১৫ বছরের ঋণের বোঝা আর মূল্যস্ফীতির চাপে দিশাহারা মানুষ
- আপডেট সময় : ০২:১৩:২২ অপরাহ্ন, সোমবার, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৪
- / ৩৫৮ বার পড়া হয়েছে
গত ১৫ বছরে দেশি-বিদেশি ঋণ নিয়ে দেশের অর্থনীতির অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে। তবে অভিযোগ উঠেছে এমন উন্নয়নে যে ব্যয় দেখানো হয়েছিল তার বেশিরভাগই হয়েছে আত্মসাৎ ও পাচার। ফলে একদিকে যেমন বেড়েছে ঋণের বোঝা অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির চাপে নাজেহাল হয়েছে সাধারণ মানুষ। এমন অবস্থায় অর্থনীতি সংস্কারে কাজ শুরু করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যেখানে মূল্যস্ফীতিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
দেশের অর্থনীতি কতটা উন্নত তা নির্ভর করে জীবনযাত্রার মান ও মানুষের ক্রয় ক্ষমতার উপর। যেখানে অর্থনীতির উন্নয়নের পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণে থাকে মূল্যস্ফীতি।
গত ১৫ বছরে হাতে নেয়া হয় বেশ কিছু ছোট ও বড় প্রকল্প। এগুলোর ব্যয় ধরা হয় পাঁচ লাখ কোটি টাকা। এরমধ্যে যেগুলোর কাজ শেষ হয়েছে সেগুলোর ব্যয় ছাড়িয়েছে প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা। যার বেশিরভাগ দেশি ও বিদেশি ঋণ নিয়ে করা।
এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে দেশি ঋণের বড় অংশই টাকা ছাপিয়ে দিতে হয়েছে বিদায় নেয়া সরকারকে। ফলে কমেছে টাকার মান, বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। এতে এক সময়ের ছয় শতাংশ মূল্যস্ফীতির হার ছাড়িয়েছে ১৪ শতাংশ। আর বিদেশি ঋণ ছাড়ায় সাড়ে ১৮ লাখ কোটি টাকা।
তবে, অর্থনীতির উন্নয়নে যে ব্যয় দেখানো হয়েছে তার বেশিরভাগ আত্মসাৎ এবং পাচারের অভিযোগ রয়েছে। যার পরিমাণ প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকা।
একদিকে যেমন শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ, অন্যদিকে তাদের বিশেষ সুবিধা দেয়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও ব্যাংক খাত থেকে ঋণের নামে হাতিয়ে নিয়েছে অর্থ। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য এস আলম ও সালমান এফ রহমান। যাদের কাছে এখন পর্যন্ত ব্যাংকের পাওনা পরিমাণের হিসাব পাওয়া গেছে প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা।
এছাড়া আরও বেশিকিছু ব্যক্তি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা ঋণ নিয়ে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হয়েছে। ব্যাংক খাতের মন্দ ঋণ থাকা প্রায় ছয় লাখ কোটি টাকার ৭০ শতাংশই সেগুলো।
গত ১৫ বছরের এমন লুটপাটের পতন ঘটে গত ৫ আগস্ট। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে গা ঢাকা দেয় বেশিরভাগ অর্থ পাচারকারীরা। আর বেরিয়ে আসতে থাকে একের পর এক অর্থ কেলেঙ্কারির কথা। পরবর্তীতে এই বেহাল অর্থনীতি সংস্কারের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।
গত ১৫ বছরে দেশের অর্থনীতিকে যেভাবে পঙ্গু করা হয়েছে তা স্বল্প সময়েই পুরোটা সংস্কার করা সম্ভব না বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা। তবে, স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে তা অনেকটাই পুনরুদ্ধারের পরামর্শ দিয়েছেন তারা। সেক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতিকে সবার আগে প্রাধান্য দিয়ে কমানোর কথা বলা হয়েছে। কারণ অর্থনীতির যদি ক্ষতি হয় তাহলে সবচেয়ে বেশি চাপে থাকেন সাধারণ মানুষ। আর গত দেড় যুগে উন্নয়নের যেমন অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা শোনানো হয়েছে, অপরদিকে রূপান্তর করা হয়েছে তলাবিহীন ঝুঁড়িতে।
তথ্যমতে, আর্থিক খাতে যে সংস্কার করা হবে তার মধ্যে একটি হচ্ছে সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা। সেই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ সম্পদ, সরকারি বিনিয়োগ, এডিপি, ভর্তুকি ও ঋণ এবং ঘাটতি বাজেট অর্থায়ন বিষয়াদি থাকবে। এছাড়া মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য ব্যবস্থাপনার মধ্যে থাকবে উৎপাদন, সরকারি কেনাকাটা ও খাদ্য বিতরণ। আর বাহ্যিক ভারসাম্যের মধ্যে থাকবে রপ্তানি, আমদানি, প্রবাসী আয়, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বিদেশি অর্থায়নের প্রভাব ও ঋণ।
এরই অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে মন্দ ঋণ ও পাচার হওয়া অর্থ এবং ব্যাংক খাত সংস্কারে কাজ চলমান রয়েছে। আর বিগত বছরগুলোতে রপ্তানির বিপরীতে আমদানির যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে এতে ডলার সংকটের সাথে তলানিতে নেমে এসেছে রিজার্ভ।
তাই সংস্কারের পাশাপাশি সুশাসন নিশ্চিত করা, সরকারি ব্যয়ে কমানো ও নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্প শেষ করার প্রতিও নজর দেয়ার কথা জানান বিশেষজ্ঞরা।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ডক্টর মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের এখন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এবং গুণগতমান উন্নত করতে হবে। এটা করা গেলে আমাদের অর্থনীতি সাম্প্রতিকালে যে চাপের মধ্যে পড়েছে সেটা মূল্যস্ফীতির চাপ হোক আর ব্যাংকিং খাতের ঋণখেলাপির চাপ হোক, আমাদের যে রাজস্ব আহরণ আমরা করতে পারছি না সেটার কারণে আমাদের যে একটা ঋণ নির্ভরতা হয়ে আছে। যেটা অনেক বিপদজ্জনক এবং বাধ্যতামূলক। সেটার নিরসন হবে। সে সব জায়গাতে আমাদের সুশাসন দরকার হবে।’
অপরদিকে সামগ্রিক অস্থিতিশীলতাকে অর্থনীতির বিষফোড়া বললেন অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। সেই সাথে দীর্ঘদিনের অপশাসন ও অবহেলার কারণে যে অবকাঠামো সমস্যা তৈরি হয়েছে সেগুলোর সুনির্দিষ্ট চিকিৎসার কথা জানান তিনি।
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘বর্তমানে যেটা অর্থনীতির সবচেয়ে বড় বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে সেটা হলো সামষ্টিক অস্থিতিশীলতা। অতি দ্রুত আমাদের যে সমস্যা দীর্ঘদিনের অবহেলা বা অপশাসনের কারণে তৈরি হয়েছে সেখানে কী ধরনের সংস্কার করা হবে তা করতে হবে।’
শুধু সাময়িক সংস্কার নয়, ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ক্ষতি আর না হয় সেজন্য রাজনৈতিক স্থায়ী সংস্কারের পরামর্শ বিশ্লেষকদের।