অনুড়াই হলেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট, গড়লেন ইতিহাস
- আপডেট সময় : ১০:৫২:৪৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪
- / ৩৭১ বার পড়া হয়েছে
বছর দুয়েক আগে এক টালমাটাল অবস্থায় পড়ে শ্রীলঙ্কা। চরমে ওঠে আর্থিক সংকট। তার ওপর বিপুল অঙ্কের ঋণের বোঝা। সবকিছু সামলাতে হিমশিম খায় সরকার। ওই সময় এক মার্ক্সসবাদী নেতাকে আওয়াজ তুলতে দেখা যায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে। সেই তিনিই দেশটির প্রেসিডেন্ট হবেন, ভাবতেই পারেননি কেউ!
বলা হচ্ছে শ্রীলঙ্কার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট অনুড়া কুমারা দিসানায়েকের কথা। শনিবারের নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন তিনি। আর এর মধ্য দিয়ে ক্ষমতার মসনদে বসলেন বামপন্থী এই নেতা। নির্বাচনের আগেই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন মার্ক্সসবাদী এই নেতা। নির্বাচনের আগে এক সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হবেন, শতভাগ নিশ্চিত।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট অনুড়া কী চীনপন্থী নাকি ভারতপন্থী? ভারতীয় বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যম বলছে, অনুড়া কুমার দিসানায়েকে চীনপন্থী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এর অন্যতম কারণ তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দু বলছে, মার্ক্সিস্ট পার্টি জানাথা ভিমুক্তি পেরামুনার (জেভিপি) নেতা এই অনুড়া।
শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোট গণনায় প্রথম ধাপে কোনো প্রার্থীই ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পাননি। এ কারণে দ্বিতীয় ধাপে গড়ায় নির্বাচনের ভোট গণনা। এর আগে কখনো দেশটিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দ্বিতীয় ধাপে যায়নি।
ভোটারদের আগে থেকেই ভোট দেওয়ার সময় পছন্দক্রম অনুযায়ী তিনজন প্রার্থীকে বেছে নিতে বলা হয়েছিল। ভোটাররা দ্বিতীয় ও তৃতীয় পছন্দ হিসেবে কাকে কাকে ভোট দিয়েছেন, সেটি গণনা করে নির্বাচন কমিশন। এর প্রেক্ষিতে নির্বাচন হয় প্রেসিডেন্ট। তাতে প্রেসিডেন্ট হন বামপন্থী অনুড়া কুমার দিসানায়েক।
ছাত্রজীবন থেকেই বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কৃষক পরিবারের সন্তান অনুড়া কুমারা দিসানায়েকে। তবে বাবা একসময় সরকারি অফিসে সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। ওই সময় বাম জোট পিপলস লিবারেশন ফ্রন্টের (জেভিপি) ছাত্র শাখায় যুক্ত ছিলেন অনুড়া। তার এই জোট মার্ক্সসবাদী ও লেলিনবাদী হিসেবে পরিচিত।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দু বলছে, এক আত্মীয় বড় ভাইয়ের মাধ্যমে বাম রাজনীতিতে আসেন অনুড়া। ১৯৮৮ সালে তাঁর ভাই সরকারের একটি বিশেষ সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে নিহত হন। পরিবারের সদস্যরা বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় আশির দশকে বাড়িতেও হানা দেয় সরকারি বাহিনী। এমনকি বিরোধীদের দমন করতে সরকারের বিভিন্ন ‘হত্যাকাণ্ড’ প্রত্যক্ষ করেন সেই তরুণ বয়স থেকেই। এরপরই তিনি পাকাপোক্তভাবে যুক্ত হন জেভিপিতে। যদিও এই জেভিপির সহিংস ইতিহাস রয়েছে বলেই অভিযোগ পাওয়া যায়।
অনুড়াই হলেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট, গড়লেন ইতিহাসঅনুড়াই হলেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট, গড়লেন ইতিহাস
এরপর রাজনীতির জল গড়াতে থাকে। ২০০০ সালে প্রথমবার পার্লামেন্টে জায়গা হয় অনুড়ার। প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা বন্দরনায়েকের নেতৃত্বে গঠিত সরকারে তিনি হন কৃষিমন্ত্রী। ২০১৪ সালে দায়িত্ব পান জেভিপির।
এই নেতার ব্যাপারে বলতে গিয়ে তাঁর রাজনৈতিক সঙ্গী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু ভিজিথ হেরাথ বলেন, ‘আমাদের দল কিন্তু নেতাকেন্দ্রিক নয়। আমাদের দলে সবার মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। আর এসব মত নিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে অনুড়া বিশেষ পারদর্শী।’
২০১৮ সালে পার্লামেন্টে মোট ২২৫ জনের মধ্যে জেভিপির মাত্র ৬ জন এমপি ছিলেন। এরপরও তাঁরা বেশ আওয়াজ তুলতে পারতেন। এর অন্যতম কারণ এই অনুড়া। পরে তাঁরা জোট করে বামদের নিয়ে গঠন করেন ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি)। তাতে যুক্ত হয় ২৪টি সংগঠন ও দল।
২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন অনুড়া। নির্বাচনী প্রচারে ব্যাপক জোয়ার হয়। আশা করেছিলেন ভালোই করবেন। তবে মাত্র ৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন ওই সময়।
সমাজের মানুষদের বাম রাজনীতির প্রতি একটু বাঁকা চোখে তাকানো নিয়ে ভাবতে থাকেন অনুড়া। এরপর তিনি মানুষদের যুক্ত করে জোটকে শক্ত করার কাজে হাত দেন। দলে টানেন সমাজের বিভিন্ন গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় মানুষদের। এরা বিভিন্ন পেশায় যুক্ত। আর যুক্ত করেন সমাজের নিচু স্তরের লোকদেরকেও।
এ ব্যাপারে অনুড়া দ্য হিন্দুকে বলেছিলেন, ‘বামদের নিয়ে সবাই ভুল বোঝে। অথচ বাম রাজনীতি কিন্তু খারাপ না। এটি বেশ ভালো জিনিস। কয়েকজন এটাকে ধ্বংস করেছেন। এ কারণে আমরা এখন মানুষদের নিয়ে বেশি কাজ করা শুরু করেছি।’
২০২২ সালে অর্থনীতি ভেঙে পড়ার পর নিত্যপণ্যের ব্যাপক ঘাটতি এবং আকাশছোঁয়া মূল্যস্ফীতি দেখা দেয় শ্রীলঙ্কাতে। মূলত সে সময়ই তাঁর জোট এনপিপির জন্য টার্নিং পয়েন্ট হয়ে দাঁড়ায়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব উপস্থিতি দিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি।
রাজাপক্ষে ভাইদের পদত্যাগে তৈরি হওয়া ক্ষমতার শূন্যতা দিসানায়েকে এবং তাঁর দলের জন্য বৃহত্তর পরিবর্তনের পথ প্রশস্ত করে দেয়। প্রতিনিয়ত সামাজিক ন্যায়বিচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের কঠোর অবস্থান দেশটির জনগণকে আকৃষ্ট করে।
এ ছাড়া নিজের নির্বাচনীয় প্রচারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সুশাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রস্থলে পৌঁছান অনুড়া কুমারা দিসানায়েকে।
রাজধানী কলম্বো থেকে ১৭৭ কিলোমিটার দূরে অনুরাধাপুরা জেলার থামবুটেগামা গ্রামে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে ১৯৬৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন দিসানায়েকে। কেলানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে ডিগ্রি নিয়ে স্নাতক হন তিনি।
২০১৪ সালে দিসানায়েককে দল বিমুক্তি পেরেমুনাতে (জেভিপি) নেতা হিসেবে নিযুক্ত পাওয়ার পর থেকে তিনি দলের ভাবমূর্তিটিকে উন্নত করার লক্ষ্যে একে সহিংস অতীত থেকে বের করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এবার দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতেছেন ৫৫ বছর বয়সী অনুড়া। বিবিসি বলছে, রোববার প্রথম ধাপে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোট গণনায় কোনো প্রার্থীই ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পাননি। এ কারণে দ্বিতীয় ধাপে গড়ায় নির্বাচনের ভোট গণনা। এর আগে কখনো দেশটিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দ্বিতীয় ধাপে যায়নি।
ভোটারদের আগে থেকেই ভোট দেওয়ার সময় পছন্দক্রম অনুযায়ী তিনজন প্রার্থীকে বেছে নিতে বলা হয়েছিল। ভোটাররা দ্বিতীয় ও তৃতীয় পছন্দ হিসেবে কাকে কাকে ভোট দিয়েছেন, সেটি গণনা করে নির্বাচন কমিশন। এর পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন হয় প্রেসিডেন্ট। তাতে প্রেসিডেন্ট হন বামপন্থী অনুড়া কুমার দিসানায়েক।
এর আগে প্রথম ধাপের ভোট গণনায় এগিয়ে ছিলেন বাম জোট পিপলস লিবারেশন ফ্রন্টের (জেভিপি) নেতা অনুড়া কুমার দিসানায়েক। বামপন্থী এই নেতা ৪২ দশমিক ৩১ শতাংশ ভোট পান। এরপর তালিকায় দ্বিতীয় ছিলেন সাজিদ প্রেমাদাসা (৩২ দশমিক ৭৬ শতাংশ)। রনিল বিক্রমাসিংহে পেয়েছেন ১৭ শতাংশ ভোট। এ তালিকায় তিনি তৃতীয়।
গতকাল শনিবার শ্রীলঙ্কার ২২টি আসনের ১৩ হাজার ৪০০ ভোটকেন্দ্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোট হয়। গণঅভ্যুত্থানে গোতাবায়া রাজাপক্ষের সরকারের পতনের পর এই প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হলো শ্রীলঙ্কায়। স্থানীয় সময় শনিবার সকাল ৭টায় ভোটগ্রহণ শুরু হয়। শেষ হয় বিকেল চারটায়। এদিকে ভোট শেষ হওয়ার পর শনিবার রাতে শ্রীলঙ্কার কারফিউ ঘোষণা করা হয়।
পুলিশ জানায়, জননিরাপত্তার স্বার্থে আট ঘণ্টার কারফিউ জারি করে তারা। পরে আজ রোববার এই কারফিউ শিথিল করা হয়।