আটলান্টিস নামে কি কোনো সভ্যতা আসলেই ছিল?

- আপডেট সময় : ০১:৩৬:৫৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫
- / ৩৬১ বার পড়া হয়েছে

সমুদ্রের তলদেশে হারিয়ে যাওয়া শহরের গল্প আমরা রূপকথার গল্পে পড়েছি। অনেক সিনেমায়ও চিত্রিত হয়েছে এমন গল্প। সে রকমই একটি শহর আটলান্টিস। পৌরাণিক উপকথা অনুযায়ী সমুদ্রতলে হারিয়ে যাওয়া একটি দ্বীপ এটি। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৬০ এর দিকে বিশ্বখ্যাত দার্শনিক প্লেটো তাঁর ‘টিমাউস অ্যান্ড ক্রিটিয়াস’ বইয়ে প্রথম আটলান্টিসের কথা উল্লেখ করেন।
প্লেটোর বইয়ের বর্ণনা অনুযায়ী, প্রায় ৯ হাজার বছর আগে আটলান্টিস ছিল হারকিউলিসের স্তম্ভের (বর্তমান জিব্রাল্টার প্রণালি) পাদদেশের একটি দ্বীপ। শিক্ষা-দীক্ষা ও প্রযুক্তিতে উন্নত এই সাম্রাজ্য কয়েক শত বছর প্রতাপ নিয়ে টিকে ছিল। সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের ফলে একটি বড় ধরনের বিপর্যয়ের ফলে সাম্রাজ্যটি ধ্বংস হয়ে যায়, সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যায় আটলান্টিস।
হারিয়ে যাওয়া আটলান্টিস পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো এবং রহস্যজনক সভ্যতার মধ্যে অন্যতম। প্রাচীনকাল থেকেই গবেষকরা এই শহর কোথায় অবস্থিত ছিল এবং কীভাবে তা ধ্বংসের পথে চলে যায়, তা জানার চেষ্টা করে এসেছেন। প্লেটো বর্ণিত এই উন্নত দ্বীপ সভ্যতার গল্প কি আদৌ সত্য? এ রকম কোনো সভ্যতার উপস্থিতি কোথায় ছিল? এসব প্রশ্ন নিয়ে ছয়টি বিখ্যাত তত্ত্বের কথা সবিস্তারে জেনে নেওয়া যাক।
আটলান্টিস ছিল মধ্য-আটলান্টিকের মহাদেশ
মার্কিন লেখক ও রাজনীতিবিদ ইগনাশিয়াস ডোনেলি ১৮৮২ সালে ‘আটলান্টিস, দ্য অ্যান্টিডিলুভিয়ান ওয়ার্ল্ড’ নামের একটি বই লিখেন। এতে তিনি দাবি করেন, আটলান্টিস একটি ঐতিহাসিক স্থান, এটি প্লেটোর কাল্পনিক কোনো উদ্ভাবন নয়।
ডোনেলির যুক্তি– ধাতু, ভাষা বা কৃষি খাতের অগ্রগতি আগের কোনো উন্নত সভ্যতার থেকে পরবর্তী সভ্যতা পেয়ে থাকে। আটলান্টিস ছিল এমনই একটি উন্নত সভ্যতা, যেখান থেকে পরবর্তী সভ্যতাগুলো বিভিন্ন কিছু পেয়েছে। আটলান্টিক মহাসাগরের পানির স্রোত পরিবর্তন করতে গিয়ে আকস্মিক বন্যায় আটলান্টিস ডুবে যায়।
উনিশ শতকের শেষ দিকে ডোনেলির এই তত্ত্ব বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। আধুনিক সমুদ্রবিদ্যা এবং প্লেট টেকটোনিক্স বা পৃথিবীর ভূত্বকের গঠন ও গতিবিধি নিয়ে জানাশোনা বাড়ার পরও অনেকে ডোনেলির তত্ত্বকে সঠিক বলে মনে করেন।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের করালগ্রাসে পড়েছিল আটলান্টিস
ডোনেলির তত্ত্বকে পরবর্তীতে আরও কিছু গবেষক এগিয়ে নিয়েছেন। তাঁদের একজন চার্লস বার্লিটজ। ১৯৭০– এর দশকে বার্লিটজ দাবি করেন, আটলান্টিস মহাদেশের অবস্থান ছিল বাহামা দ্বীপপুঞ্জের কাছাকাছি কোনো স্থানে। কুখ্যাত ‘বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল’ এই উন্নত দ্বীপ সভ্যতাকে গ্রাস করেছিল বলে দাবি তাঁর।
বার্লিটজের মতে, আটলান্টিস একটি মহাদেশ ছিল। এটি কুখ্যাত বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের করালগ্রাসের শিকার হয়েছিল। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল আটলান্টিকের এমন একটি অঞ্চল যেখানে বেশ কয়েকটি জাহাজ রহস্যজনকভাবে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।
এই তত্ত্বের সমর্থকেরা বিমিনি উপকূলে পাওয়া মনুষ্যসৃষ্ট দেয়াল এবং সড়কের কথা বলেন। তাদের দাবি, উন্নত প্রযুক্ত না হলে এসব দেয়াল ও সড়ক তৈরি সম্ভব নয়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা কাঠামোগুলো খতিয়ে দেখেছেন। তাদের মতে, এসব দেয়াল ও সড়ক প্রাকৃতিকভাবে হয়েছে, তা মানুষের তৈরি নয়।
আটলান্টিস আসলে অ্যান্টার্কটিকা
আরেকটি তত্ত্ব অনুযায়ী, আটলান্টিস আসলে বর্তমান অ্যান্টার্কটিকা। যখন এখানে মানুষের বসবাস ছিল তখন সেখানে গড়ে উঠেছিল উন্নত সভ্যতা। চার্লস হ্যাপগুড ১৯৫৮ সালে তাঁর আর্থ’স শিফটিং ক্রাস্ট বইয়ে এই তথ্যটি সামনে নিয়ে এসেছিলেন। আলবার্ট আইনস্টাইন বইটির ভূমিকা লেখেন।
হ্যাপগুডের মতে, প্রায় ১২ হাজার বছর আগে পৃথিবীর ভূত্বক স্থানান্তরিত হয়েছিল। ফলে আটলান্টিস অনেক বেশি উত্তরে সরে যায়, যা পরবর্তীতে অ্যান্টার্কটিকা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। স্থানান্তরের আগে এটি নাতিশীতোষ্ণ অবস্থায় থাকলেও বর্তমানে হিমশীতল স্থানে পরিণত হয়েছে। ফলে ধ্বংস হয়ে যায় আটলান্টিসের উন্নত সভ্যতা, যা অ্যান্টার্কটিকার অনেক গভীরে হিমবাহের নিচে চাপা পড়েছে।
হ্যাপগুড যখন ভূত্বক স্থানান্তরিত হওয়ার তত্ত্ব প্রচার করেন, তখনো প্লেট টেকটোনিক্স সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ধারণা এতটা গভীর হয়নি। পরে এই বিজ্ঞান বিকশিত হওয়ার পর তাঁর তত্ত্বটা কিছুটা মলিন হয়ে পড়ে।
গল্প থেকে আটলান্টিসের সৃষ্টি
একদল গবেষক মনে করেন, আটলান্টিস কাল্পনিক সভ্যতা। তবে বাস্তব একটি ঘটনাকে ভিত্তি করে এর গল্প তৈরি হয়। গল্পটি হলো, কোনো কারণে ভূমধ্যসাগর বসফরাস প্রণালিতে ঢুকে পড়েছিল। পরবর্তী সময়ে প্রায় ৫ হাজার ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বে কৃষ্ণ সাগরে ভয়াবহ বন্যা হয়। বন্যার পরে মিঠা পানির কৃষ্ণসাগরের আকার দ্বিগুণ হয়, ফলে উভয় পাশের সভ্যতাগুলো তলিয়ে যায়। এই গল্প স্থানীয়দের মধ্যে মুখে মুখে বংশ পরম্পরায় ছড়িয়ে পড়ে। প্লেটো সম্ভবত এই ঘটনা অবলম্বনে আটলান্টিসের গল্প বলেছেন।
আটলান্টিস মিনোয়ান সভ্যতার গল্প
আটলান্টিস নিয়ে সাম্প্রতিক তত্ত্বটি হলো, এটি আসলে মিনোয়ান সভ্যতার গল্প। খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ২৫০০-১৬০০ সময়কালে গ্রিক দ্বীপপুঞ্জে এই সভ্যতা বিকাশ লাভ করেছিল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চার হাজারেরও বেশি বছর আগে মিনোয়ান সভ্যতা ক্রিট ও থেরা (বর্তমান সান্তোরিনি) গ্রিক দ্বীপপুঞ্জে বিকাশ লাভ করেছিল। কিংবদন্তি রাজা মিনোসের নামে এই সভ্যতার নাম রাখা হয়েছিল। এটিকে ইউরোপের প্রথম মহান সভ্যতা ধরা হয়। মিনোয়ানরা জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদ ও পাকা সড়ক তৈরি করেছিল। লিখিত ভাষা উদ্ভাবন করেছিল। ইতিহাসবিদেরা মনে করেন, খ্রিষ্টপূর্ব ১৬০০ সালে ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট অগ্ন্যুৎপাতে সভ্যতাটি ধ্বংস হয়। প্লেটো এই ঘটনা থেকে আটলান্টিসের গল্প তৈরি করেছেন বলে ধারণা করা হয়।
আটলান্টিস বলে আসলে কিছুই ছিল না!
অধিকাংশ ইতিহাসবিদ ও বিজ্ঞানীর মতে, আটলান্টিস বলে আদৌ কোনো সভ্যতা ছিল না। এটি প্লেটোর কাল্পনিক বর্ণনা।
এই তত্ত্বের অনুসারীদের মতে, গ্রিক দার্শনিক প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা দেওয়ার জন্যই আটলান্টিসের গল্প ফেঁদেছিলেন। তাঁর গল্পে সভ্যতাটি ধ্বংসের কথা মানুষের জন্য একটি সতর্কতা। এই সতর্কতার অর্থ হলো, ‘অহংকারে সব কিছু ধ্বংস হয়ে যায়। কাজেই সাবধান, অন্যথায় দেবতার অভিশাপে ধ্বংস হয়ে যাবে।’
আটলান্টিস দ্বীপ সভ্যতার কথা প্লেটোর ‘টিমাউস অ্যান্ড ক্রিটিয়াস’ বইয়ের বাইরে আর কোনো গ্রন্থে উল্লেখ নেই। কিন্তু প্লেটো বা তাঁর আগের সময়ের অনেক বই টিকে আছে। এমন উন্নত সভ্যতার অস্তিত্ব থাকলে এর কথা প্লেটোর সমসাময়িক বা আগে-পরের অন্য লেখকদের বইয়েও উল্লেখ থাকত বলে মনে করেন ইতিহাসবিদেরা। অন্যদিকে এরই মধ্যে সমুদ্রবিদ্যা এবং সমুদ্রতল মানচিত্রের আধুনিক জ্ঞান অনেক দূর এগিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আটলান্টিস বলে কোনো দ্বীপ সভ্যতার হদিস পাওয়া যায়নি।
তথ্যসূত্র: হিস্ট্রি ডট কম, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, ব্রিটানিকা, মেরিন ইনসাইট