আ.লীগ আমলের আলোচিত মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ কী?
- আপডেট সময় : ০১:৩৬:১৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ১১ নভেম্বর ২০২৪
- / ৩৪৯ বার পড়া হয়েছে
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে দেশে বেশকিছু আলোচিত মামলা ছিল। আলোচিত এসব মামলার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, পিকে হালদারের অর্থ আত্মসাৎ ও সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড উল্লেখযোগ্য। এসব ঘটনায় মামলা হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জড়িত ব্যক্তিরা ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিছু ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয় তদন্তের আগেই। আবার সমালোচনার মুখে কিছু ঘটনার তদন্ত শুরু হলেও বেশি দূর এগোয়নি। স্থবির হয়ে পড়ে ছিল। এছাড়া রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তদন্তের গতিপথ পাল্টে দেয়ার অভিযোগ তো ছিলোই।
এমতাবস্থায় দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আলোচিত এই মামলাগুলোর অগ্রগতি নিয়ে আবারও সম্ভাবনা তৈরি হয়। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাস অতিবাহিত হলেও আলোচিত এসব মামলার তদন্তে কোনো অগ্রগতি দৃশ্যমান হয়নি। তাহলে এসব মামলার ভবিষ্যৎ কী?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যত দ্রুত সম্ভব জড়িত ব্যক্তিদের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। নইলে এ ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি ঠেকানো সম্ভব হবে না।
আওয়ামী লীগের আমলে আলোচিত মামলার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, পিকে হালদারের অর্থ আত্মসাৎ ও সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে রিজার্ভের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির মামলার তদন্ত শেষ হয়নি আট বছরেও। শেষ হয়নি প্রশান্ত কুমার হালদারের ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের ঘটনায় দায়ের হওয়া অর্ধশতাধিক মামলার তদন্ত। অন্যদিকে সাগর-রুনি হত্যা মামলায় ১১১ বার সময় দেয়ার পরও আদালতে জমা পড়েনি তদন্ত প্রতিবেদন।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ জানান, ‘যেকোনো মামলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ সুষ্ঠু তদন্ত। এক্ষেত্রে আদালত তদন্তকারী কর্মকর্তাকে একটা সময় বেঁধে দেন। কিন্তু আমরা দেখছি বেশির ভাগ মামলায় বেঁধে দেয়া সময়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়ছে না।’
২০১৪ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এর দুই বছরের মাথায় ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফেডারেল রিজার্ভের নিউইয়র্ক শাখায় বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে ১০০ কোটি ডলার চুরির চেষ্টা চালায় অপরাধীরা। এর মধ্যে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার লোপাট করতে সক্ষম হয় তারা।
আলোচিত এ ঘটনার মামলায় তদন্তের গতিপথ পাল্টে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে। রিজার্ভ চুরির মামলার তদন্তের ক্ষেত্রেও এমন অভিযোগ ওঠে। তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২০ সালের ১ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রিজার্ভ চুরির বিষয়ে একটি সভা হয়। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নেতৃত্বে সভায় উপস্থিত ছিলেন সে সময়ের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ততদিনে ওই ঘটনার তদন্ত কার্যক্রম প্রায় শেষ করে এনেছে। কিন্তু ঠিক ওই মুহূর্তে তদন্তের গতিপথ বদলে দেয়ার জন্য তদন্তকারী সংস্থার ওপর চাপ প্রয়োগ করেন দুই মন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক বিভাগের তৎকালীন দুই সচিব।
যেকোনো ঘটনার তদন্তে প্রভাব ফেলার বিষয়ে সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘সাধারণত রাজনৈতিক ব্যক্তিরা নানাভাবে মামলার তদন্তকাজকে বিভিন্ন সময় প্রভাবিত করে থাকেন। কিন্তু এখন যেহেতু দেশে কোনো রাজনৈতিক সরকার নেই, তাই প্রভাব বিস্তারেরও কোনো সুযোগ নেই। এ সময়ে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে জমে থাকা মামলার প্রতিবেদন আদালতে দিয়ে বিচারকাজ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি পুলিশের পক্ষ থেকে মামলাজট কমিয়ে আনতে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম হাতে নিতে হবে।’
জালিয়াতি করে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও ফাইন্যান্সিয়াল লিমিটেড থেকে ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে প্রশান্ত কুমার হালদারসহ (পিকে হালদার) ৮৬ জনকে আসামি করে ২০২১ সালে ৫২টি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর মধ্যে একটির চার্জশিট দাখিল হলেও বাকি ৫১টি মামলায় এখনো তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল হয়নি। ফলে পিকে হালদারের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করার বিষয়টি নিয়ে একধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর ও রুনি। খুনের ঘটনার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন (প্রয়াত) বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেফতার করা হবে। খুনের দুদিন পর পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছিলেন, তদন্তের ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। এরপর ২০১৭ সালের ১৫ মার্চ র্যাবের পক্ষ থেকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী মাহিরের জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছে। ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে আটজনকে।
এমন অবস্থায় মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার ১১১তম দিন ছিল গত ১৫ অক্টোবর। কিন্তু এদিন মামলার তদন্ত সংস্থা র্যাব প্রতিবেদন দাখিল করেনি।
তদন্তের গতি সম্পর্কে সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘এখানে আমাদের দেখতে হবে একটা মামলার তদন্তের যৌক্তিক সময় কতটুকু। বছরের পর বছর তদন্ত চলতে পারে না। এক্ষেত্রে যদি কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া না যায় সেটি আদালতকে জানিয়ে তদন্ত শেষ করতে হবে।’
সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ পুলিশের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর জানান, ‘যেকোনো মামলার ক্ষেত্রেই তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করা গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। তদন্ত শেষ করার মধ্য দিয়ে মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়। এছাড়া তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধী চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া যায়। যেসব মামলার তদন্ত স্থবির হয়ে রয়েছে, সেগুলোকে দ্রুত চিহ্নিত করে তদন্তকাজ এগিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দ্রুত সময়েই এসব মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা সম্ভব হবে।’