অ্যাভিয়েশন হাব বানানোর নামে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নিয়ে লুটপাট
- আপডেট সময় : ১২:২৬:০৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪
- / ৩৪৫ বার পড়া হয়েছে
গত ১৫ বছরে কোনো প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে ৬ দফা, কোনোটির আবার খরচ বেড়েছে ২ থেকে ৭ গুণ পর্যন্ত। ২২ শতাংশ কাজ এগোনোর পরে নকশায় ভুল দেখিয়ে বন্ধ করা হয়েছে কোনো প্রকল্পের কাজ। এসব ঘটেছে অ্যাভিয়েশন হাব বানানোর নামে দেশের ৮টি বিমানবন্দরের উন্নয়ন প্রকল্পে। আর দেশের এয়ারলাইন্সগুলোর আকাশপথের বাজারের দখল হ্রাস পেয়ে নেমেছে ২০ শতাংশের নিচে। এসেছে ১০টিরও বেশি বিদেশি এয়ারলাইন্স। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নিয়ে লুটপাট করাই ছিল গেল ১৫ বছরে সরকার ঘনিষ্ঠদের মূল লক্ষ্য। অ্যাভিয়েশন হাব তো দূরের কথা, বরং উল্টোপথে হেঁটেছে দেশের আকাশ ব্যবসা।
বাংলাদেশ হবে অ্যাভিয়েশন হাব। গেল সরকারের সবচেয়ে জনপ্রিয় ন্যারেটিভগুলোর একটি। সেই ধারাবাহিকতায় দেশের ৮ বিমানবন্দরে ১৫টি প্রকল্পের আওতায় ৩২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হয়েছিল। টাকার অঙ্কে যা পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়ের চেয়েও বেশি। কিন্তু বিপুল এই অর্থ ব্যয়ে কতটা এগিয়েছে দেশের আকাশপথ? নাকি শুধুই দৃশ্যমান উন্নয়ন দেখানোর আয়োজন?
অ্যাভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অব.) মফিজুর রহমান বলেন, ‘একটা অ্যাভিয়েশন হাব হওয়ার জন্য পলিসিগত পরিবর্তন লাগে সেগুলো না করে দৃশ্যত কিছু অবকাঠামো তৈরি করা কিন্তু অ্যাভিয়েশন হওয়ার যোগ্য না।’
অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ উইং কমান্ডার (অব.) এটিএম নজরুল ইসলাম বলেন, ‘কানেক্টিভিটি যত ভালো হবে অ্যাভিয়েশন হাবের তাৎপর্য তত আসবে, তাছাড়া শুধু হাব বলে শুধু হোম করলে সেটা কিন্তু হাব হবে না।’
২০১৭ সালে একনেকে টার্মিনালটির জন্য পাশ করা হয়েছিল ১৩ হাজার কোটি টাকা। সেই ব্যয় এখন বেড়ে হয়েছে ২১ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। বেবিচক সূত্র বলছে, নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতো না পারায় আরও প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা বাড়তে পারে এই টার্মিনালের খরচ। তাতে কাজ শেষ হতে মূল ব্যয়ের প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে এর খরচ।
অতিরিক্ত ব্যয়ের পাশাপাশি টার্মিনালটির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা রানওয়ে না থাকা। বলা হচ্ছে বছরে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ যাত্রীসেবা দিতে পারবে নতুন এই টার্মিনাল। যেখানে কোটি খানেক যাত্রীকে সেবা দিতেই হিমশিম খাচ্ছে বর্তমান রানওয়েটি সেখানে আরও এক কোটি যাত্রী কীভাবে সেবা দেযা যাবে তার কোনো রূপরেখা নেই।
অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ উইং কমান্ডার (অব.) এটিএম নজরুল ইসলাম আরো বলেন, ‘১ কোটি ২০ লাখ যাত্রী যে বছরে আনা হবে, সেখানে আমার রান কোথায়? আমার এ মুহূর্তে রান ক্যাপাসিটি নাই। কিন্তু এটা কীভাবে বানানো হবে এ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, কখন বলা হয়েছে আরেকটা রানওয়ে করে ফেলবো, ওখানে করে ফেলবো এগুলো মূলত আসলে বাজে কথা কারণ এটা করা সম্ভব না। ’
এবার চোখ দেয়া যাক ঢাকার বাইরের বিমানবন্দরগুলোর দিকে। সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণে হাতে নেয়া হয়েছিল ২ হাজার ৩০৯ কোটি ৭৯ লাখ টাকার প্রকল্প। ২২ শতাংশ কাজ আগানোর পর নকশায় ভুল দেখিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়। ৮ মাস পর ফের নতুন করে শুরু হওয়ায় প্রকল্পের সময় ২ বছর বাড়ার পাশাপাশি ও ব্যয়ও বাড়ছে হাজার কোটি টাকা।
কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক করার নামে ৩০২ কোটি টাকার প্রকল্প ব্যয় ৬ দফায় বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ১৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। ২০০৯ সালে নেয়া প্রকল্পটি শেষ করা যায়নি ১৫ বছরেও। আর রানওয়ে সম্প্রসারণের ব্যয় শুরুতে ১ হাজার ৫৬৭ কোটি থাকলেও পরে বেড়ে যায় ২২৫ কোটি টাকা।
চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে ৫৪০ কোটি, সৈয়দপুর ও রাজশাহী বিমানবন্দরের ৫৩০ কোটি, বরিশাল বিমানবন্দরের ৩৭০ কোটি ও যশোর বিমানবন্দরের ৩২ কোটি টাকার প্রকল্পের কোনোটাই শেষ হয়নি নির্ধারিত সময়ে।
অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ উইং কমান্ডার (অব.) এটিএম নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের উন্নয়নের যে দর্শন বিগত দশ বছরে ছিল সেরকমই খাপ ছাড়া ও বেহিসাবি আমি বলবো। আসল কাজ যেটা অ্যাভিয়েশন গ্রোথ এবং সাসটেইনেবিলিটি না দেখে আমরা একটা কসমেটিক্স উন্নয়নের ধোয়া আমরা তুলেছে।’
বিমানবন্দরগুলোতে যেমন উন্নয়নের নামে লুটপাট চলেছে তেমনি ধুঁকতে হয়েছে বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলোকে। গেলো ১৫ বছরে জিএমজি, ইউনাইটেড ও রিজেন্ট এয়ারওয়েজের মতো বড় তিনটি এয়ারলাইন্স বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হবার আগে এই তিন এয়ারলাইন্সের ছিল ২০ টি উড়োজাহাজ আর ২৮ টি রুট।
ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) কামরুল ইসলাম বলেন, ‘গত ১৫ বছরে আমরা দেখেছি অনেকগুলো এয়ারলাইন্স বন্ধ হয়ে গেছে। এসব এয়ারলাইন্সের পলিসিগত সমস্যা ও মার্কেটিং স্ট্রাটেজির ভুলের কারণে হয়তো বন্ধ হয়েছে তবে মূল সমস্যা কিন্তু আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি ছিল পলিসিগত সমস্যা।’
দেশের এয়ারলাইন্সগুলোর দিকে না তাকিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গুরুত্ব দিয়েছে বিদেশি এয়ারলাইন্স আনতে। এই ১৫ বছরে বাংলাদেশে এসেছে ১০ টির বেশি বিদেশি এয়ারলাইন্স। তাতে দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলোর বাজার কমতে কমতে নেমেছে ২০ শতাংশ এর নিচে।
ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) কামরুল ইসলাম আরো বলেন, ‘ নতুন জয়েন করেছে ইজিপ্ট এয়ার, চায়না এয়ার, ইথোপিয়ান এয়ারলাইন্স। আসলে দিন যত যাচ্ছে বাংলাদেশি এয়ার ক্যারিয়ারের আন্তর্জাতিক বাজারে শেয়ার কমছে।’
এছাড়াও পদ্মা অয়েলকে একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগ দিয়ে সিন্ডিকেট করে জেট ফুয়েলের দাম বাড়ানো, বিমানের সাথে বেসরকারি এয়ারলাইন্সের অসম প্রতিযোগিতা, কারসাজি করে বিমানের টিকিটের দাম বাড়ানো, বিমান চলাচল চুক্তিতে দেশের স্বার্থ চিন্তা না করা ছিল অহরহ ঘটনা।