ঢাকা ০৩:৫৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

সাগর-নদীর বাংলাদেশ সীমানায় কেন কমছে ইলিশ?

অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট সময় : ০১:৪৪:৩৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২ অক্টোবর ২০২৪
  • / ৩৭০ বার পড়া হয়েছে
৭১ নিউজ বিডির সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

সাগর কিংবা নদী, বাংলাদেশ সীমানায় দিনকে দিন কমছে ইলিশের পরিমাণ। প্রতিবেশী দেশের রপ্তানি কিংবা পাচারের বাইরে আহরণ আর চাহিদার এই মারপ্যাঁচে চড়া হচ্ছে ইলিশের বাজার। কিন্তু কেন কমছে ইলিশ? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর জন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের দায় আছে তবে প্রধান সমস্যা নদীদূষণ কিংবা ইলিশের প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস। তারা শঙ্কা করছেন, দূষণ বন্ধ করতে না পারলে, পরিযায়ী এই মাছটি ভিন্ন দেশেও চলে যেতে পারে।

এটা ঠিক, ইলিশের কোন উৎপাদন খরচ নেই কারণ, সামুদ্রিক মাছ ইলিশের বাণিজ্যিক চাষ এখনও শুরু করা যায়নি এবং বছরজুড়ে যে ৫ থেকে ৬ লক্ষ টন ইলিশ আহরণ করা হয়, তার প্রায় অর্ধেক নদী থেকে আর অর্ধেক সমুদ্র থেকে আহরণ করা হয়। বড় দাগে সমুদ্র থেকে যে ৩টি পথ ধরে বাংলাদেশের নদীগুলোতে ঢুকে ইলিশ তা হলো পটুয়াখালির আন্ধারমানিক, চাঁদপুরের মেঘনা এবং চট্টগ্রামের কর্ণফুলী।

প্রধানত, প্রজননের জন্য বঙ্গোপসাগর থেকে ১২শ’ থেকে ১৩শ’ কিলোমিটার পাড়ি দেয় ইলিশ। এবং ঢাকার কাছাকাছি হিসেবে পদ্মা নদীর এই মাওয়া পয়েন্ট ইলিশ ধরা ও অবতরণের জন্য বেশ পরিচিত। মধ্য আশ্বিনের এই সন্ধ্যায় আমরা দেখছি, আশপাশ থেকে ইলিশ ধরতে নদীতে নামছে জেলেরা। রাত যত গড়াবে জেলেদের পরিমাণ তত বাড়তে থাকবে।

ভোর থেকে ৮টা সাড়ে সাড়ে ৮টা পর্যন্ত চলে মাওয়ার এই আড়ত এবং সব মিলিয়ে এখানে যে চিত্রটা দেখা গেলো, এই আড়তে পদ্মার ইলিশ একদমই কম। চাঁদপুর ও ভোলা থেকে আসা ইলিশই বেশি। এখানেও আড়তদাররা বলছেন, দিনকে দিন মাছ কমছে।

ইলিশের জন্য বিখ্যাত চাঁদপুরের ডাকে বিক্রি হওয়া ইলিশগুলোর দরও এখানে কম নয়। দেড় থেকে ২ কেজি ওজনের ইলিশগুলোর ডাক উঠছে ১৭শ’ থেকে ১৮শ’ টাকায়। ২শ’ থেকে ৩শ’ গ্রাম ইলিশগুলো বিক্রি হচ্ছে ৩শ’ থেকে ৪শ’ টাকায়। সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ লক্ষ টাকার বিকিকিনি হয় এই আড়তটিতে।

আড়তদারদের একজন বলেন, ‘২০২১ সালে প্রচুর মাছ ছিল। ২০২২ সাল থেকে মাছ কমতে শুরু করে। ২০২৩ সাল থেকে ২০২৪ সালে ইলিশ মাছ কমেছে ৫০ শতাংশের মতো।’

আহরণের বিপরীতে চাহিদা বাড়ার একটা প্রভাব ইলিশের বাজারে পড়ছে, ব্যবসায়ী ও জেলেদের এই দাবি তাদের বক্তব্যে স্পষ্ট। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ইলিশের আহরণ কমছে কেন? ইলিশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর প্রধান কারণ উপকূল এবং নদীতে ইলিশের প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস হওয়া।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ এম সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘যখন ডিম থেকে খাবার উপযোগী হয়ে যায় তখন উদ্ভিদ ও প্রাণিকনা যাকে পেতে থাকে তাকে খায় এবং বড় হতে হয়। যখন নদীতে দূর্ষণ হয় তখন এইসব খাবার ইলিশের পোনা পায় না তখন মারা যায়।’

কিন্তু এ নিয়ে কি কোনো উদ্যোগ আছে সরকারিভাবে? সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বলছেন, তারা মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়ের দূরত্ব ঘোচানোর চেষ্টা করছেন।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, ‘আমরা যে আন্ত: মন্ত্রণালয় মিটিং করি সেখানে যদি পরস্পরের সাথে সমন্বয় করতে পারি তাহলে এই সরকার নতুন কিছু সৃষ্টি করার আছে যেখানে নতুনভাবে কাজ করা যাবে।’

সরকারি হিসেবে অবশ্য, এক বছর আগ পর্যন্ত ইলিশ আহরণে ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছিল। যদিও সবশেষ অর্থবছরের খসড়া হিসেবে, ইলিশের আহরণের পরিমাণ কমপক্ষে ৪১ হাজার মেট্রিক কম দেখানো হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, ভারতে ইলিশ রপ্তানির অনুমতি ও অবৈধপথে ভারতে ইলিশ পাচার হয়ে যাবার বিষয়ে সরকারের বক্তব্য কী?

উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, ‘ইলিশ যেমন প্রাকৃতিকভাবে নদীতে আছে তেমন অপ্রাকৃতিকভাবে ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে চলে যাচ্ছে। এইদিক গুলো চিহ্নিত করে আমরা ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা করছি।’

সরকার আশা করছে, অমাবস্যা পূর্ণিমার যে প্রভাবের কারণে ইলিশ আহরণ প্রভাবিত হয়, সে হিসেবে অক্টোবরের শুরুর দিকে বেশি পরিমাণে ইলিশ ধরা পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া, ভারতের সঙ্গে মিল রেখে নতুন করে ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতেও ইলিশের প্রজনন ও আহরণ বাড়বে বলে মনে করেন এই উপদেষ্টা।

বলতে গেলে, ইলিশ বাদে আর কোনো সামুদ্রিক মাছ এতটা পথ পাড়ি দিয়ে নদী ভ্রমণে আসে না। পুষ্টিবিদরা বলছেন, নদীময় বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে যে ইলিশ তা শুধু খেতে প্রিয় তা নয়, সমুদ্রপুষ্টির বিশুদ্ধ উৎসও।

পুষ্টিবিদ ইসরাত জাহান নাদিয়া বলেন, ‘আমাদের দেশের বাচ্চাদের স্বাভাবিক আইকিউ থাকে না। আয়োডিনের মতো খনিজ লবণ আমরা ইলিশ খাওয়ার মাধ্যমে পূরণ করতে পারি।’

কিন্তু বাজার তো সহায় নয়। এই ভরা মৌসুমেও যে বাজারের থলেতে অন্তত একটা ইলিশ ঢুকছে না, তা নিয়ে কত আক্ষেপ মানুষদের।

বিক্রেতাদের একজন বলেন, ‘১ কেজির ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১৬শ’ টাকায়। আধা কেজির মাছ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার টাকা কেজিতে।

ক্রেতাদের একজন বলেন, ‘এত দাম দিয়ে ইলিশ কীভাবে খাবো। ভারতে ইলিশ মাছ দেয় আর আমরা ইলিশ মাছ ধরতে পারি না।’

নিউজটি শেয়ার করুন

সাগর-নদীর বাংলাদেশ সীমানায় কেন কমছে ইলিশ?

আপডেট সময় : ০১:৪৪:৩৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২ অক্টোবর ২০২৪

সাগর কিংবা নদী, বাংলাদেশ সীমানায় দিনকে দিন কমছে ইলিশের পরিমাণ। প্রতিবেশী দেশের রপ্তানি কিংবা পাচারের বাইরে আহরণ আর চাহিদার এই মারপ্যাঁচে চড়া হচ্ছে ইলিশের বাজার। কিন্তু কেন কমছে ইলিশ? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর জন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের দায় আছে তবে প্রধান সমস্যা নদীদূষণ কিংবা ইলিশের প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস। তারা শঙ্কা করছেন, দূষণ বন্ধ করতে না পারলে, পরিযায়ী এই মাছটি ভিন্ন দেশেও চলে যেতে পারে।

এটা ঠিক, ইলিশের কোন উৎপাদন খরচ নেই কারণ, সামুদ্রিক মাছ ইলিশের বাণিজ্যিক চাষ এখনও শুরু করা যায়নি এবং বছরজুড়ে যে ৫ থেকে ৬ লক্ষ টন ইলিশ আহরণ করা হয়, তার প্রায় অর্ধেক নদী থেকে আর অর্ধেক সমুদ্র থেকে আহরণ করা হয়। বড় দাগে সমুদ্র থেকে যে ৩টি পথ ধরে বাংলাদেশের নদীগুলোতে ঢুকে ইলিশ তা হলো পটুয়াখালির আন্ধারমানিক, চাঁদপুরের মেঘনা এবং চট্টগ্রামের কর্ণফুলী।

প্রধানত, প্রজননের জন্য বঙ্গোপসাগর থেকে ১২শ’ থেকে ১৩শ’ কিলোমিটার পাড়ি দেয় ইলিশ। এবং ঢাকার কাছাকাছি হিসেবে পদ্মা নদীর এই মাওয়া পয়েন্ট ইলিশ ধরা ও অবতরণের জন্য বেশ পরিচিত। মধ্য আশ্বিনের এই সন্ধ্যায় আমরা দেখছি, আশপাশ থেকে ইলিশ ধরতে নদীতে নামছে জেলেরা। রাত যত গড়াবে জেলেদের পরিমাণ তত বাড়তে থাকবে।

ভোর থেকে ৮টা সাড়ে সাড়ে ৮টা পর্যন্ত চলে মাওয়ার এই আড়ত এবং সব মিলিয়ে এখানে যে চিত্রটা দেখা গেলো, এই আড়তে পদ্মার ইলিশ একদমই কম। চাঁদপুর ও ভোলা থেকে আসা ইলিশই বেশি। এখানেও আড়তদাররা বলছেন, দিনকে দিন মাছ কমছে।

ইলিশের জন্য বিখ্যাত চাঁদপুরের ডাকে বিক্রি হওয়া ইলিশগুলোর দরও এখানে কম নয়। দেড় থেকে ২ কেজি ওজনের ইলিশগুলোর ডাক উঠছে ১৭শ’ থেকে ১৮শ’ টাকায়। ২শ’ থেকে ৩শ’ গ্রাম ইলিশগুলো বিক্রি হচ্ছে ৩শ’ থেকে ৪শ’ টাকায়। সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ লক্ষ টাকার বিকিকিনি হয় এই আড়তটিতে।

আড়তদারদের একজন বলেন, ‘২০২১ সালে প্রচুর মাছ ছিল। ২০২২ সাল থেকে মাছ কমতে শুরু করে। ২০২৩ সাল থেকে ২০২৪ সালে ইলিশ মাছ কমেছে ৫০ শতাংশের মতো।’

আহরণের বিপরীতে চাহিদা বাড়ার একটা প্রভাব ইলিশের বাজারে পড়ছে, ব্যবসায়ী ও জেলেদের এই দাবি তাদের বক্তব্যে স্পষ্ট। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ইলিশের আহরণ কমছে কেন? ইলিশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর প্রধান কারণ উপকূল এবং নদীতে ইলিশের প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস হওয়া।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ এম সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘যখন ডিম থেকে খাবার উপযোগী হয়ে যায় তখন উদ্ভিদ ও প্রাণিকনা যাকে পেতে থাকে তাকে খায় এবং বড় হতে হয়। যখন নদীতে দূর্ষণ হয় তখন এইসব খাবার ইলিশের পোনা পায় না তখন মারা যায়।’

কিন্তু এ নিয়ে কি কোনো উদ্যোগ আছে সরকারিভাবে? সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বলছেন, তারা মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়ের দূরত্ব ঘোচানোর চেষ্টা করছেন।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, ‘আমরা যে আন্ত: মন্ত্রণালয় মিটিং করি সেখানে যদি পরস্পরের সাথে সমন্বয় করতে পারি তাহলে এই সরকার নতুন কিছু সৃষ্টি করার আছে যেখানে নতুনভাবে কাজ করা যাবে।’

সরকারি হিসেবে অবশ্য, এক বছর আগ পর্যন্ত ইলিশ আহরণে ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছিল। যদিও সবশেষ অর্থবছরের খসড়া হিসেবে, ইলিশের আহরণের পরিমাণ কমপক্ষে ৪১ হাজার মেট্রিক কম দেখানো হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, ভারতে ইলিশ রপ্তানির অনুমতি ও অবৈধপথে ভারতে ইলিশ পাচার হয়ে যাবার বিষয়ে সরকারের বক্তব্য কী?

উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, ‘ইলিশ যেমন প্রাকৃতিকভাবে নদীতে আছে তেমন অপ্রাকৃতিকভাবে ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে চলে যাচ্ছে। এইদিক গুলো চিহ্নিত করে আমরা ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা করছি।’

সরকার আশা করছে, অমাবস্যা পূর্ণিমার যে প্রভাবের কারণে ইলিশ আহরণ প্রভাবিত হয়, সে হিসেবে অক্টোবরের শুরুর দিকে বেশি পরিমাণে ইলিশ ধরা পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া, ভারতের সঙ্গে মিল রেখে নতুন করে ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতেও ইলিশের প্রজনন ও আহরণ বাড়বে বলে মনে করেন এই উপদেষ্টা।

বলতে গেলে, ইলিশ বাদে আর কোনো সামুদ্রিক মাছ এতটা পথ পাড়ি দিয়ে নদী ভ্রমণে আসে না। পুষ্টিবিদরা বলছেন, নদীময় বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে যে ইলিশ তা শুধু খেতে প্রিয় তা নয়, সমুদ্রপুষ্টির বিশুদ্ধ উৎসও।

পুষ্টিবিদ ইসরাত জাহান নাদিয়া বলেন, ‘আমাদের দেশের বাচ্চাদের স্বাভাবিক আইকিউ থাকে না। আয়োডিনের মতো খনিজ লবণ আমরা ইলিশ খাওয়ার মাধ্যমে পূরণ করতে পারি।’

কিন্তু বাজার তো সহায় নয়। এই ভরা মৌসুমেও যে বাজারের থলেতে অন্তত একটা ইলিশ ঢুকছে না, তা নিয়ে কত আক্ষেপ মানুষদের।

বিক্রেতাদের একজন বলেন, ‘১ কেজির ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১৬শ’ টাকায়। আধা কেজির মাছ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার টাকা কেজিতে।

ক্রেতাদের একজন বলেন, ‘এত দাম দিয়ে ইলিশ কীভাবে খাবো। ভারতে ইলিশ মাছ দেয় আর আমরা ইলিশ মাছ ধরতে পারি না।’