক্ষমতার পরিবর্তন হয়, সে সময়টায় দেশের মানুষ বিশেষ করে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীসমূহ এবং সংখ্যালঘু শ্রেণির ওপর আক্রমণ হয়ে থাকে। একশ্রেণির সুবিধাবাদী গোষ্ঠী লুটপাটের সাথেও যুক্ত হয়।

এ দেশের মানুষ বিএনপি-জামাত, জাতীয় পার্টির শাসন দেখেছে। কীভাবে এ দেশে রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় সাম্প্রদায়িক ও দুর্নীতিপরায়ণ কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার বিকাশ ঘটেছে, তাও মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। স্বাধীনতার পর থেকে বামপন্থী দলগুলো কখনো স্বাধীন স্বতন্ত্র অবস্থানে দাঁড়াতে পারেনি। সমাজের মানুষের কাছে প্রভাবক শক্তি হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লুট হয়ে গেছে। বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন অধরা থেকে গেছে। এই সুযোগে সমাজে ও রাষ্ট্রে নৈতিকতা বিবর্জিত আত্মকেন্দ্রিক উচ্ছৃংখল একটি বিরাট শ্রেণি তৈরি হয়েছে।

আমরা লক্ষ্য করলাম শেখ হাসিনা পদত্যাগ করার খবর প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে উচ্ছৃংখল জনতা গণভবন, সংসদ ভবনে যেভাবে লুটপাট চালিয়েছে, বিভিন্ন শহরে ভাঙচুর করেছে, আগুন জ্বালিয়েছে, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনার ক্ষতি সাধন করেছে, এমনকি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বাড়িতে হামলা করেছে, তা ছিল ন্যাক্কারজনক। শুধু এখানেই শেষ হয়নি, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্থাপনা আক্রান্ত হয়েছে। একদিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরও একটা ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী বা ব্যক্তি যদি মনে করে ছাত্ররা তাদের জন্য বিজয় এনেছে, তবে তারা সম্ভবত ভুল করবে। ছাত্রদের বার্তা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট। হাসিনা শাসনের পতন হলেই বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে না।

এর জন্য ধারাবাহিকভাবে রাষ্ট্র সংস্কারের পথে যেতে হবে। দেশে এখন স্বার্থান্বেষী মহল বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, তার আলামত আমরা দেখেছি। যারা হাসিনা সরকারের সুবিধাভোগী ছিল, তারা যেকোনোভাবে এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করতে থাকবে, এ গণঅভ্যূত্থান ভুল ছিল। এ অবস্থা থেকে দ্রুত বের হয়ে আসা জরুরি। আমরা যদি তা করতে ব্যর্থ হই, তবে সমাজে এমনকি অন্যান্য রাষ্ট্রে ভুল বার্তা যাবে। ছাত্র-জনতার এত বড় আত্মত্যাগ বৃথা হয়ে যাবে। তাই তিপ্পান্ন বছর পরে এ দেশের মুক্তিকামী ছাত্র-জনতার যে বিজয়, তা ধরে রাখতে প্রতিমুহূর্তে সতর্ক থাকতে হবে।

এই আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তারা অন্তর্ভূর্ক্তিমূলক অন্তর্বর্তী সরকার কেমন হতে পারে, তা বলার সাথে সাথে এই সরকারের প্রধান কর্তব্যগুলো উত্থাপন করে একটি রূপরেখা দিয়েছে। যে ধরণের সরকারই গঠন করা হোক আগামী দিনে বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে এ সকল বিষয় বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।

এই আন্দোলনের একটি বড় প্রভাবক শক্তি ছিল, দেশ-বিদেশের প্রায় অর্ধশতাধিক সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করা ইনফলুয়েন্সারগণ। যে সময়ে ছাত্ররা ক্রমাগত রাজনীতি বিমুখ, সুস্থধারার রাজনীতি চর্চা দেশে নিঃশ্বেষ হয়ে গিয়েছিল, সে সময়ে এই সকল ইনফ্লুয়েন্সার ক্রমাগত রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারের চিত্র, কর্তৃত্ববাদের নগ্নরূপ হাজির করেছেন। বর্তমান প্রজন্মের লাখ লাখ তরুণ তাদের ফলোয়ার হয়েছে। তারা নিজেদের মন ও মনন গঠন করেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য। আগামীতে স্থিতিশীল, ন্যায্যতাভিত্তিক সমতার বাংলাদেশ গড়তে তাদের পরামর্শ নিশ্চিত পথ দেখাবে।

আমরা একটা স্পর্শকাতর সময় পার করছি। এ অবস্থায় কতগুলো প্রশ্ন আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করার সাথে সাথেই কেন নৈরাজ্য শুরু হলো? গণভবন, সংসদ ভবন কী কোনোভাবেই রক্ষা করা যেত না? যে সকল রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতিসাধন করা হয়েছে, সেগুলো কি কোনোভাবে এড়ানো যেত? গতকাল থেকে আমরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয় ভূমিকা লক্ষ্য করছি। অনেক ধরনের পথনির্দেশনা থাকার পরেও শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার প্রক্রিয়াটি স্বাভাবিক ছিল না। সরকারবিহীন অবস্থায় অনেকটা সময় চলে গেছে। জনজীবনকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা এখন জরুরি কর্তব্য হিসেবে আমাদের সামনে উপস্থিত। সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে তাঁর ওপর ভরসা রাখতে বলেছেন। আমরা তাঁর কথায় ভরসা রাখতে চাই এবং অবস্থার দ্রুত উন্নতি চাই।

শেষ ভালো যার সব ভালো তার। আমরা যেন ভুলে না যাই মুক্তিকামী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুথানে দাবি আদায় করতে গিয়ে রাজপথে আমাদের সন্তানদের জীবন দিতে হয়েছে। এত রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশটিতে আর যেন কোনো অগণতান্ত্রিক, জবাবদিহিহীন, সাম্প্রদায়িক ও স্বৈরতন্ত্রের জন্ম না হয়। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন সমতার বাংলাদেশে আমাদের সন্তানেরা নিরাপদে বসবাস করতে পারে, সেই হোক আগামীর প্রত্যয়। আর যেন পথ না হারায় বাংলাদেশ।

লেখক: লেখক ও অধিকার কর্মী