সামরিক খাতে যেভাবে বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে তুরস্ক

- আপডেট সময় : ০১:৩৯:৩৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫
- / ৩৫৮ বার পড়া হয়েছে

সামরিকভাবে নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান তৈরিতে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যাপকভাবে আধুনিকায়ন করে চলছে তুরস্ক। এক সময় অস্ত্র ক্রয় করে নিজেদের সক্ষমতা বাড়ালেও সম্প্রতি নিজস্ব অস্ত্র তৈরি করে স্বাধীন এক অবস্থান সৃষ্টি করেছে আঙ্কারা। জানা গেছে, সামরিক সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করতে দেশটিতে কাজ করছে প্রায় ৩ হাজার কোম্পানি। খবর আল জাজিরা
বর্তমানে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম সেনাবাহিনীর পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য অস্ত্র রপ্তানিকারক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে তুরস্ক। তাদের আন্তর্জাতিক বাজারে কিছু আইকনিক ও চাহিদাসম্পন্ন সামরিক সরঞ্জাম রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কের রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়ে ৭.১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। যেখানে এক দশক আগে দেশটির রপ্তানি ছিল মাত্র ১.৯ বিলিয়ন ডলার। ইউরোপ-এশিয়া মহাদেশের সংযোগ স্থাপনকারী এই দেশের অন্যতম রপ্তানির কেন্দ্র হলো ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য। প্রতিরক্ষায় তুরস্কের এমন শক্তি বৃদ্ধি ও স্বাধীন অবস্থানের বিস্তারিত থাকছে এই প্রতিবেদনে।
তুরস্ক বহুদিন ধরে সামরিক দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের চেষ্টা করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় দেশটি ১৯৮৫ সালে প্রতিরক্ষা শিল্প উন্নয়ন ও সহায়তা প্রশাসন অফিস (এসএজিইবি) প্রতিষ্ঠা করে। বছরের পর বছর ধরে এসএজিইবি গবেষণা ও উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার উপর মনোনিবেশ করে। কিন্তু তুরস্ক অস্ত্র কেনা ও সেগুলো ব্যবহারে বিভিন্ন বিধিনিষেধ কাটিয়ে ওঠার পর দেশীয় উৎপাদনে মনোনিবেশ করে।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালে আঙ্কারা একটি বড় প্রতিরক্ষা নকশা তৈরির মাধ্যমে দেশীয় যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদনে ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটায়। ফলশ্রুতিতে বর্তমান সময়ে হাজার হাজার তুর্কি প্রতিরক্ষা নির্মাতাদের স্থল, আকাশ এবং নৌ সক্ষমতা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হচ্ছে।
সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত তুর্কি ড্রোন (ইউএভি) হলো আইকনিক বায়রাক্তার টিবি-২। এই মনুষ্যবিহীন যান প্রথম প্রকাশ্যে আসে ২০১৪ সালে। দেশটির সবচেয়ে রপ্তানি হওয়া সামরিক যানের মধ্যে অন্যতম এটি। তবে রপ্তানির তালিকায় দেশটির আরও কিছু ড্রোনের নাম রয়েছে।
দেশটি তার ‘স্টিল ডোম’ (সেলিক কুবে) নিয়েও কাজ করছে। এটি এমন এক আধুনিক প্রতিরোধ সিস্টেম যা এআই দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এই ব্যবস্থা আকাশপথের যে কোনো হুমকি শনাক্ত এবং প্রতিহত করতে পারে।
এছাড়া, প্রথম দেশীয় পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান ‘কান’ সামরিক বহরে যুক্ত করার দাঁড়প্রান্তে রয়েছে তুরস্ক। এই যুদ্ধবিমান পুরাতন আমেরিকান এফ-১৬ যুদ্ধবিমানের আদলে তৈরি করা হয়েছে।
তুরস্কের সাঁজোয়া যান উৎপাদনের শীর্ষে রয়েছে ‘আলতাই’ মেইন ব্যাটেল ট্যাঙ্ক। এটি জার্মান লেপার্ড বা মার্কিন আব্রামসের মতো পশ্চিমা মডেলগুলোর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে।
সেনাবাহিনীর কাছে আরও রয়েছে ‘কিরপি’ (হেজহগ) মাইন-প্রতিরোধী যান, এফএনএসএস প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘কাপলান’ এবং ‘পার্স’র মতো আধুনিক পদাতিক যুদ্ধযান।
নৌযান উৎপাদনেও ভূমিকা রেখেছে তুরস্ক। রণতরি উৎপাদনের লক্ষ্যে ২০০৪ সালে দীর্ঘমেয়াদি মিলি জেমি প্রোজেসি জাতীয় জাহাজ প্রকল্প প্রতিষ্ঠা করা হয়। মিলিজেম অত্যাধুনিক ‘অ্যাডা-ক্লাস’ কর্ভেট এবং ‘ইস্তাম্বুল-ক্লাস’ ফ্রিগেট তৈরি করেছে। আরও উন্নত যুদ্ধজাহাজ এবং সাবমেরিন তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে এই প্রকল্পের আওতায়।
দেশটির রণতরীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, ২০২৩ সালে নৌ-বহরে যুক্ত হওয়া উভচর ড্রোন বহনকারী আক্রমণকারী জাহাজ ‘টিসিজি আনাদুলু’। এটি তুর্কি নৌবাহিনীর বৃহত্তম জাহাজ।
এ ছাড়াও তুরস্কের কাছে স্মার্ট বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং ক্ষেপণাস্ত্রের একটি দীর্ঘ তালিকা রয়েছে। যেমন—স্বল্প-পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ‘বোরা’ এবং দীর্ঘ-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ‘আতমাকা’ (হক)।
তুরস্কের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেদের শক্তিশালী করার অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে বলা যেতে পারে। ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে, সাইপ্রাসে সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
এ ছাড়া নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে, তুরস্কের কাছে অস্ত্র রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে জার্মানি। দেশটি অভিযোগ তোলে তুরস্কের কাছে বিক্রি করা সাঁজোয়া যানগুলো শুধুমাত্র অন্যাটোভূক্ত রাষ্ট্রের আক্রমণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার কথা থাকলেও অভ্যন্তরীণভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল।
এরপর ২০২০ সালে রাশিয়ান এস-৪০০ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার জন্য মার্কিন তুরস্কের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে তুরস্ক অস্ত্র প্রস্তুতকারক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে।
কয়েক বছর ধরে আধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সামরিক খাতে তুরস্কের রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বব্যাপী অস্ত্র রপ্তানির মাধ্যমে ১.৭ শতাংশ আয় করে থাকে দেশটি। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই) অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৪ সময়কালে বিশ্বের প্রতিরক্ষা রপ্তানিকারকদের র্যাঙ্কিংয়ে দেশটির অবস্থান রয়েছে ১১তম স্থানে।
পর্যবেক্ষকদের মতে, গত বছর দেশটি অস্ত্র রপ্তানি করেছে ১৭৮টি দেশে যা ২০১৫-২০১৯ সালের তুলনায় ১০৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এসআইপিআরআই অনুসারে, ২০২০-২০২৪ সময়কালে এর প্রধান গ্রাহক ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত, পাকিস্তান এবং কাতার।
দেশটির সবচেয়ে বিখ্যাত রপ্তানির ক্ষেত্রে, বায়রাক্তার মাঝারি উচ্চতার ড্রোন রয়েছে। এই ড্রোন ইরাক, ইউক্রেন, কেনিয়া, বাংলাদেশ এবং জাপানসহ কমপক্ষে ৩১টি দেশে রপ্তানি করা হয়েছে।
গত বছর, এর প্রস্তুতকারক ‘বেইকার’ তাদের নিজস্ব জেট ইঞ্জিন তৈরিতে ৩০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য আরও বেশি উৎপাদন করা এবং আন্তর্জাতিক সাপ্লাই চেইনের চ্যালেঞ্জ এড়ানো।