ঢাকা ০৭:০২ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২৫, ২৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বাংলা বাংলা English English हिन्दी हिन्दी

ওয়ান ইলেভেনের ঘটনা সংবাদপত্রে যেভাবে এসেছিলো

অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট সময় : ০১:০১:১৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২৫
  • / ৩৫১ বার পড়া হয়েছে
৭১ নিউজ বিডির সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

বাংলাদেশে নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন- এই ইস্যুতে শুরু হওয়া আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ভয়াবহ রাজনৈতিক সহিংসতার জের ধরে ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারিতে জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিলো, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘ওয়ান ইলেভেন’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

আওয়ামী লীগসহ সমমনা দলগুলোর দাবি অনুযায়ী তখনকার প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদ, ১১ই জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে সরে দাঁড়িয়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। একই সাথে তিনি সে বছরের ২২শে জানুয়ারি যে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল সেটি বাতিল করেছিলেন।

এর সূত্র ধরেই ক্ষমতায় এসেছিলো সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার, যার প্রধান হয়েছিলেন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফখরুদ্দিন আহমেদ। আর তখন সেনাপ্রধান ছিলেন জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ।

মি. আহমেদ সে সময়ের ঘটনা প্রবাহ নিয়ে ‘শান্তির স্বপ্নে: সময়ের স্মৃতিচারণ’ নামক একটি বই লিখেছেন।

সে বইতে তিনি লিখেছেন, “আমি প্রেসিডেন্টকে দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি, নির্বাচন, বিরোধী রাজনৈতিক দলের আল্টিমেটাম এবং বিদেশি রাষ্ট্র সমূহের অবস্থান, বিশেষ করে নির্বাচনের ব্যাপারে জাতিসংঘের দৃঢ় অবস্থানের কথা জানালাম। জাতিসংঘ মিশন থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার করা হলে যে বিপর্যয় ঘটতে পারে তা সবিস্তারে বর্ণনা করলাম। নৌ ও বিমান বাহিনীর প্রধান নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রেসিডেন্টকে পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝাতে সচেষ্ট হলো।”

সার্বিক বিবেচনায় সামরিক কর্মকর্তারা তখন জরুরি অবস্থা জারির পক্ষে তাদের যুক্তি তুলে ধরেছিলাম, যা তখনকার পরিস্থিতিতে উপেক্ষা করা প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলে শেষ পর্যন্ত প্রধান উপদেষ্টার পদ ছাড়ার ঘোষণা দিয়ে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন মি. আহমেদ। এরপর ফখরুদ্দিন আহমেদের সরকার ক্ষমতায় ছিল দুই বছর।

২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় এসেছিলো আওয়ামী লীগ। এগারোই জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারি এবং এর মাধ্যমে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পথ তৈরি হওয়া নিয়ে পরদিনের সব সংবাদপত্র বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছিলো।

এর বাইরে কারফিউ, সংবাদপত্রে সেন্সরশিপ আরোপ, ইয়াজউদ্দিন সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ, গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই আর পিজিআর প্রধানকে সরিয়ে দেয়ার মতো বিষয়গুলো ১২ই জানুয়ারির পত্রিকাগুলোতে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিলো।

জরুরি অবস্থা জারির পরদিন অর্থাৎ ২০০৭ সালের ১২ই জানুয়ারি প্রকাশিত দৈনিক প্রথম আলোর প্রধান শিরোনাম ছিল ‘দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা’।

এতে বলা হয়েছিলো ‘রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন। সংবিধানের ১৪১ অনুচ্ছেদে বর্ণিত রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাবলে তিনি এ ঘোষণা দিয়েছেন। গতকাল ১১ জানুয়ারি সন্ধ্যা থেকে এই ঘোষণা কার্যকর হয়েছে। একই সঙ্গে রাত ১১টা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত ঢাকাসহ সব মহানগর এবং জেলা শহরে কারফিউ বলবৎ করা হয়েছে। পুনরাদেশ না দেয়া পর্যন্ত এ ঘোষণা বলবৎ থাকবে বলে সরকারি তথ্য বিবরণীতে বলা হয়েছে’।

দৈনিক সংবাদে এ সংক্রান্ত খবরের আট কলামব্যাপী শিরোনাম ছিল ‘সব উপদেষ্টার পদত্যাগ’। এর উপরে লেখা হয়েছিলো ‘২২শে জানুয়ারি নির্বাচন হচ্ছে না’ আর নিচের লাইনে লেখা ছিল ‘বিচারপতি ফজলুল হক ভারপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টা’।

এ খবরে বলা হয়েছিলো ‘আগামী ২২শে জানুয়ারি নির্বাচন হচ্ছে না। গতকাল জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে এ ঘোষণা দিয়ে অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদ প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অন্য উপদেষ্টারাও পদত্যাগ করেছেন’।

পত্রিকাটিতে সাত কলাম নিয়ে দ্বিতীয় শিরোনাম করা হয়েছিলো ‘জরুরি অবস্থা ঘোষণা’। এর পাশেই সংবিধানে জরুরি অবস্থা নিয়ে যা যা বলা হয়েছে তার ভিত্তিতে লেখা একটি রিপোর্ট ছিল, যার শিরোনাম ছিল ‘জরুরি অবস্থা: কী বলছে সংবিধান’।

দৈনিক ইত্তেফাকেরও প্রধান শিরোনাম ছিল ‘সারাদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা’। এতে বলা হয় ‘সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সংঘাত, সহিংসতা ও গভীর সংকটের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন’।

এতে আরও বলা হয়, ‘বঙ্গভবনে গতকাল দিনভর নানা তৎপরতার পর সন্ধ্যায় জরুরি অবস্থা ও কারফিউ এর ঘোষণা দেয়া হয়। দুপুরে রাষ্ট্রপতি তিনবাহিনী প্রধানসহ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে দীর্ঘসময় বৈঠক করেন। বিকেলে উপদেষ্টাদের পূর্ব নির্ধারিত বৈঠক অনুষ্ঠানের কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। উপদেষ্টারা বিকাল সাড়ে চারটায় বঙ্গভবনে যান ও কিছুক্ষণ পর ফিরে আসেন’।

পত্রিকাটিতে বার্তা সংস্থা ইউএনবির বরাত দিয়ে প্রকাশিত ‘৯ উপদেষ্টার পদত্যাগ’ শীর্ষক সংবাদে বলা হয়, ‘গতরাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ৯ জন উপদেষ্টা পদত্যাগ করেছেন। বিচারপতি ফজলুল হককে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভারপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। রাত ১১টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত নতুন উপদেষ্টা পরিষদ গঠন প্রক্রিয়া চলছিলো। বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে বঙ্গভবন থেকে যোগাযোগ চলছিলো’।

ইংরেজি দৈনিক দ্যা ডেইলি স্টারেরও প্রধান শিরোনাম ছিল ‘ইমারজেন্সি ডিক্লেয়ার্ড; ইয়াজউদ্দিন কুইটস অ্যাজ চিফ অ্যাডভাইজর’। পত্রিকাটিতে সংবাদ মাধ্যমের ওপর সেন্সরশিপ আরোপ ও মানুষের অধিকারের ওপর যেসব বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিলো তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিলো।

দৈনিক যুগান্তরেও আট কলামব্যাপী প্রধান শিরোনাম ছিল ‘জরুরি অবস্থা ঘোষণা’। এর নিচে সেনাসদস্যদের টহলের ছবি প্রকাশ করেছিলো পত্রিকাটি।

এর বাইরে ‘একতরফা নির্বাচনে জাতিসংঘ সহায়তা দেবে না’ এবং ‘সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে খালেদা জিয়ার জরুরি বৈঠক’ শিরোনামে দুটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিলো পত্রিকাটিতে।

যুগান্তরের আরেকটি সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘১৬ বছর পর কারফিউ’। এতে মূলত নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর এটাই যে প্রথম কারফিউ জারির ঘটনা সেটি উল্লেখ করা হয়।

দৈনিক সমকালও জরুরি অবস্থা জারি নিয়ে করা সংবাদটিকেই লিড শিরোনাম হিসেবে প্রকাশ করেছিলো। রাষ্ট্রপতির জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণের শিরোনাম করেছিলো ‘সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো সাধারণ নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হবে না’।

পত্রিকাটিতে রাষ্ট্রায়ত্ত বার্তা সংস্থা বাসস এর একটি খবর প্রকাশ করা হয় যার শিরোনাম ছিল ‘একতরফা নির্বাচনে সেনা সংশ্লিষ্টতা শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে প্রভাব ফেলবে’।

এই খবরে বলা হয়েছিলো ‘বাংলাদেশ জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক মিজ রেনাটা লক ডেসালিয়েন বলেছেন, ‘বাংলাদেশে ২২ জানুয়ারির নির্বাচনে সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্টরা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা অভিযানে দেশটির ভবিষ্যৎ ভূমিকায় প্রভাব ফেলতে পারে’।

তবে সবগুলো পত্রিকাতেই মূলত গুরুত্ব পেয়েছে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে দেয়া রাষ্ট্রপতির ভাষণ, প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে তার পদত্যাগ ও কারফিউ জারির মতো বিষয়গুলোই।

এসব খবরে রাষ্ট্রপতিকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছিলো যে ‘সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথকে সুগম করার লক্ষ্যে আমি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের পদ থেকে ইস্তফা প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি এবং আমি আগামী ২/১ দিনের মধ্যে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করবো। নতুন উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের পূর্ব পর্যন্ত বর্তমান পরিষদের জ্যেষ্ঠতম উপদেষ্টা ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। নবগঠিত অন্তর্বর্তী সরকার সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে আলোচনা করে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা দেশ শাসনের ব্যবস্থা করবেন’।

দৈনিক প্রথম আলো রাষ্ট্রপতির ভাষণ নিয়ে করা সংবাদটির শিরোনাম দিয়েছিলো ‘গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে পদত্যাগ করেছি’। শেষ পর্যন্ত ড. ফখরুদ্দিন আহমেদকে প্রধান উপদেষ্টা করে নতুন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেছিলেন তখনকার রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ।

এছাড়া পত্রিকাটিতে ‘বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে কূটনীতিকদের বৈঠক’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয় তখনকার পরিস্থিতি নিয়ে কানাডিয়ান হাইকমিশনারের বাসায় রাজনীতিক-কূটনীতিকরা বৈঠক করেছেন।

পরে উভয় দলের নেতারা নিজ নিজ দলীয় প্রধানের সাথে সাক্ষাৎ করে আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবহিত করেন। এর বাইরে দৈনিক সংবাদের আরেকটি খবরের শিরোনাম ছিল ‘সব বেসরকারি চ্যানেলে খবর বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে পিআইডি’।

এতে বলা হয় ‘গতকাল রাতে রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ সারাদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার পরপরই বেসরকারি চ্যানেলের সব ধরনের সংবাদ ও টকশো প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। এরপরই বেসরকারি সব চ্যানেল সঙ্গীতানুষ্ঠান ও নাটকসহ বিনোদনমূলক সংবাদ প্রচার করেছে। জানা গেছে, সরকারি তথ্য অধিদপ্তর (পিআইডি) সব বেসরকারি চ্যানেলে খবর বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে’। সুত্র : বিবিসি বাংলা

নিউজটি শেয়ার করুন

ওয়ান ইলেভেনের ঘটনা সংবাদপত্রে যেভাবে এসেছিলো

আপডেট সময় : ০১:০১:১৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২৫

বাংলাদেশে নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন- এই ইস্যুতে শুরু হওয়া আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ভয়াবহ রাজনৈতিক সহিংসতার জের ধরে ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারিতে জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিলো, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘ওয়ান ইলেভেন’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

আওয়ামী লীগসহ সমমনা দলগুলোর দাবি অনুযায়ী তখনকার প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদ, ১১ই জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে সরে দাঁড়িয়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। একই সাথে তিনি সে বছরের ২২শে জানুয়ারি যে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল সেটি বাতিল করেছিলেন।

এর সূত্র ধরেই ক্ষমতায় এসেছিলো সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার, যার প্রধান হয়েছিলেন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফখরুদ্দিন আহমেদ। আর তখন সেনাপ্রধান ছিলেন জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ।

মি. আহমেদ সে সময়ের ঘটনা প্রবাহ নিয়ে ‘শান্তির স্বপ্নে: সময়ের স্মৃতিচারণ’ নামক একটি বই লিখেছেন।

সে বইতে তিনি লিখেছেন, “আমি প্রেসিডেন্টকে দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি, নির্বাচন, বিরোধী রাজনৈতিক দলের আল্টিমেটাম এবং বিদেশি রাষ্ট্র সমূহের অবস্থান, বিশেষ করে নির্বাচনের ব্যাপারে জাতিসংঘের দৃঢ় অবস্থানের কথা জানালাম। জাতিসংঘ মিশন থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার করা হলে যে বিপর্যয় ঘটতে পারে তা সবিস্তারে বর্ণনা করলাম। নৌ ও বিমান বাহিনীর প্রধান নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রেসিডেন্টকে পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝাতে সচেষ্ট হলো।”

সার্বিক বিবেচনায় সামরিক কর্মকর্তারা তখন জরুরি অবস্থা জারির পক্ষে তাদের যুক্তি তুলে ধরেছিলাম, যা তখনকার পরিস্থিতিতে উপেক্ষা করা প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলে শেষ পর্যন্ত প্রধান উপদেষ্টার পদ ছাড়ার ঘোষণা দিয়ে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন মি. আহমেদ। এরপর ফখরুদ্দিন আহমেদের সরকার ক্ষমতায় ছিল দুই বছর।

২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় এসেছিলো আওয়ামী লীগ। এগারোই জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারি এবং এর মাধ্যমে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পথ তৈরি হওয়া নিয়ে পরদিনের সব সংবাদপত্র বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছিলো।

এর বাইরে কারফিউ, সংবাদপত্রে সেন্সরশিপ আরোপ, ইয়াজউদ্দিন সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ, গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই আর পিজিআর প্রধানকে সরিয়ে দেয়ার মতো বিষয়গুলো ১২ই জানুয়ারির পত্রিকাগুলোতে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিলো।

জরুরি অবস্থা জারির পরদিন অর্থাৎ ২০০৭ সালের ১২ই জানুয়ারি প্রকাশিত দৈনিক প্রথম আলোর প্রধান শিরোনাম ছিল ‘দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা’।

এতে বলা হয়েছিলো ‘রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন। সংবিধানের ১৪১ অনুচ্ছেদে বর্ণিত রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাবলে তিনি এ ঘোষণা দিয়েছেন। গতকাল ১১ জানুয়ারি সন্ধ্যা থেকে এই ঘোষণা কার্যকর হয়েছে। একই সঙ্গে রাত ১১টা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত ঢাকাসহ সব মহানগর এবং জেলা শহরে কারফিউ বলবৎ করা হয়েছে। পুনরাদেশ না দেয়া পর্যন্ত এ ঘোষণা বলবৎ থাকবে বলে সরকারি তথ্য বিবরণীতে বলা হয়েছে’।

দৈনিক সংবাদে এ সংক্রান্ত খবরের আট কলামব্যাপী শিরোনাম ছিল ‘সব উপদেষ্টার পদত্যাগ’। এর উপরে লেখা হয়েছিলো ‘২২শে জানুয়ারি নির্বাচন হচ্ছে না’ আর নিচের লাইনে লেখা ছিল ‘বিচারপতি ফজলুল হক ভারপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টা’।

এ খবরে বলা হয়েছিলো ‘আগামী ২২শে জানুয়ারি নির্বাচন হচ্ছে না। গতকাল জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে এ ঘোষণা দিয়ে অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদ প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অন্য উপদেষ্টারাও পদত্যাগ করেছেন’।

পত্রিকাটিতে সাত কলাম নিয়ে দ্বিতীয় শিরোনাম করা হয়েছিলো ‘জরুরি অবস্থা ঘোষণা’। এর পাশেই সংবিধানে জরুরি অবস্থা নিয়ে যা যা বলা হয়েছে তার ভিত্তিতে লেখা একটি রিপোর্ট ছিল, যার শিরোনাম ছিল ‘জরুরি অবস্থা: কী বলছে সংবিধান’।

দৈনিক ইত্তেফাকেরও প্রধান শিরোনাম ছিল ‘সারাদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা’। এতে বলা হয় ‘সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সংঘাত, সহিংসতা ও গভীর সংকটের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন’।

এতে আরও বলা হয়, ‘বঙ্গভবনে গতকাল দিনভর নানা তৎপরতার পর সন্ধ্যায় জরুরি অবস্থা ও কারফিউ এর ঘোষণা দেয়া হয়। দুপুরে রাষ্ট্রপতি তিনবাহিনী প্রধানসহ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে দীর্ঘসময় বৈঠক করেন। বিকেলে উপদেষ্টাদের পূর্ব নির্ধারিত বৈঠক অনুষ্ঠানের কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। উপদেষ্টারা বিকাল সাড়ে চারটায় বঙ্গভবনে যান ও কিছুক্ষণ পর ফিরে আসেন’।

পত্রিকাটিতে বার্তা সংস্থা ইউএনবির বরাত দিয়ে প্রকাশিত ‘৯ উপদেষ্টার পদত্যাগ’ শীর্ষক সংবাদে বলা হয়, ‘গতরাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ৯ জন উপদেষ্টা পদত্যাগ করেছেন। বিচারপতি ফজলুল হককে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভারপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। রাত ১১টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত নতুন উপদেষ্টা পরিষদ গঠন প্রক্রিয়া চলছিলো। বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে বঙ্গভবন থেকে যোগাযোগ চলছিলো’।

ইংরেজি দৈনিক দ্যা ডেইলি স্টারেরও প্রধান শিরোনাম ছিল ‘ইমারজেন্সি ডিক্লেয়ার্ড; ইয়াজউদ্দিন কুইটস অ্যাজ চিফ অ্যাডভাইজর’। পত্রিকাটিতে সংবাদ মাধ্যমের ওপর সেন্সরশিপ আরোপ ও মানুষের অধিকারের ওপর যেসব বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিলো তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিলো।

দৈনিক যুগান্তরেও আট কলামব্যাপী প্রধান শিরোনাম ছিল ‘জরুরি অবস্থা ঘোষণা’। এর নিচে সেনাসদস্যদের টহলের ছবি প্রকাশ করেছিলো পত্রিকাটি।

এর বাইরে ‘একতরফা নির্বাচনে জাতিসংঘ সহায়তা দেবে না’ এবং ‘সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে খালেদা জিয়ার জরুরি বৈঠক’ শিরোনামে দুটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিলো পত্রিকাটিতে।

যুগান্তরের আরেকটি সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘১৬ বছর পর কারফিউ’। এতে মূলত নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর এটাই যে প্রথম কারফিউ জারির ঘটনা সেটি উল্লেখ করা হয়।

দৈনিক সমকালও জরুরি অবস্থা জারি নিয়ে করা সংবাদটিকেই লিড শিরোনাম হিসেবে প্রকাশ করেছিলো। রাষ্ট্রপতির জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণের শিরোনাম করেছিলো ‘সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো সাধারণ নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হবে না’।

পত্রিকাটিতে রাষ্ট্রায়ত্ত বার্তা সংস্থা বাসস এর একটি খবর প্রকাশ করা হয় যার শিরোনাম ছিল ‘একতরফা নির্বাচনে সেনা সংশ্লিষ্টতা শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে প্রভাব ফেলবে’।

এই খবরে বলা হয়েছিলো ‘বাংলাদেশ জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক মিজ রেনাটা লক ডেসালিয়েন বলেছেন, ‘বাংলাদেশে ২২ জানুয়ারির নির্বাচনে সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্টরা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা অভিযানে দেশটির ভবিষ্যৎ ভূমিকায় প্রভাব ফেলতে পারে’।

তবে সবগুলো পত্রিকাতেই মূলত গুরুত্ব পেয়েছে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে দেয়া রাষ্ট্রপতির ভাষণ, প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে তার পদত্যাগ ও কারফিউ জারির মতো বিষয়গুলোই।

এসব খবরে রাষ্ট্রপতিকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছিলো যে ‘সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথকে সুগম করার লক্ষ্যে আমি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের পদ থেকে ইস্তফা প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি এবং আমি আগামী ২/১ দিনের মধ্যে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করবো। নতুন উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের পূর্ব পর্যন্ত বর্তমান পরিষদের জ্যেষ্ঠতম উপদেষ্টা ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। নবগঠিত অন্তর্বর্তী সরকার সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে আলোচনা করে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা দেশ শাসনের ব্যবস্থা করবেন’।

দৈনিক প্রথম আলো রাষ্ট্রপতির ভাষণ নিয়ে করা সংবাদটির শিরোনাম দিয়েছিলো ‘গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে পদত্যাগ করেছি’। শেষ পর্যন্ত ড. ফখরুদ্দিন আহমেদকে প্রধান উপদেষ্টা করে নতুন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেছিলেন তখনকার রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ।

এছাড়া পত্রিকাটিতে ‘বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে কূটনীতিকদের বৈঠক’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয় তখনকার পরিস্থিতি নিয়ে কানাডিয়ান হাইকমিশনারের বাসায় রাজনীতিক-কূটনীতিকরা বৈঠক করেছেন।

পরে উভয় দলের নেতারা নিজ নিজ দলীয় প্রধানের সাথে সাক্ষাৎ করে আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবহিত করেন। এর বাইরে দৈনিক সংবাদের আরেকটি খবরের শিরোনাম ছিল ‘সব বেসরকারি চ্যানেলে খবর বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে পিআইডি’।

এতে বলা হয় ‘গতকাল রাতে রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ সারাদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার পরপরই বেসরকারি চ্যানেলের সব ধরনের সংবাদ ও টকশো প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। এরপরই বেসরকারি সব চ্যানেল সঙ্গীতানুষ্ঠান ও নাটকসহ বিনোদনমূলক সংবাদ প্রচার করেছে। জানা গেছে, সরকারি তথ্য অধিদপ্তর (পিআইডি) সব বেসরকারি চ্যানেলে খবর বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে’। সুত্র : বিবিসি বাংলা